বিশেষ প্রতিবেদন

জীবনযুদ্ধেও জয়ী মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল

তখন ছাত্র ছিলাম। একাত্তরে উত্তাল সারা দেশ। একদিকে পাক হানাদারদের বাঙালি জাতির ওপর নির্মম অত্যাচার অন্যদিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহান স্বাধীনতার চূড়ান্ত যুদ্ধের ঘোষণা। পাকিস্তানের সেই নির্মম ও বীভৎস অত্যাচারের চরম প্রতিশোধ ও প্রতিরোধে যেমন ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে এ দেশের মানুষ, তেমনি মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য বিভোর মুক্তিপাগল বীর বাঙালি। সেই চরম মুহূর্ত কাউকে থামিয়ে রাখতে পারেনি, আমাকেও না। এছাড়া বসে থাকারও তো কোনো সুযোগ, মানসিকতা বা পরিবেশ ছিল না। তাই সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে। যুদ্ধে সহপাঠী অনেকে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে চরম আত্মতৃপ্ত করে তোলে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা এবং এ দেশের আপামর জনগণকে। আর সেই সব আত্মবিসর্জন দেয়া শহীদের প্রতি হৃদয়ের গভীরে তৈরি করে শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও মমত্ববোধ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শিহরিত অনুভূতি প্রকাশ করে কথাগুলোর বর্ণনা দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন চৌধুরী।ইকবাল হোসেন চৌধুরী বর্তমানে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রাঙামাটি জেলা ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার-১ এবং রাঙামাটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক। ২০১০ সালেও এ ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার-১ পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এরপর ২০১৪ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হন। তার আগে ২০০৮ সালে যুগ্ম-আহ্বায়ক এবং ২০০৯ সালে সংসদের জেলা ইউনিটের সদস্য সচিবের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। মৃত আবদুল মান্নান চৌধুরী ও সামসুন নাহার বেগমের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৪ সালের ১০ নভেম্বর বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জের নাজিরপুর এলাকায়। বর্তমানে স্ত্রী এবং এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন রাঙামাটি শহর এলাকায়। আলাপকালে তার ব্যক্তিগত কর্মময় জীবন উল্লেখ করলে দেখা যায়, এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কেবল মহান মুক্তিযুদ্ধে নয়, জীবনযুদ্ধেও জয়ী হয়েছেন অনেক চড়াই উতরাই পার করে।মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, যুদ্ধ শেষে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র জমা দেয়ার পর ফিরে যাই নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে। মহান সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় ও দেশবাসীর আর্শীবাদে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণে বেঁচে যাই। কিন্তু থেমে তো যায়নি নিজের জীবনযুদ্ধ। তাই মুক্তিযুদ্ধ শেষে নতুন করে গড়ে তুলি জীবনযুদ্ধ। জড়িয়ে পড়ি ব্যবসা-বাণিজ্যে। সেই পথ ধরে ঠিকাদারি ব্যবসায় ১৯৮৯ সালে চলে আসি রাঙামাটি শহরে। ব্যক্তিগত জীবনে বেশি কিছু অর্জন করতে না পারলেও বৌ-বাচ্চাদের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে পেরেছি। পরিবারের ভরণ-পোষণে তেমন একটা অভাব অনটনও দেখা দেয়নি। এখন ছেলেমেয়েদের মানুষ করার চেষ্টায় আছি। এ পর্যন্ত কারও কাছে হাত পাততে হয়নি। এটাও কিন্তু মহান আল্লাহ-তালার অসীম করুণা। যুদ্ধের পর দীর্ঘ বিয়ালিশটি বছর পর্যন্ত সরকারের কোনো সহায়তাও পাইনি। বর্তমান সরকারের বিবেচনায় অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ২০১৩ সাল থেকে সরকারি সম্মানী ভাতা পাচ্ছি। ভাতা যাই হোক না কেন তা নিয়ে যথাযথ সম্মানে আমি গর্বিত। তবে সরকারের কাছে আমার বিনীত আবেদন অসহায় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে সরকার যাতে উদারতার হাত বাড়ায়। কারণ স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধারা এখনও দৈন্যদশায়। বিশেষ করে রাঙামাটির মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারবর্গের অবস্থা খুবই খারাপ। এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশ পরিবার অস্বচ্ছল। তিনি রাঙামাটির মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের আবাসন প্রকল্পে পুনর্বাসনে সবাইকে প্রকল্পভূক্ত করার দাবি জানান।ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম এ দেশ থেকে পাক হানাদারদের বিতাড়িত করে দেশকে স্বাধীন এবং এ দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য। এক্ষেত্রে প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ দেশ ও জাতির প্রেমে আমি আত্মতৃপ্ত। তাই যুদ্ধে অংশ নেয়ার বদলে চাওয়া পাওয়া নিয়ে আমার কোনো আফসোস, অনুশোষণা বা তেমন কোনো আকুতি মিনতি নেই। তবে দেশ রক্ষা ও দেশের কল্যাণে আমার আপ্রাণ প্রচেষ্টাও থেমে নেই।মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রাঙামাটি জেলা ইউনিটের নির্বাচিত এই ডেপুটি কমান্ডার-১ ইকবাল হোসেন চৌধুরী মনে করেন, আজ থেকে ৪৪ বছর আগে এ দেশ স্বাধীন হলেও ঘাতকদের ষড়যন্ত্র এখনও নির্মূল হয়নি। ফলে দেশের মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতাকে ভোগ করতে পারছে না। দেশের জনগণ এখনও ঘাতকদের নানামুখি ষড়যন্ত্রের জালে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাই ঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য চলমান লড়াই-সংগ্রামে একযোগে এগিয়ে যেতে হবে দেশবাসী সবাইকে। আমরা সফল হবো। সেই দৃঢ় মনোবল ও সাহস-শক্তি নিয়ে অগ্রসর হতে হবে আরও। চলমান লড়াইয়ের অংশে ইতোমধ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পথে। ঘাতকদের সব ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটনে প্রবল প্রতিরোধ চলছে। সফল করতে সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে আরও অধিকতর শক্তিশালী করতে হবে।মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন চৌধুরী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধীন নোয়াখালীর মাইজদি সি জোনের আওতায়। পেশাগত কারণে স্থায়ীভাবে রাঙামাটিতে বসবাস করছেন দীর্ঘ প্রায় ২৬ বছর যাবত। একাত্তরের সেই রণ সংগ্রামের লোমহর্ষক ঘটনাগুলো আজও প্রচণ্ড আলোড়িত করে তোলে তাকে। ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, মুক্তিবাহিনীর নোয়াখালীর সি জোনের কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। ওই অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করে মূলত তিনটি গ্রুপ ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর। আমি ছিলাম ১৯ নম্বর গ্রুপে। সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম ভারতের ত্রিপুরার মেলাঘর ট্রেনিং সেন্টারে। এপ্রিলে প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় ব্যাচে ছিল আমাদের ১৯ নম্বর গ্রুপটি। প্রশিক্ষণে অংশ নিতে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে ত্রিপুরা রাজানগর টিকিয়াটিলায় হোল্ডিং ক্যাম্প গড়ে তুলি। ক্যাম্পটির দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর পক্ষে এমপি প্রফেসর হানিফ এবং ভারতের পক্ষে সহায়তা করেন ক্যাপ্টেন আর কে সিং। ১ মাস ৭ দিনের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সেখান থেকে গিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিই নোয়াখালীর সি জোনের অধীন।   রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, রণকাঁপা যুদ্ধের তিনটি ঘটনা আমার হৃদয়ে সব সময় আলোড়ন সৃষ্টি করে। চূড়ান্ত বিজয়ের প্রায় ২-৩ মাস আগে নোয়াখালীর রাজগঞ্জে তুমুল লড়াই হয়। ওই যুদ্ধ ভোর রাতের দিকে শুরু হয়ে চলে দুপুর প্রায় ১২টা পর্যন্ত। সেখানে চারদিক থেকে ঘেরাও করে আমাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজকার বাহিনী। তখন নিজেদের রক্ষায় প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলি আমরা। গ্রুপে ছিলাম আমরা ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা। গ্রুপটির কমান্ডার ছিলেন শাহ আলম। আর আমি ছিলাম গ্রুপটির দ্বিতীয় কমান্ডারের দায়িত্বে। সেই দিন আমাদের তুমুল প্রতিরোধের মুখে শেষ পর্যায়ে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে আমরাও সরে যেতে সক্ষম হই। কিন্তু আমাদের ডিফেন্সের সহযোদ্ধা আবুল হোসেন যুদ্ধে মারা যান। এছাড়া আমাদের গ্রুপের রবি ও সবুজ নামে আরও দুই সহযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদাররা। পরে তাদের মেরে ফেলে গণকবর দেয় শত্রুবাহিনী। তারাও শহীদের তালিকায় আছেন। এর প্রায় একমাস পর আরেক ঘটনায় তুমুল যুদ্ধ চলে পাকবাহিনীর সঙ্গে। সেটি সংঘটিত হয় বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরের উদারহাট বাজারে। ভোরে যুদ্ধ শুরু হয়ে চলে রাত প্রায় ৮টা পর্যন্ত। সেখানে অবস্থানরত পাকবাহিনীর একটি ঘাঁটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে আমরা আক্রমণ করি। এতে উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াইয়ের এক পর্যায়ে আমাদের সঙ্গে টিকতে না পেরে পাকবাহিনীর দোসর তিন সাবেক সেনা সদস্যসহ ৩০ জন রাজাকারকে আমরা জীবিত ধরতে সক্ষম হই। পরে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে তারা।সর্বশেষ ঘটনা বিজয়ের একদম চূড়ান্ত মুহূর্তে। ওই ঘটনায় বৃহত্তর যুদ্ধ সংঘটিত হয় নোয়াখালী শহরের মাইজদি পিটিআই এলাকায়। তখন আমরা শহর দখলের জন্য যুদ্ধে লিপ্ত। ওই যুদ্ধ চলে টানা প্রায় দুই দিন। গুলগুলা বাজার হয়ে সোনাপুর প্রধান সড়ক মুক্ত করতে করতে দখল করি রায়েরহাট। সেখান থেকে দুই রাজাকারকে ধরা হয়। বুলবুল সিনেমা হলের সামনে আমাদের আক্রমণে ওই দুই রাজাকার মারা যায়। প্রথম দিন সন্ধ্যার দিকে পর্যায়ক্রমে পাকিস্তানি বাহিনীর পিটিআই ভোকেশনাল ক্যাম্প আক্রমণ করি। পিটিআই দখলে নিয়ে তুমুল যুদ্ধ চালায়। পরদিন ১১ বেঙ্গলের জিয়া গ্রুপ এলএমজিসহ ভারী ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকবাহিনীর পিটিআই ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ করে। এতে টিকতে না পেরে অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকবাহিনী। এর মধ্য দিয়েই মুক্ত হয় বৃহত্তর নোয়াখালী। পরে সেখানে ভোকেশনাল ক্যাম্পে কয়েকদিন অবস্থান নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যার্পণের পর ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দিই আমরা।এসএস/পিআর

Advertisement