দেশজুড়ে

আজ বরিশাল হানাদার মুক্ত দিবস

আজ ৮ ডিসেম্বর। বরিশাল হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বরিশালের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই আর মুক্তিকামী জনগণের  প্রতিরোধের মুখে পতন হয় পাকবাহিনীর। এর একদিন আগে ৭ ডিসেম্বর সীমান্তে মিত্রবাহিনী আক্রমণ শুরু করার পর সন্ধ্যা থেকেই পাক সেনারা বরিশাল ত্যাগের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বরিশাল শহরমুখী সড়ক পথগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় নৌযানে করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, পাক মিলিশিয়াসহ দালাল ও রাজাকাররা বরিশাল ত্যাগ করে। পাক বাহিনীর শহর ত্যাগের খবরে ৮ মাস অবরুদ্ধ থাকা মুক্তিকামী মানুষ বিজয়ের আনন্দে স্লোগান দিয়ে দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে। বেলা ১১টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুলতান মাস্টারের কাছে রাজাকার ও আলবদররা আত্মসমর্পণ করে। পাকবাহিনীর পতনের পর এ এলাকার সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে মুক্তির উল্লাস। আনন্দ উদ্বেলিত কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি।  তবে এ দিনটি পেতে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাসহ হাজারো মুক্তিকামী মানুষকে। সম্ভ্রম হারাতে হয় অনেক মা-বোনদের।১৯৭১ এর ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকার রাজারবাগে বর্বর পাক বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের খবর পওয়ার পর এই এলাকার মুক্তিকামী মানুষ সংগঠিত হতে শুরু করেন। অন্যদিকে, বাংলাদশেরে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরচিলনায় অস্থায়ী বাংলাদশে সরকারের পক্ষ থকে যুদ্ধ পরচিালনার জন্য দেশের সমগ্র ভূখণ্ডকে ১১টি যুদ্ধক্ষেত্রে বা সেক্টরে ভাগ করা হয়। ৯ নং সেক্টরের আওতাধীন ছিল বরিশাল । বরিশাল শত্রুকবলিত হওয়ার আগেই সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়। এ সচিবালয় থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে ভারতে প্রশিক্ষণে পাঠানো হতো। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়, ১৮ এপ্রিল প্রথম পাকবাহিনী আকাশপথে বরিশালে হামলা চালায়। এর ৮ দিন পর ২৫ এপ্রিল বরিশালে প্রবেশ করে পাক সেনারা। তারা একযোগে আকাশপথে বিমানে প্যারাট্রুপার নামিয়ে, নৌপথে গানবোটে ও সড়কপথে সাজোয়া যান নিয়ে বরিশালে ঢুকে পড়ে। এ সময় গৌরনদীর কটকস্থলে মুক্তিযোদ্ধাদের বাধার মুখে পড়ে পাক সেনারা। এখানে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে গুলি বিনিময় ঘটে মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রথম সম্মুখযুদ্ধে পাক আর্মির হাতে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাক হানাদার বাহিনী ভূরঘাটার ইল্লা গ্রামে ঢুকে পড়ে। তারা সেখানে একটি কালিপূজার অনুষ্ঠানে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। নিহত হন দু`জন পুরোহিত। এ সময় সেখানে এসে পাক সেনাদের ওপর আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। বেধে যায় দু`পক্ষের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ। পাকবাহিনীর ভারী মেশিনগানের গুলিতে সেখানে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, পয়সার হাটে সম্মুখযুুদ্ধে প্রায় ২০-৩০ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মে মাসের শুরুতে গৌরনদী থেকে পাকবাহিনীর একটি দল বরিশাল শহরে ঢুকতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে মারা পড়ে। ৩ মে মেদাকুল পাক সেনাদের ঘাঁটি থেকে ৪ সৈন্য পূর্ব নবগ্রামে ঢুকে সিদ্ধেশ্বর সরকারের বাড়িতে লুটপাট চালায়। গ্রামবাসী ধারালো অস্ত্র নিয়ে ওই ৪ সৈন্যকে মেরে ফেলে। ১৫ মে বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের বাকাই গ্রামের দোনেরকান্দি এলাকায় গাড়ি নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা উপস্থিত হয়। কবিন্দ্র কলেজের সামনে গাড়ি রেখে হিন্দু পাড়ায় প্রবেশ করতে গেলে জনতা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। মারা পড়ে ৭/৮ জন পাকিস্তানি সেনা। এর মধ্যে ৪ সেনা সদস্যের লাশ রেখে দেয় গ্রামবাসী। ওই দিন পালিয়ে জীবন বাঁচালেও প্রতিশোধের নেশায় মরিয়া হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সেনারা।পর দিন ১৬ মে এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় ১৭৫ থেকে ২শ’ পাকিস্তানি সেনা মাদারীপুর ক্যাম্প থেকে রওনা হয়। পথিমধ্যে গৌরনদীর টরকি বন্দরে এসে বাকাই গ্রামের কথা জিজ্ঞাসা করলে উত্তরদাতা সম্ভবত বুঝতে না পেরে বাকালের পথ দেখিয়ে দেয়। পাক সেনা আসার খবর পেয়ে টরকী, চাঁদশী, সমদ্দার পাড়, রামসিদ্ধি, বাঙিলা, ধূরিআইল, উত্তর সিঁহিপাশা, কোটালিপাড়া এলাকার শত শত নারী, পুরুষ আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের রাংতা গ্রামের কেতনার বিলে আশ্রয় নেন। দোসরদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কেতনার বিলের তিন দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। সেদিন কেতনার বিলে পাঁচ শতাধিক নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে।১৪ জুন রাতে হরিণহাটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে পিছু হটে পাকবাহিনী। কোটালীপাড়া থানায় আশ্রয় নিয়ে তারা রাজাকার-আলবদর ও পুলিশের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা গুলি বর্ষণ করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে এক পর্যায়ে পালানোর চেষ্টা করে তারা। খালের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু` শতাধিক পাক সেনা, রাজাকার-আলবদর ও পুলিশ। পরদিন খালে ভাসমান অবস্থায় তাদের ৫০টি মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল। বন্দী করা হয়েছিল শত্রুপক্ষের ১৮ জনকে। পরদিন পাক সেনারা লঞ্চ নিয়ে পয়সার হাটে পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চে গুলি চালায়। এতে পাকবাহিনীর ৬ সৈন্য নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। গৌরনদী, উজিরপুর, কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ থেকে ৪টি স্পিডবোটযোগে পাকসেনারা প্রতিশোধ নিতে কোদালধোয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পয়সারহাট থেকে ৮ মাইল দূরে সংঘটিত যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরাস্ত করে। এ যুদ্ধে ৯ পাক সেনা মারা যায়।স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক কমান্ডার এনায়েত হোসেন চৌধুরী বলেন, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ৭০-৮০ জনের একটি দল নদীবেষ্টিত হিজলা-মুলাদী উপজেলায় কৌশলগত আক্রমণ চালায়। এ সময় পাক মিলিশিয়া বাহিনীর ৩০-৪০ জনের একটি দল ভয়ের মুখে অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে।ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে  উজিরপুরের জয়শ্রী ব্রীজে পাক সাজোয়া যানের ওপর আক্রমণ চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। আক্রমণে ব্রিজটি ধংস হয়ে যায়। এই যুদ্ধে অন্তত দু’জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকবাহিনীরও আহত হয় কয়েকজন । তবে ব্রিজটি ধংসের ফলে বরিশালের সঙ্গে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পাকবাহিনী। এ কারণে ভারী সাজোয়া যান নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বরিশালে ঢুকতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়।  অক্টোবরের ৩য় সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ৬০ জনের একটি দল আক্রমণ চালিয়ে বাবুগঞ্জ থানা দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে পাকহানাদার বাহিনীর ২ সেনার মৃত্যু হয়। আহত হয় আরও কয়েকজন।রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা আ. রব সিকদার মিন্টু ৭১’র দিনগুলোর স্মৃতি থেকে জানান,  ৭১’জুনে আড়াই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল উজিরপুরে থানায় আক্রমণ চালায়। এই হামলায় বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির শিকার এবং ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পরে পাকবাহিনী।৭১’র মাঝামাঝি সময় বেইজ কমান্ডার সুলতান মাস্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় ৮০ জনের একটি দল বাবুগঞ্জের সাতমাইল সংলগ্ন এলাকায় পাক সেনাদের চলন্ত কয়েকটি সাজোয়া যানে আক্রমণ চালায়। এখানে ৮-১০ জন বা এর বেশি পাকসেনার মৃত্যু হয়। বেঁচে যাওয়া পাক সেনারা পালিয়ে রক্ষা পায়। তাদের ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয় এখান থেকে। উল্লেখ্য, অক্টোবরের শেষ দিক থেকে সারাদেশের ন্যায় বরিশালেরও মুক্তিযুদ্ধ আরও তীব্র হয়। বরিশালের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই আর মুক্তিকামী জনগণের  প্রতিরোধের মুখে ৮ ডিসেম্বর পতন হয় পাকবাহিনীর। ৯ মাসের দীর্ঘ সংগ্রামের অবসান হয়। পাকহানাদার মুক্ত হয় বরিশাল।সাইফ আমীন/এসএস/এমএস

Advertisement