করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় ১ জুলাই থেকে সিলেটসহ সারাদেশে কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করলেই জনসাধারণকে গুনতে হচ্ছে জরিমানা। অনেককে আবার কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছে।
Advertisement
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কঠোর অবস্থায় থাকায় শ্রমজীবী মানুষজনও এই কঠোর বিধিনিষেধ মেনে নিয়েছেন জীবন বাঁচানোর জন্য। কিন্তু সিলেটে এর ঠিক উল্টোটাও দেখা গেছে। একদল রাজনীতিবিদ এই বিধিনিষেধ মানছেন না বরং ভাঙার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন!
এ সময় যাতে সাধারণ মানুষ সরকারি নির্দেশনা মেনে চলেন এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সচেতন রাজনীতিবিদরা যেখানে সচেষ্ট থাকার কথা, সেখানে তারাই বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুরু, গণজমায়েত, কৌশলী নির্বাচনী প্রচারণা, মিলাদ মাহফিল এবং ওরসে বিশাল বহর নিয়ে অংশ নিচ্ছেন।
এরপর আবার তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজেদের অ্যাকাউন্টে মাস্ক ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার ছবি আপ দিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। ফলে সচেতন নাগরিক সমাজের মধ্যে এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
Advertisement
শুক্রবার (২ জুলাই) বিকেলে লকডাউন নির্দেশনা ভেঙে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মোমিনখলা এলাকায় থেকে সীমিত পরিসরে চার-পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ে করতে যান। বিয়ে শেষে কনে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে ফিরছিলেন বর। এ কারণে নগরের হুমায়ুন রশীদ চত্বর এলাকায় সড়কে তাদের গাড়ি আটকিয়ে পুলিশ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় বর-কনেকে।
এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে শুক্রবার দুপুরে ফেসবুকে কয়েকটি বিয়ের ছবি আপ করেন সিলেট সিটি করপোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা ইলিয়াসুর রহমান ইলিয়াস। ছবিগুলোর ক্যাপশনে লিখেন ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে’।
বিধিনিষেধ কার্যকরের প্রথম দিন ১ জুলাই দুপুরে ও রাতে কাউন্সিলর ইলিয়াসের ওয়ার্ডে এই বিয়েগুলো সম্পন্ন হয় বলে জানা গেছে। আয়োজিত এসব বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কাউন্সিলর ইলিয়াসসহ ৩০ থেকে ৪০ জন নেতাকর্মী।
সবগুলো বিয়েতে বর-কনেসহ অতিথিদের সঙ্গে ছবিও ওঠান তিনি। নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে দেয়া এসব ছবিতে দেখা গেছে কাউন্সিলর ইলিয়াসসহ কারোরই মুখে মাস্ক নেই।
Advertisement
এদিকে, বৃহস্পতিবার রাতে নিজের ফেসবুকে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাবেক সিটি কাউন্সিলর জগদীশ চন্দ্র দাস কয়েকটি বিয়ের ছবি জুড়ে দিয়ে লিখেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে আখালিয়া ভট্টপাড়া জিষুপদ পালের ছোট ছেলের বিয়েতে ও নোয়াপাড়ার বাবুল ঘোষের মেয়ের বিয়েতে আমরা নিমন্ত্রণে অংশ গ্রহণ করলাম।’
ওই ছবিতে দেখা গেছে বরসহ ১২জন ব্যক্তি একে অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের কারো মুখে মাস্ক নেই।
এছাড়া যুবলীগের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের জন্মদিন উপলক্ষে শুক্রবার দুপুরে হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে সিলেট মহানগর যুবলীগ।
মহানগর যুবলীগের পক্ষ থেকে প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে সিলেট মহানগর যুবলীগের সভাপতি আলম খান মুক্তি, সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদার ছাড়াও সিলেট মহানগর যুবলীগ ও ২৭টি ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে, কঠোর বিধিনিষেধ শুরুর প্রথম দিন বৃহস্পতিবার ছিল হজরত শাহজলাল (রহ.) এর ৭০২তম ওরস শরিফ। করোনা সংক্রমণ বাড়ার কারণে আগেই ওরসের সকল আনুষ্ঠানিকতা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল মাজার কর্তৃপক্ষ।
তবে বিধিনিষেধের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বৃহস্পতিবার প্রায় অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজারের ওরসে উপস্থিত হন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী। মাজারে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে গিলাফ দেন তিনি।
ওরসে নেতাকর্মী নিয়ে হাজির হওয়া ও গিলাফ ছড়ানোর কিছু ছবি ওইদিনই নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন শফিক চৌধুরী। ছবির সঙ্গে ক্যাপশনে লেখেন, ‘হজরত শাহ জালাল (রহ.) ৭০২তম পবিত্র ওরস শরিফ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার পক্ষে মাজারে গিলাফ ছড়াচ্ছি....কবির উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ এপতেয়ার হোসেন পিয়ার, আলম খান মুক্তি, শেখ জালাল ফরিদ উদ্দিন, কবিরুল ইসলাম কবির, হোসিয়ার আলমসহ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে..।’
রাজনৈতিক নেতাদের এমন কাণ্ডে ক্ষোভ জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক নেতাদের বিধিনিষেধ ভাঙার প্রতিযোগিতা দেখে হতবাক-ক্ষুব্ধ। এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলব এর মাধ্যমে সরকারি দলের এই নেতারা সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। তাদের কারণে অন্যরাও আইন ভাঙতে উৎসাহিত হবেন। অথচ এরাই বিধিনিষেধ মানার জন্য সাধারণ নাগরিকদের বুঝানোর কথা ছিল।’
সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। দলটির নেতাদের উচিত ছিল সিলেটের মানুষকে করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষায় জনসাধারণকে সরকারি বিধিনিষেধ মানতে বুঝিয়ে বাধ্য করা। অথচ তারাই মাস্ক ছাড়া বিয়েসহ নাানা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নগরবাসীকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন। যা নিন্দনীয় ও দুঃখজনক।’
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিধিনিষেধের মধ্যে মিলাদ মাহফিল আয়োজন করা প্রসঙ্গে সিলেট মহানগর যুবলীগের সভাপতি আলম খান মুক্তি বলেন, ‘বিধিনিষেধ ঠিক আছে। আমরা অল্প মানুষ দরগায় দোয়া করেছি। এরপরে বাইরে গরীব, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের মাঝে আমরা আম ও মাস্ক বিতরণ করেছি। মূলত গরীব মানুষকে সাহায্য করতেই উদ্যোগ নেয়া হয়।’
কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও ওরসের গিলাফ নিয়ে দলবলসহ মাজারে যাওয়ার প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি শফিুকর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘দরগায় গিলাফ তারা (দরগাহ কর্তৃপক্ষ) দিয়েছে। আমরাও একটা গিলাপ দিয়েছি রাতে। তবে না দেয়াটা ভালো ছিল। আসলে ভুলই হয়ে গেছে। খেয়াল করি নাই।’
আগামী ২৮ জুলাই সিলেট-৩ আসনে উপ-নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে। লকডাউন চলাকালে সব ধরনের প্রচারণা বন্ধ রাখতে সদস্য পদপ্রার্থীদের নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এই আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী যুক্তরাজ্য প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব। গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুদিনই নিজের নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন মসজিদে ও এলাকায় যান হাবিব। নামাজ আদায় শেষে তিনি মসজিদে আসা মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। তাদের উদ্দেশে বক্তব্যও দেন। নেতাকর্মী নিয়ে মাজারও জিয়ারত করেন। এসব অনুষ্ঠানের ছবি গণমাধ্যমের মেইলে পাঠানো হয়েছে গত দুদিন আগে। তবে এসব কর্মসূচিতে নূন্যতম লকডাউনের বিধিনিষেধ মানা হয়নি।
বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজ নির্বাচনী এলাকা দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি এলাকায় যান হাবিবুর রহমান হাবিব। সন্ধ্যায় বরইকান্দি ইউনিয়নের রায়েরগ্রাম জামে মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। এ সময় মসজিদে জড়ো হওয়া মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন হাবিব।
রাতে নিজের ফেসবুকে কুশল বিনিময়ের একাধিক ছবি পোস্ট করেন তিনি। এতে দেখা যায়, হাবিবসহ উপস্থিত প্রায় কারোরই মুখে মাস্ক নেই।
এরপর শুক্রবার ফেঞ্চুগঞ্জের রাজনপুর জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন হাবিব। ওইদিনও নামাজ শেষে তিনি মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এরপর তিনি নেতাকর্মীদের নিয়ে হজরত ইসহাক আলী শাহ (রহ.) ও হজরত শাহ সৈয়দ আলী (রহ.), হজরত গোলাপ শাহ (রহ.) মাজার জিয়ারত করেন।
বৃহস্পতিবার রায়েরগ্রাম জামে মসজিদে উপস্থিত থাকা একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, মসজিদে নামাজ শেষে ৫০ জন লোক হাবিবকে ঘিরে ধরেন। তারা সামাজিক দূরত্ব না মেনেই জড়ো হন এবং করমর্দন করেন। এদের বেশিরভাগের মুখেই মাস্ক ছিল না। এমনকি হাবিবের মাস্কও মুখের বদলে থুতনিতে লাগানো ছিল। এরপর উপস্থিত জনতার উদ্দেশে ভোট চেয়ে বক্তৃব্য দেন হাবিব।
রাতে হাবিবের ই-মেইল আইডি থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই মসজিদে জড়ো হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে এতে বলা হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন সিলেট-৩ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব।
উল্লেখ্য, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ১ জুলাই থেকে সারাদেশে ৭ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছে সরকার। বুধবার (৩০ জুন) জারি করা লকডাউনের প্রজ্ঞাপনে ২১ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়।
ছামির মাহমুদ/এসজে/এএসএম