মতামত

জনসচেতনতা, টেস্টের স্বল্পতা ও ঘরে ঘরে সর্দি-জ্বর

করোনার সাম্প্রতিক বিস্তার বেশ আগ্রাসীভাবেই শুরু হয়েছে। গত ১ বছরে গ্রামগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগী তেমন একটা পাওয়া যায়নি। এমন কি মফস্বল শহরগুলোতেও সে অর্থে করোনার বিস্তার ঘটেনি। তবে এখন আর সে অবস্থা নেই। জেলা শহর ছাড়িয়ে করোনার বিস্তার মফস্বল ও গ্রামগুলোতেও শুরু হয়েছে। গ্রামগুলোতে এখন ঘরে ঘরে সর্দি-জ্বরের রোগী। এরা কি ‘সিজনাল ফ্লু’তে ভুগছে নাকি ‘করোনা’তে আক্রান্ত তা বোঝার কোন উপায় নেই। কারণ টেস্ট হচ্ছে না তেমন একটা।

Advertisement

বিদ্যমান অবস্থা দেখেও মানুষের ভেতরে এ নিয়ে তেমন কোন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আগ্রহ নেই। এর পেছনে বস্তুত একদিকে রয়েছে গত ১ বছরে গড়ে ওঠা মিথ্যা ধারণা। যে কোনভাবেই হোক এটা প্রচার পেয়েছে যে গরীবের করোনা হয় না। করোনা হয় বড়লোকের। শুরুর দিকে সমাজের উচ্চবিত্তের যে সকল মানুষ করোনায় মারা গেছেন সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই প্রচার মাধ্যমে যতটা ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে সেভাবে অন্য যারা মারা গেছেন বা যাচ্ছেন তাদের আর্থিক অবস্থা কেমন সেটা কখনোই প্রচার যন্ত্রে ঠাঁই পায়নি। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন এ অবধি যারা মারা গেছেন ধরেই নেয়া হয়েছে তারা সবাই সমাজের উচ্চবিত্ত ও ধনীক শ্রেণির মানুষ। ফলে আপামর জনগণ মনে করেছে করোনা বড়লোকের রোগ। এটা গরীবের হয় না। আসলে কিন্তু তা সত্য নয়।

এদিকে করোনা নিয়ে এতদিন পরে এসেও শুরুর মতোই আমরা আবার ভুল পন্থা অবলম্বন শুরু করেছি। সেটা হচ্ছে-আক্রান্ত বাড়িতে নাকি লাল পতাকা টানানো হচ্ছে! পত্রিকান্তরে দেখলাম সেসব বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন খারাপ মন্তব্য করছে। করোনা নিয়ে এমন সব বিষয় তো শুরুর দিকে ছিলো। মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফন বা সৎকার করতেও বিভিন্ন জায়গায় বাধা দেয়া হতো। ফলে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার ভয়ে সবাই এটাকে গোপন রাখার চেষ্টা করতো। এখন তো সেসব বিষয় আর নেই। আক্রান্ত পরিবারের লোকজন যেন বাজারঘাটে বা অন্য বাড়িতে না যায় সেজন্য তাদেরকে সচেতন করতে হবে। বিষয়টা তো এই।

অথচ এসবই যখন আবার পত্রিকায় দেখছি তখন ভেবে ভীষণ অবাক হচ্ছি। তার মানে হচ্ছে করোনা নিয়ে ভুল ধারণায় যেমন সাধারণ মানুষ আচ্ছন্ন আছে তেমনিভাবে প্রশাসনযন্ত্রও সেই পুরোনো পদ্ধতিতেই কাজ চালিয়ে নিতে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। অথচ এটা নিশ্চিত করা দরকার ছিলো যে আক্রান্ত পরিবার যাতে সামাজিক হয়রানির শিকার না হয়। বেশি আক্রান্ত এলাকাগুলোতে চাইলেই সবাই যেন টেস্ট করাতে পারে সেটা নিশ্চিত করা এবং এ ব্যাপারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার ছিলো। এন্টিজেন টেস্ট তো গ্রামের কমিউনিটি হাসপাতালগুলোতেই আমরা শুরু করতে পারি।

Advertisement

ফলে বিদ্যমান বাস্তবতায় আমার মনে হয় আমরা আগামী অন্তত ১-২ মাসের জন্য ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে পারি। সরকার চাইলে লকডাউন, শাটডাউন দিতে চাইলে দিক। পাশাপশি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে আমাদের জোর দিতে হবে।

(১) জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এর বিকল্প নেই। এজন্য সবাইকে মাস্ক পরার জন্য লাগাতার প্রচারণা চালাতে হবে স্থানীয়ভাবেই। এ কাজে গ্রামের মসজিদ ও অন্য ধর্মের প্রার্থনালয়গুলোকে কাজে লাগাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এ সময়ে তাদের দায় ও দায়িত্ব অনেক। কেন্দ্রীয়ভাবে দলগুলো এলক্ষ্যে কর্মূসচি ঘোষণা করতে পারে।

(২) এন্টিজেন টেস্ট কমিউনিটি হাসপাতালে করার ব্যবস্থা

(৩) করোনা হলে কেউ যেন সামাজিক হয়রানির শিকার না হন সেটা স্থানীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদ এবং সেই সাথে উপজেলা প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে। এমন অভিযোগ পেলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে করে জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে।

Advertisement

(৪) করোনা পজিটিভ হলে (প্রয়োজন অনুসারে) সে পরিবারের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করে তাদের বাড়িতে অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হলে প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে ফোনে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে তাদের ফোন নংগুলো আক্রান্ত পরিবারে দিয়ে দিতে হবে। একই সাথে এসব ফোন নং লেমিনেটিং করে স্থানীয় বাজারগুলোতে, জনসমাগম হয় এমন স্থলে টানিয়ে দিতে হবে।

পরিশেষে বলব, করোনা এখন একদম যে আচমকা বাড়তে শুরু হয়েছে প্রকৃতপক্ষে বিষয়টা এমন না।কারণ এমন আশঙ্কার কথা কিন্তু বিশেষঞ্জরা এপ্রিল/মে মাসেই বলেছিলেন।গত মে মাসের মাঝামাঝি ঈদুল ফিতরে প্রচুর সংখ্যক লোক গ্রামের বাড়ি এবং মফস্বল শহরগুলোতে ছুটি কাটাতে গেলে পরে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে সেটা নিয়ে সতর্কবার্তা কিন্তু দেয়া হয়েছিলো। সরকারও তাই ঈদের ছুটিতে সবাইকে যার যার অবস্থানে থাকতে অনুরোধও করেছিলো। কিন্তু আমরা জনগণ তা থোড়াই কেয়ার করেছি। ফলে লাখ লাখ মানুষ তুমুল কষ্ট সয়ে, ভেঙে ভেঙে বেশি টাকা খরচ করে হলেও বাড়িতে গিয়েছি। পরিবার পরিজনের সাথে ঈদের আনন্দ উপভোগ করেছি। এখন তার ফল পাচ্ছি।

সামনের মাসে ঈদুল আজহা আসছে। ফলে জনউদাসীনতার সাথে যুক্ত হওয়া ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মিলে জানি না পরিস্থিতি কোনদিকে যায়। এ কারণে জনসচেতনতা সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। জনসচেতনতা সৃষ্টি করেই পরিস্থিতি রুখতে হবে আমাদের। কারণ জনগণ সচেতন হয়ে নিজে থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানলে কেবল লকডাউন, শাটডাউন যাই বলেন না কেন সবকিছু প্রতিপালন করাই সহজ হয়ে যায়। আর সেখানেই আমাদের দুর্বলতা রয়েছে ব্যাপকমাত্রায়। করোনা রুখতে জনসচেতনতার বিকল্প কিছু আছে কি?

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলোজ, সাভার।

এইচআর/এমকেএইচ