বিশেষ প্রতিবেদন

সাধারণ মানুষ স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে উৎসাহিত নন

অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ। দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছেন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, কাঠামো, নির্বাচন এবং কার্যাবলি নিয়ে। জাতীয় নির্বাচন এবং রাজনীতিও পর্যবেক্ষণ করেছেন খুব কাছ থেকে। আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে চলমান আলোচনাকে অতিকথন বলে মত দিলেন তিনি। রাজনীতির সমস্যার সমাধানে এসব নির্বাচন গুরুত্বহীন বলেও উল্লেখ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।জাগো নিউজ : আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে উৎসবমুখর রাজনীতি। কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন পৌরসভা নির্বাচন?অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ : আমি এই নির্বাচনকে নিয়ে খুব আশাবাদী নই। এই মুহূর্তে পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে এত মাতামাতির কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় সমস্যা যেটি, তা দূর হবে না। রাজনীতির মূল সমস্যা ধামাচাপা দিতেই পৌর নির্বাচন নিয়ে মাতামাতি। আসল বিষয়টি ধামাচাপা দিতেই নির্বাচন নিয়ে এত কথা। পৌর নির্বাচনকে বড় ইস্যু বানিয়ে মিডিয়া মানুষকে খাওয়াচ্ছে মাত্র।  জাগো নিউজ : এই নির্বাচন শুধুই মিডিয়ার ইস্যু? তার মানে রাজনীতির ইস্যু গুরুত্ব পাচ্ছে না? অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ : যেকোনো ইস্যুতেই মানুষের আবেগ কাজ করে। কিন্তু আপনাকে তুলনা করে কথা বলতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিলেন, আর স্থানীয় নির্বাচনে আপনি ঢাক-ঢোল পেটালেন, এটি কোনো রাজনীতির ইস্যু হতে পারে না। এ দেশে নগর স্থানীয় সরকারের ইতিহাস দেড়শ’ বছরের। ১৯৬৪ সাল থেকে এ দেশে পৌরসভা গঠনের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকারের যাত্রা। ওই সময় এই প্রতিষ্ঠান ছিল মানবের সেবাকেন্দ্র। যারা এখানে প্রতিনিধিত্ব করতেন তারা মানুষের আবেগ-ভালোবাসা বুঝতেন। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি যে দায়িত্ববোধ, তা স্থানীয় সরকারের পূর্ব ইতিহাস থেকে উপলব্ধি করা যায়। এখন এমন দায়িত্ববোধের কথা ভাবাই অকল্পনীয়। পৌরসভার মানুষকে কী সেবা দিতে হবে তা প্রতিনিধিরাই জানেন না। রাজনৈতিক কারণে একটি পৌরসভা গঠন করা হয়েছে, কিন্তু একটি পৌরসভার যে কাঠামো, তার কোনোটিই নেই সেখানে। রাস্তা, বিদ্যুৎ, পানির নিরবিচ্ছিন্ন কোনো সংযোগ নেই। এখন পৌরসভা হচ্ছে গুটিকয়েক রাজনৈতিক ব্যক্তির পুনর্বাসন কেন্দ্র। জাগো নিউজ : হ্যাঁ, হতে পারে রাজনৈতিক কারণে প্রতিষ্ঠা। কিন্তু জনআবেদনও তো গুরুত্ব পায়? অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ : দেখুন সার্বিক অর্থে এখন শহর আর গ্রামকে বিভাজন করতে পারবেন না। গ্রামেও বহুতল ভবন হচ্ছে। গ্রামকে বাদ দিয়ে শুধু শহরকে নিয়ে আলাদা করে ভাববেন, তা হতে পারে না। উন্নয়ন প্রশ্নে গ্রাম এবং শহর এখন একীভূত। নগর বা গ্রাম ব্যবস্থাপনার কাঠামোর আদল পরিবর্তন করা দরকার। এই বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলছে না। নির্বাচন এসেছে, তাই নিয়ে মিডিয়া ও রাজনীতিকরা অস্থির। জাগো নিউজ : স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করতে হলে তো নির্বাচনও জরুরি? অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ : হ্যাঁ, জরুরি বটে এবং সেটা জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে। বর্তমানে সেই দাবি কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে, তা আপনাকে ভাবতে হবে। বর্তমানে এই নির্বাচন নিয়ে জনমনে কোনো আগ্রহ নেই। আগ্রহ মিডিয়ার। সাধারণ মানুষ স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে উৎসাহিত নয়। জাগো নিউজ : কেন এমনটি মনে করছেন? অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ : মানুষ ভোট কেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। রাজনীতি নিয়ে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত। কথিত গণতন্ত্রের প্রতি মানুষ ত্যক্ত, বিরক্ত। এসব পাতানো নির্বাচন মানুষের আবেগ স্পর্শ করছে না। এসব নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটছে না, এটি সবাই জানে। মানুষ এখন বোঝে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে প্রতিনিধি আসবে, তার সঙ্গে ওপরের নেতার যোগাযোগ থাকলেই চলবে। জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো দরকার নেই। শীর্ষ নেতা মনোনয়ন দিলেই পাস। জনগণের মতের আর কোনো তোয়াক্কা থাকছে না। এ দেশে সামাজিক বিষয়বস্তু বা রাজনীতি নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। সবাই কথাতে অভ্যস্ত। কথা বলতে পারলেই নেতা। জাগো নিউজ : এই পরিস্থিতির জন্য কোন বিষয়টিকে দায়ী করবেন? অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ : দেশে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামরিক সরকারের আমলে একবার বিরাজনীতিকরণ চলে। এখন রাজনৈতিক একটি দলের মধ্য দিয়ে বিরাজনীতিকরণ চলছে। রাজনীতিতে, মাঠে একটি মাত্র দল থাকবে। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে নির্বাচন দিতে হয়। কেন্দ্রে যে দল থাকবে, স্থানীয় পর্যায়েও সে দলই থাকবে। স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মন্দিরও সে দলের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। ঘাট-বাজারেও তারাই কর্তৃত্ব ধরে রাখবেন। এই প্রক্রিয়াই হচ্ছে বিরাজনীতিকীকরণ। জাগো নিউজ : এর ফলাফল কি হতে পারে? অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ : ফলাফল রাষ্ট্রের প্রতি সাধারণ মানুষের গভীর হতাশা, অনীহা প্রকাশ। ফলাফল ইতোমধ্যেই লক্ষণীয়। ফেনী পৌরসভায় ৪৮ ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৩টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে গেছেন। বিশেষ দলের বাইরে থেকে এসে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছেন না। আবার সাধারণ মানুষ একজন সৎ লোককে এনে নির্বাচন করাবেন, সে সাহসও নেই। ভয়ের কারণেই মানুষ রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে বসে আপনি কথার ফুলঝুরি ছিটিয়ে মানুষকে নির্বাচনে আকৃষ্ট করতে পারবেন না। আপনি বিগত কয়েকটি নির্বাচনের হালচাল লক্ষ্য করুন, দেখবেন মানুষ নির্বাচন থেকে কীভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আপনি হঠাৎ করে মানুষের এই ভাবধারার পরিবর্তন করতে পারবেন না। জাগো নিউজ : মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে বিশেষ আগ্রহ তো লক্ষ্যও করা যাচ্ছে বটে? অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ : কার আগ্রহ দেখছেন? যারা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিশেষ সুবিধা পায় তাদের মধ্যেই আগ্রহ কাজ করছে। গত সিটি নির্বাচনে আমি ভোট দিতে পারিনি। যোগ্য নেতৃত্ব মেলেনি। কাউন্সিলর খুঁজে পাইনি। মেয়র যারা হবেন তা আগে থেকেই মানুষ অনুমান করতে পেরেছিলেন। আমার ভোটের কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেন অমন নির্বাচনে ভোট দিতে যাব! আলোচনার বিষয় হচ্ছে এটিই। কিন্তু আলোচনা হয় না। চলছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। প্রশ্ন উঠছে আচরণবিধি নিয়ে। যেখানে বিধিরই কোনো অর্থ নেই, সেখানে আচরণ নিয়ে কথা বলার কোনো ফল আছে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কমিশন বলছে সাংসদ, মন্ত্রীরা প্রচারণায় অংশ নিতে পারবে না। কিন্তু দেখলাম, তফসিল ঘোষণার পর এক সাংসদ হেলিকপ্টারে গিয়ে বিদ্রোহী এক প্রার্থীরা পক্ষে মনোনয়ন জমা দিলেন। এখানে বিধিই তো অকার্যকর। জাগো নিউজ : তাহলে এমন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কোথায় যাচ্ছে? অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ : জাতীয় রাজনীতি, সংবিধান, শাসক দল, বিরোধী দলের অবস্থান কোথায় এটি আগে ভাবতে হবে। এরপর নির্বাচন কমিশন নিয়ে ভাবতে হবে। গত জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, সিটি নির্বাচন মানুষের মধ্যে একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। আপনি হঠাৎ করেই একটি পৌরসভার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই ধারণার পরিবর্তন করতে পারেন না। আপনি চাইলেই মানুষ দলে দলে এসে নির্বাচনমুখী হবে না। জাগো নিউজ : এই পরিস্থিতি জেনেও সরকার কেন এমন একটি নির্বাচনে যাচ্ছে? অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ : সরকার নির্বাচনে কেন যাচ্ছে, তা সবার কাছেই পরিষ্কার। সরকার তার সামনের রাস্তা পরিষ্কার রাখতে চাইছে। এর উদাহরণ হচ্ছে, বিরোধীপক্ষ থেকে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, সিটি কর্পোরেশন মেয়রদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করা। বিরোধীজোটের প্রতিনিধিদের পরিকল্পিতভাবে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনেককে মামলা-গ্রেফতারে হয়রানি করা হচ্ছে। আবার যেখানে সরকারদলীয় প্রতিনিধি আছে সেখানে সরকারের বাজেট বাড়ানো হয়েছে এবং তা নিয়মের তোয়াক্কা না করেই। আমরা দেখেছি, ৮০টি পৌরসভায় স্পেশাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা গেজেটে নাই। ব্যক্তি যোগাযোগের মধ্য দিয়ে এসব হচ্ছে। এগুলো ভিন্ন আলামত। এ অবস্থায় একজন সুস্থ বিবেকবান মানুষ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে কিনা, বা বিজয়ী হলেও তার পক্ষে কাজ করা সম্ভব হবে কিনা, তা এখন সবাই বুঝতে পারেন। এ কারণেই স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই। এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সবাই পৌরসভা পৌরসভা করছেন। আদৌ কি পৌরসভার কোনো কাঠামো আছে। একটি পৌরসভা ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নিয়ে গঠিত হয়। কিন্তু দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হবেন শুধু মেয়রগণ। কাউন্সিলরদের ব্যাপারে কোনো দল নেই। কাউন্সিলরদের ব্যাপারে কোনো সাড়া নেই। এ কারণে কাউন্সিলরদের কোনো ভূমিকা থাকবে বলে এটি মনে করারও কোনো কারণ নেই। জাগো নিউজ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।এএসএস/জেডএইচ/এসএইচএস/এমএস

Advertisement