মতামত

টিকা-টাকায় ডরায় করোনা?

বৈশ্বিক মহামারি করোনার ধকলেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে আবারো দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার সংসদে ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় এ দাবি করে তিনি বলেন, একদিকে সারা বিশ্ব করোনায় আক্রান্ত, আরেকদিকে আমাদের জন্য বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই কঠিন সময়েই জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতকরণ। এই ৩ গর্বের মাঝেই করোনার হানা।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রীর ৩ দাবিই সঠিক। আবার করোনার হানা নিয়েও কারো দ্বিমত নেই। বাজেট বক্তৃতায় তিনি গ্যারান্টি দিয়ে বলেছেন, যত টাকাই লাগুক করোনার যত টিকাই লাগুক তার সরকার সেটা সংগ্রহ করবে। বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেয়া হবে দেশের সকল নাগরিককে। করোনা এবং টিকার বাস্তবতা সবিস্তারে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। এরপরও সরকারের বা প্রধানমন্ত্রীর সাফল্যের দাবি অগ্রাহ্য করাই যায়। বলাই যায় সরকার পদে পদে ব্যর্থ। সরকারের ব্যর্থতার কারণেই করোনা এতো আগ্রাসী-এমন কথা বলতেও বারণ নেই। বিএনপি করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। ষড়যন্ত্র করে তারাই দেশে করোনা এনেছে- এমন মন্তব্যেও নিষেধাজ্ঞা নেই।

প্রশ্নটা অন্যখানে। সরকার, আওয়ামী লীগ, প্রশাসন, বিএনপিসহ রাজনীতিকরা বাদে যার যার জায়গায় আমরা কি করোনাকে রোখার চেষ্টা করছি? পাকাকথায় যতো পারঙ্গমতার সাক্ষর রাখছি, ভাইরাস দমনে বা নিজের সুরক্ষায় তার ছিটাফোটাও ভূমিকা আছে তো? সমালোচনা বা ট্রল করা ছাড়া কি আমাদের আর কাজ থাকতে নেই? আমজনতা, শিক্ষক, সাংবাদিক, শ্রমিক, সুশীল বুদ্ধিজীবী, ফেসবুক বা অনলাইন এক্টিভিস্ট। স্বাস্থ্যবিধি কে কদ্দূর মানছি? ভাবটা কি এমন নয়, করোনা আমাদের হবে না, আপনাদের হবে?

বলার অপেক্ষা রাখে না, নাগরিকদের সক্ষমতা সীমিত। সীমিত এই ক্ষমতার সম্মিলিত শক্তি অসীম হতে পারে না? পারছে তো। সম্মিলিতভাবে পরিবেশ নষ্ট করে করোনার বিস্তারে ভূমিকা কম রাখছি? জীবিকার সঙ্গে জীবনের সাযুজ্য মেলাতে গিয়ে বেপরোয়াপনায় কেউ পিছিয়ে থাকছে? রোজার ঈদের আগে ঈদ উপলক্ষে ছোটাছুটি না করে যে যেখানে আছেন সেখানেই ঈদ উদযাপন করতে সবাইকে আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রাসঙ্গিকতা ও বাস্তবতার চোখে আঙুল দিয়ে তিনি বলেছেন, করোনার সময় বেঁচে থাকলে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তো দেখা হবেই। এরপর আর কথা থাকে? প্রধানমন্ত্রীর কথা না শুনলে, না মানলে কী হয়? তারই বা কী আসে যায়? এছাড়া তার কথা কি শুনতেই হবে? শুনলেও মানা কি বাধ্যতামূলক? মোটেই না। এ অবস্থায় টিকা-টাকায় কি করোনা ভয় পাবে?

Advertisement

লকডাউন, শাটডাউন বা দূরপাল্লার বাস চলাচল না করলেই কী? কিসের পরোয়া? হেঁটে, ব্রিজ পেরিয়ে, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মিনি ট্রাক, সিএনজি, টগবগি, বডবডিতে দেশের নানা প্রান্তে এমন ছুটে চলা আরব্য উপন্যাসের কল্পিত গতিকে ব্যাকডেটেড করে দিয়েছে। ছুটে চলার এ হিরোইজম অ্যাম্বুলেন্সেও। ঘোরাফেরার এ ঢেউ করোনার ঢেউকে রুখতে পারলে তো কথাই ছিল না।

পুলিশ, প্রশাসন, সরকার কার কতটুকু সাধ্য এই ছুটে চলা রুখে দেয়ার? মহামারি করোনারই বা করার কী আছে। করোনা নির্দোষ-নিরপেক্ষ। যা করার নিরবচ্ছিন্নতায়ই করে। রাষ্ট্র বা তার পক্ষে নাগরিকদের অবিরাম বেত মেরে সিধা-সচেতন বানাতে পারে না। নাগরিকদেরও সভ্য হওয়ার ইচ্ছা থাকতে হয়। সুস্থ থাকা ও রাখার চর্চাও করতে হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলতে হয় হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার থাকতে। কোন তলানিতে জনসচেতনতা?

জীবনের বদলে জীবিকার সমস্যাটাকে বড় করে টিকা-টাকায় সুফল আশা করা বোকামির নামান্তর। পৃথিবীতে মহামারি আগেও এসেছে। বিদায়ও নিয়েছে। মানুষও থেমে থাকেনি। স্মরণ করতেই হয়- শত বছর পরপর বিশ্বে কোনো না কোনো মহামারি হানা দেয়। কিন্তু গত কয়েক শতকেও মানবজীবনের গতিতে এমন ধকল আর আসেনি। করোনায় ২০২০ সাল থেকে জীবন-জীবিকায় জেঁকে বসা এমন দুর্গতি ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু, ১৮২০ সালে কলেরা বা ১৭২০ সালে প্লেগের সময়ও হয়নি। এরপরও কৌশল আর পরিকল্পনায় এগিয়ে গেছে মানুষ। আর এবার? করোনাকে পরাস্ত করে ফেলেছি আমরা?

মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। কিন্তু সরকারের বাইরে কি কারো বোধবুদ্ধির ব্যাপার নেই? তাদের ভূমিকাও জরুরি। মিডিয়া, সমাজের সচেতন অগ্রসর শিক্ষিত মানুষ, সেলিব্রেটি, সামাজিক-ধর্মীয় নেতারা দেশে দেশে নিজ উদ্যোগে মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের এখানে সেই দিকটায় ভীষণ খরা।

Advertisement

হাসপাতালে সিট বা আইসিইউ থাকলেও কি বাঁচা নিশ্চিত হতো? পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেলে কী অবস্থা হবে সেটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া জরুরি নয়। কেন লকডাউন, কেন ঘরে থাকতে হবে- কেন বাইরে যাওয়া যাবে না- গত ক’দিনের আলামতেও বুঝতে না পারলে টিকা বা টাকায় কি হবে? মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। কিন্তু, সরকারের বাইরে কারও বোধবুদ্ধির ব্যাপার নেই?

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমকেএইচ