মতামত

বন্ধু ও সহকর্মী মোহসীন চৌধুরীকে যেমন দেখেছি

ড. মো. বিল্লাল হোসেন

Advertisement

কোভিড-১৯ দুঃস্বপ্নের মত পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছে যা কেউ কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। প্রথম দিকে মনে হয়েছিল অন্যান্য দূরারোগ্য ব্যাধির মত করোনাও আশে-পাশের কোন দেশ অথবা মানুষকে আক্রান্ত করে চলে যাবে। কিন্তু তা পৃথিবীকে এভাবে অস্থির ও স্থবির করে রাখবে এ যেন এখনও অবিশ্বাস্য। কত কাছের মানুষ, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু- বান্ধব, অগ্রজ-অনুজ সহকর্মী মাত্র কয়েক দিনের নোটিশে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, শেষ মুহূর্তে তাদেরকে কাছে থেকে দেখারও কোন সুযোগ হয়নি অথবা সাহস হয়নি। তেমনি একজন আমার বন্ধু ও সহকর্মী পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী যিনি এত দ্রুত পৃথিবী থেকে চলে গেছেন, যা মনে নিতে কষ্ট হয়।

বন্ধু অনেকেই থাকে। কিন্তু তার মাঝেও এমন কিছু বন্ধুর সৃষ্টি হয়ে যায়, যারা হৃদয়ের মানসপটে স্থায়ী আসন করে নেয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠি, কর্মজীবনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বিশাল হৃদয়ের অধিকারি স্বল্পভাষী আব্দুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী অত্যন্ত কম কথা বলতেন। কিন্তু তাঁর সহপাঠী ও সহকর্মীদের প্রতি ছিল অত্যন্ত দরদ। যা আমি আমার ছাত্রজীবনে এবং কর্মজীবনে তাঁর মধ্যে দেখেছি।

আব্দুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয়করা গ্রামের এক সনামধন্য মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন আদমজী জুট মিলের চীফ লেবার এন্ড ওয়েলফেয়ার অফিসার। তাঁর প্রতিটি ভাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে দেশে ও বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গুণাবলী এ সল্প পরিসরে বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। শুধু আমার স্মৃতির ভাণ্ডারে সংরক্ষিত কয়েকটি বিষয়ের এখানে উল্লেখ করার ক্ষুদ্র প্রয়াস নিলাম।

Advertisement

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে অধ্যায়নকালে আমি শহীদুল্লাহ হলের এবং মোহসীন পাশাপাশি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। স্বভাবসুলভ স্বল্পভাষী হলেও অত্যন্ত শান্তশিষ্ট, নম্রভাবাপন্ন মোহসীন সহপাঠীদের সাথে দেখা হলেই কুশল বিনিময়সহ বন্ধুদের উপকারে নিরবে নিবৃত্তে উজাড় করে দিতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ভর্তি হই ১৯৭৯-৮০ সেশনে। দীর্ঘ প্রায় ৫/৬ বছর আমাদের একসাথে পথচলা। তাঁকে কোন বন্ধুর সাথে রাগ করে কথা বলতে দেখেছি আমার মনে পড়েনা। বরং দেখেছি সহপাঠীদের সাথে যে কোন দুঃসময়ে আলোকবর্তিকা হয়ে স্বমহিমায় সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করতে।

কর্মজীবনেও ১৯৮৮ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা একই দিনে যোগদান করি। কর্মকালীন তাঁর সাথে আমার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে একসাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তিনি তখন ঐ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। পরবর্তীতে ঐ মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলে যান এবং কোভিডে আক্রান্ত অবস্থায় হাসপাতাল থাকাকালীন সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্যু সিনিয়র সচিব হিসেবে অফিসে বসার আর সুযোগ হয়নি।

মোহসীন এর অধীনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কাজ করলেও তিনি কোনদিন বন্ধুত্বের বন্ধন থেকে আমাকে বঞ্চিত করেননি। প্রকাশ্য না হলেও অপ্রকাশিত অবস্থায় আমি তা বিভিন্ন সময় আঁচ করতে পেরেছি। যার ফলে মন্ত্রণালয়ে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আরেকটি বিশেষ গুন ছিল কোন অমিমাংসিত বিষয় তাঁর নিকট আসলে তা গভীরভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজে যেমন জড়িত হতেন তেমনি সহকর্মীদেরকেও সেভাবে নির্দেশনা দিয়ে বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করতেন।

আমি আগেই বলেছি মোহসীন স্বল্পভাষী হলেও অনুজ সহকর্মীদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল অসাধারণ। আমি প্রশাসন অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকায় খুব কাছ থেকে দেখেছি অনুজ সহকর্মীদের বিভিন্ন সুবিধা অসুবিধা তিনি অত্যন্ত দরদ দিয়ে অনুভব করতেন এবং সমাধানের চেষ্টা করতেন। অনুজ সহকর্মীরা যাতে যথাসময়ে পদোন্নতি পান সে বিষয়ে সব সময় সজাগ ছিলেন। কর্মকর্তা ও স্টাফদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুবিভাগ, অধিশাখা বা শাখায় পদায়নের ক্ষেত্রে অনেক কিছু বিচার বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নিতেন। এর ফলে অফিসে সুন্দর চেইন অব কমান্ড সৃষ্টি হতো। অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করাও সহজ হতো।

Advertisement

অফিসে কোন ধরণের লজিস্টিক সাপোর্টের সাময়িক সমস্যা হলে বিষয়টি সমাধানের জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতেন। এর জন্য কখনও কাউকে দায়ী করে কোন মন্তব্য করতে তাঁকে দেখিনি। এমনকি কাউকে ধমকের স্বরে বলেননি কেন হয়নি। অধিকাংশই বিকাল পৌনে ৫টার মধ্যে অফিস ত্যাগ করলেও তিনি ফাইল শেষ না হওয়া পর্যন্ত অফিস ত্যাগ করতেন না একেবারে জরুরি প্রয়োজন না হলে অন্যান্য অফিসার ও স্টাফদের খুঁজতেন না। সভার কর্মপত্র বা নথিতে কোন ভুল বা সঠিক প্রতীয়মান না হলে এর জন্য তেমন কোন মন্তব্য করতেন না বা রাগ হতেন না। তিনি স্বভাবসুলভ মিষ্ট ভাষায়, কোমল স্বরে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। জুনিয়র সহকর্মীদেরকে কখনও বকা দিতেন না। কোন কিছুতে ভুল হলে বলতেন বিষয়টি ভালোভাবে দেখা হয়নি। এটাই ছিল তাঁর সর্বোচ্চ বকা। তাঁকে কখনও সহকর্মীদের সাথে রাগ করতে দেখিনি।

সভাকক্ষে সিনিয়র, জুনিয়র কর্মকর্তাগণের প্রটোকল অনুযায়ী বসার বিষয়টিও তিনি নজরে রাখতেন, কোন ব্যত্যয় হলে কৌশলে তিনি তা স্মরণ করিয়ে দিতেন যাতে কেউ মনঃকষ্ট না পায়।

মোহসীন ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বদলি হয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যায়। একদিন হঠাৎ শুনলাম সে কোভিড আক্রান্ত হয়ে ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি হয়েছে। সে সময় দিনগুলো ছিল অত্যন্ত আতঙ্ক আর অস্থিরতায় ভরা। হাসপাতালে প্রায়ই টেলিফোন করে খোঁজ নিতাম। এর মধ্যেই কিছুদিন পর খবর পেলাম সে অনেকটা সুস্থ হয়েছে। তাঁর অল্প কয়েকদিন পরই সেই দুঃসংবাদ পেলাম মোহসীন আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মানুষ পৃথিবীতে আসে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য। সবাইকেই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। কেউ আগে কেউ পরে। কিন্তু থেকে যায় তার কর্মফল ও সুখকর স্মৃতি। মোহসীন আমাদের সাথে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর সুখকর স্মৃতি ও অসাধারণ কর্মকাণ্ড। এ থেকে আমাদের অনেক শিখার আছে।

মোহসীন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর টেলিফোনে যোগাযোগ করলে মনে হতো তুমি আমাদেরকেই সাহস দিতে। তুমি বলতে আগের চেয়ে ভালো আছো। আমরাও আশাবাদী ছিলাম তুমি আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। কিন্তু আসলে না। তুমি না ফেরার দেশে চলে গেলে। পরোপারে ভালো থেকো মোহসীন। মহান রাব্বুল আলামিন আমার এই সৎ,পরোপকারী ও কর্মবীর বন্ধুর সকল গুনাহ মাফ করে জান্নাত নসিব করুন।

লেখক : অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল), পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।

এইচআর/এমকেএইচ