হাসান হামিদ
Advertisement
কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি তুলনামূলক বেড়েছে। বাসা থেকে বের হচ্ছি না। করোনা সংক্রমণ কমাতে চলছে কঠোর লকডাউন। এর মধ্যে খবর পেলাম, এবারও দেশে বন্যা হতে পারে। এফএফডব্লিউসি অলরেডি তিনটি নদী অববাহিকায় বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে বলে জেনেছি। তাদের সেই পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এবারের বন্যা শুরু হবেজুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে। আর স্থায়ী হতে পারে অন্তত দশ দিন। আমরা জানি, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমাদের দেশে প্রতিবছরই কোনো না কোনো এলাকায় কম-বেশি বন্যা হয়। তাতে মানুষের কষ্ট বাড়ে, জীবনযাপনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভোগ।
বাংলাদেশে বিশ থেকে পঁচিশ শতাংশ এলাকা যখন বন্যায় ডুবে, তখন তা স্বাভাবিক বলেই ধরা হয়। কিন্তু যখনই পঁচিশ শতাংশের বেশি এলাকা বন্যায় তলিয়ে যায়, তখনই তা আর স্বাভাবিক মনে করা হয় না। আবার বন্যার স্থায়িত্বকালও এক সপ্তাহের বেশি হলে তা সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। সাধারণত এ ধরনের বন্যা আগে আমাদের দেশে কয়েক বছর পর হতো। কিন্তু এখন আমরা দেখছি যে, বিগত পাঁচ বছর ধরেই ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নিয়মিতভাবে বড় বন্যা হচ্ছে। প্লাবিত হচ্ছে অনেক এলাকা, স্থায়ী হচ্ছে কয়েক সপ্তাহ থেকে মাস। তাতে বন্যা কবলিত এলাকার সবকিছুই হুমকির মুখে পড়ে। করোনার মধ্যে সামনে যে বন্যা ধেয়ে আসছে, তা মোকাবিলায় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট অন্য সকলের প্রস্তুতি আছে তো?
বর্ষাকালে বাংলাদেশে প্রধান দুর্যোগের দুইটি হল বন্যা আর বজ্রপাত। আমরা লক্ষ করছি, ইদানীং বজ্রপাত ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে দেড়'শোর মত মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে বিগত ৮ বছরে বজ্রপাতের ঘটনায় আঠারো’শোর বেশি মানুষ মারা গেছে বলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে। আর গত কয়েক বছর ধরে দেশের কিছু অঞ্ছলে বিশেষ করে হাওর এলাকায় ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে।
Advertisement
যেহেতু বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তাই একে পুরোপুরিভাবে আমরা দমিয়ে ফেলতে বা প্রতিরোধ করতে পারবো না। কিন্তু দুর্যোগ পূর্ববর্তী, দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ পরবর্তী সঠিক পদক্ষেপ ও সহায়তা এর ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সাল থেকে অতি মাত্রায় বৃষ্টি হচ্ছে আমাদের দেশে। এটাকে পিরিয়ডকালীন বিবেচনা করে সব পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে অসহায় মানুষগুলোর কষ্ট অনেকটাই লাঘব হবে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশে বন্যা হয় সাধারণত চারটি অববাহিকায়। এগুলো হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, মেঘনা এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকা। এখানে বন্যার উৎস প্রধানত দুটি-অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানি। এফএফডব্লিউসি বলেছে, এবার দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের তেইশটি জেলায় বন্যা হতে পারে। এই যে বন্যা এভাবে বাড়ছে, এর মূল কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যা বাড়ার একটি কারণ একই সময়ে অত্যাধিক বৃষ্টিপাত। আর মূলত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এটা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বৃষ্টি বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পলি পড়ার পরিমাণ আগের চেয়ে বাড়ছে। এ কারণে দিন দিন নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমছে। ফলে উজানের ঢল এলেই তা দ্রুত বন্যায় পরিণত হচ্ছে। বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সামনের দিনে ব্রহ্মপুত্রে বৃষ্টি ও পলি পড়ার পরিমাণ আরো বাড়বে। ফলে আমাদের হয়তো প্রায় প্রতিবছরই এ ধরনের বন্যার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। পাশাপাশি বন্যার জন্য নিতে হবে যথার্থ প্রস্তুতি।
করোনায় মানুষের জীবনযাত্রা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে আমরা জানি। এর মধ্যে যে এলাকায় বন্যা হবে, সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা কতটা বিপর্যস্ত হতে পারে, তা আন্দাজ করাও কঠিন। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ কিংবা ছবি, টিভি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লাইভ প্রোগ্রামে আমরা বন্যা-উপদ্রুত এলাকার যতোটুকু দেখি তা দিয়ে পুরোপুরি বোঝা মুশকিল।
বন্যায় মানুষের প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় খাদ্য ও নিরাপদ পানির সংকট। আর নিরাপদ পানির অভাব থেকে পানিবাহিত নানা ধরনের রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘস্থায়ী বন্যার অভিজ্ঞতা অতি সম্প্রতিই আমাদের হয়েছে। মনে আছে, প্রায় দেড় মাস স্থায়ী হয়েছিল গত বছরের বন্যা। ছিল করোনাও। দুই দুর্যোগ মিলে আমরা দেখেছি, গেল বন্যার সময় কত দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে মানুষকে। এসব চিন্তা করেই এবার বন্যা মোকাবিলার পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া দরকার।
Advertisement
গত বছর বন্যা যখন দীর্ঘায়িত হচ্ছিল তখন নানা কথা উঠে আসে। বন্যার এই সময়কাল বৃদ্ধির জন্য নদীর মধ্যে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণকে অনেকে দায়ী করেন তখনক বাংলাদেশের নদীগুলোতে ৭ হাজার ৫৫৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। এগুলোতে ৭ হাজার ৯০৭টি পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে অনেক নিষ্কাশন নালা। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে হলে নদীগুলোকে নিয়মিত খনন করতে হবে। উজানের দেশ ভারতের সঙ্গে যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।
বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থার আরও উন্নতি ও আধুনিকায়ন করতে হবে। এজন্য আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, আবহাওয়া অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, কৃষি গবেষণা ইনস্টিউট এগুলোর সমন্বয়ে একটি কার্যকর সেল গঠন করতে হবে। আমরা জানি, সমন্বয়ের অভাব, কাজের দীর্ঘসূত্রিতা যে কোনো সমস্যাকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। অথচ কার্যকর ভাবে সব পদক্ষেপ নিলে, বন্যার অনেক আগেই আমরা প্রস্তুতি নিতে পারি। আজকাল কয়েক দিন আগে সাবধানী বার্তা জানানো হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের বেশিরভাগ মানুষ সচেতন বা শিক্ষিতও নয়। তাছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থাও সবখানে সমান নয়। বার্তাটি ঠিকভাবে পৌঁছাতে সময় লাগে।
দুর্যোগের আগে পর্যাপ্ত সময় না পেলে দুর্গম এলাকার একজন কৃষক তার ধান নিরাপদ জায়গায় নিতে পারেন না, তার গরু-ছাগল নিরাপদে কোথাও রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। বন্যার পানি কমে যাবার সাথে সাথে যাতে রোগ ব্যাধি ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে রাখতে হবে। করোনা ও বন্যার সঙ্গে সহাবস্থান করে জীবন ধারণের কৌশল বের করা সবচেয়ে জরুরি এখন। আগামীতে বন্যা মোকাবিলায় নদী অববাহিকাগুলোতে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে আর জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব মাথায় রেখে আমাদের দেশে বন্যা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত না করে এসব উদ্যোগ নিলে তা একেবারেই সফল হবে না।
আমরা জানি, যে কোনো দুর্যোগেই মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়, আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে অগণিত মানুষ। আর অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসা একটি মহৎ কাজ। তাই দুর্যোগ মুহূর্তে প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী সাহায্যের হাত প্রসারিত করা। মানুষ মানুষের জন্য এই নীতি প্রয়োগের উৎকৃষ্ট সময় এই করোনাকাল, এই বন্যা।
লেখক : তরুণ কবি ও প্রাবন্ধিক।
এইচআর/এএসএম