‘প্রবাসে, দৈবের বশে, জীব-তারা যদি খসে এ দেহ-আকাশ হতে, নাহি খেদ তাহে।জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’ (বঙ্গভূমির প্রতি) বাল্য-কৈশোরে পড়া এমন অপূর্ব ছন্দে যে মুগ্ধতা জন্মেছিল, তা আজও অক্ষয় হয়ে আছে আমাদের স্মৃতিতে। ১৮৬০ সালের মে মাসে ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য প্রকাশিত হয়। এ কাব্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত নব্যপ্রবর্তিত (পাশ্চাত্যের ব্লাংকভার্স অবলম্বনে) অমিত্রাক্ষর ছন্দের সফল প্রয়োগ করেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দান করেছে। ভাষায়, ভাবে, ছন্দে, শিল্পরীতিতে গ্রন্থটি এখন ইতিহাস। ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ প্রকাশের পর কার্যত ভারতচন্দ্রীয় যুগের অবসান ঘটে; আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। ভাষারীতিতে বিপ্লব করেই মূলত বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূচনা হয় এবং তা মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরেই।
Advertisement
মহাকবি মধুসূদন দত্ত মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে সম্মান জানিয়ে তার নামেই ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। এ কাব্য বাংলা পয়ারের গতানুগতিক ভঙ্গির বিরুদ্ধে কাব্যিক প্রতিবাদ। প্রচলিত ছন্দ ও ভাষারীতি ভেঙে কী দারুণ প্রয়োগ! অমিত্রাক্ষর ছন্দ ধরা দিলো বাংলা সাহিত্যে: ‘ধবল নামেতে গিরি হিমাদ্রির শিরে—অভ্রভেদী, দেব-আত্মা, ভীষণদর্শন;সতত ধবলাকৃতি, অচল অটল;যেন উর্ধ্ববাহু, সদ্য, শুভ্রবেশধারী,নিমগ্ন তপঃসাগরে ব্যোমকেশ শূলী—যোগীকুলধ্যেয় যোগী। নিকুঞ্জ, কানন,তরুরাজি, লতাবলী, মুকুল, কুসুম—’(প্রথমসর্গ, তিলোত্তমাসম্ভব)
অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতার পঙক্তির সাথে পঙক্তির শেষাক্ষর বা উচ্চারণগত ধ্বনির বিন্যাসের সাদৃশ্যতা থাকে না। প্রতিটি পঙক্তি স্বাধীনভাবে বর্ণিত হলেও সমগ্র পঙক্তি মিলে একটি সামগ্রিক ভাব প্রকাশ হয়। ভাব প্রকাশে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত দারুণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের অংশবিশেষ: ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদেজানিনু কেমনে আসি লক্ষণ পশিলরক্ষঃপুরে, হায়, তাত, উচিত কি তবএ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ? শূলী শম্ভুনিভকুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ীনিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?’
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি, নাট্যকার ও প্রহসন রচয়িতা। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও তিনি পরিচিত। ভাষারীতির ভাঙা-গড়ার সাহসী কাজ করা অর্থে বিদ্রোহী তিনি। মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি, প্রথম সার্থক নাট্যকার। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার পথ নির্মাতা। মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। ১৮৫৯ সালে তিনি রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক; একটি পৌরাণিক নাটক। পাশ্চাত্য শৈলীতে রচিত এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। মধুসূদন পরে ‘শর্মিষ্ঠা’র ইংরেজি অনুবাদ করেন। এ নাটক রচনায় পুরাণের কাহিনি অবলম্বন করা হয়েছে।
Advertisement
১৮৬০ সালে রচনা করেন দুটি প্রহসন: ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং পূর্ণাঙ্গ পদ্মাবতী নাটক। এরপর রচনা করেন ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য (১৮৬১) নামের মহাকাব্য, ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬১), ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬২), ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ (১৮৬৬)। ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০) নাটকে তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের দুর্নিবার আকর্ষণে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন আকৃষ্ট হন নিজের মাতৃভাষার প্রতি। এ সময়েই তিনি বাংলায় নাটক, প্রহসন ও কাব্য রচনা করতে শুরু করেন। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য নামক মহাকাব্য। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী হলো ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’, ‘হেকটর বধ’ ইত্যাদি। মাইকেলের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয় এবং বেদনাঘন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যু হয় এ মহাকবির।
‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য রচনার পর তিনি বাংলা সাহিত্যের অমর মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যর গল্প নেওয়া হয়েছে রামায়ণ থেকে। রাম-রাবণের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে এ কাব্যে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে। রাম, লক্ষণ, সীতা, রাবণ, মেঘনাদ, প্রমীলা সবাই পৌরাণিক চরিত্র। এরা কেউই সমকালীন নারী-পুরুষ নন। ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যের মাধ্যমে তিনি তাদের সমকালীন করার প্রয়াস পেয়েছেন। মেঘনাদবধ কাব্য রচনা করেই তিনি ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। তৎকালীন যাপিত জীবনের বর্ণাঢ্যতায় এ মহাকাব্যে পাশ্চাত্য ভাবধারার স্রোত বয়ে গেছে। নয় সগের্র এ কাব্যের ট্রাজেডি সৃজন হয়েছে নায়ক রাবণ চরিত্রকে অবলম্বন করে।
কবি মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ মহাকাব্যে শয়তান যেমন দুর্জয় বাসনা ও ঋজুতা প্রদর্শন করে, মধুসূদনও রাবণকে দিয়ে সে কাজ করিয়েছেন। ভাব-ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে কবি বিদেশি ক্লাসিক রীতির প্রয়োগ করেছেন। কাব্যের বিভিন্ন সর্গে বীরত্ব, অভিমান, আক্ষেপ ইত্যাদি রস প্রকাশিত। এ কাব্যের ওজস্বীগুণ দারুণ। ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ (আগস্ট, ১৯৬৬) মাইকের মধুসূদন দত্ত রচিত ১০২টি সনেটের সংকলন। মধুসূদনের আগে বাংলা সনেট বা সনেটগ্রন্থ রচিত হয়নি। গ্রন্থের কবিতাগুলো প্রবাসে রচিত। সনেটগুলোর বেশিরভাগ শেক্সপিয়রীয় আদর্শে রচিত। কয়েকটি পেত্রার্কের রীতিতে। সনেটগুলোর বিষয়বস্তু বিচিত্র-ভারতীয় ও পাশ্চাত্য কবিদের উদ্দেশে বন্দনা, নদী-বৃক্ষ-পশু-পাখি, সুখ-দুঃখ। বঙ্গভাষা, কপোতাক্ষ নদ, আশা ইত্যাদি বিখ্যাত কবিতা এ গ্রন্থভুক্ত। সনেটগুলোয় মিত্রাক্ষর ও অমিত্রাক্ষর উভয় ছন্দের প্রয়োগ করা হয়েছে।
মাইকের মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনেক প্রথমের স্রষ্টা। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী সাহিত্যিক। প্রথম আধুনিক কবি ও নাট্যকার। অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন তিনিই করেছেন। বাংলা সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার প্রথম রচয়িতা; প্রথম সার্থক ট্রাজেডি ও প্রহসন রচয়িতা। পুরাণ কাহিনির ব্যত্যয় ঘটিয়ে আধুনিক সাহিত্যরস সৃষ্টির প্রথম শিল্পী। বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক মহাকাব্য রচনা তিনিই করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যধারার সংমিশ্রণে নতুন ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি তিনিই করেছেন; এবং সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায়ই। এ মহাকবির মহাপ্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
Advertisement
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
এসইউ/জিকেএস