বিশেষ প্রতিবেদন

সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান

‘সেই সময়ের কথা মনে হলে এখনও রোমঞ্চিত হই। গায়ের লোম শিউরে ওঠে। ওহ! কী সেই দিন, কী সেই সময়। কিন্তু আবার যখন মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, পতাকা পেয়েছি। দেশের সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে আমি নিজে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি; একজন মানুষের কাছে এর চেয়ে বড় কিছু আর হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।’একাত্তরে ফেলে আসা স্মৃতির কথা জানতে চাইলে এভাবেই নিজের অনুভূতির কথা কথা জানান মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল। প্রচণ্ড সাহসী, সদা প্রাণোচ্ছ্বল, চটপটে মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল বলেন, যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু আমরা এখনও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক একটি ইতিহাস তুলে ধরতে পারিনি। সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এদেশের মানুষ জানুক এটাই সব সময় কামনা করি। তাহলেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত হবে।মুস্তাফিজুর রহমান মুকুলের বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ি শহরের আমবাগান মহল্লায়। জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজে বিএসসি পাস কোর্সের ছাত্র থাকা অবস্থায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। কে ঠেকায় মুস্তাফিজুর রহমান মুকুলকে। বাবা-মা কাউকে না জানিয়ে বন্ধু লক্ষ্মী সাহা ও সহোদর মাহফুজুর রহমানকে নিয়ে সীমানা পেরিয়ে চলে যান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বারাঙ্গাপাড়ায়। সেখানকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য লোক বাছাই চলছিল। লাইনে দাঁড়ালেন।বাছাই পর্ব শেষে তাদের বাসে করে পাঠানো হলো তুরা জেলার রংনাবাগ এলাকায়। ঘন জঙ্গলে আবৃত রংনাবাগে তখন কিছুই নেই। জঙ্গল পরিষ্কার করে, ঘর নির্মাণ করে, খেয়ে না খেয়ে তারা শুরু করেন প্রশিক্ষণ। টানা ঊনত্রিশ দিনের গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল হাতে নেমে পড়েন যুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে কখনও বিজয়োল্লাসে মাতোয়ারা হয়েছেন, কখনও সহযোদ্ধাদের হারানোর বেদনায় ব্যথিত হয়েছেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও লক্ষ্যচ্যুত হননি, দেশের মাটিকে শত্রু মুক্ত করার দৃঢ় অঙ্গীকার থেকে।মুস্তাফিজুর রহমান মুকুল জানান, মূলত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকেই স্বাধিকার আন্দোলনের দাবিতে পূর্ববাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে। সে সময় জামায়াতের টপ নেতা গোলাম আজম নালিতাবাড়ি সফরে এসেছিলেন সভা করার জন্য। কিন্তু আমরা তাকে সভা করতে দেইনি। সমস্বরে শ্লোগান তুলেছিলাম-গোলাম আজম ফিরে যাও। যে কারণে সভা না করেই তাকে ঢাকায় ফিরতে হয়েছিল।তিন বলেন, ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর পাকিস্তানিদের ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানাতে আমরা আঁচ করতে পারলাম দেশে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ রেডিওতে শুনতে পেলাম। সে ভাষণকেই বেদ বাক্যের মতো বুকে ধারণ করে নিজেরা ভেতরে ভেতরে প্রস্ততি নিতে থাকলাম। নালিতাবাড়িতে তখন আওয়ামী লীগ নেতা মো. আব্দুল হাকিমকে আহ্বায়ক ও অধ্যাপক আব্দুস সালামকে সদস্য সচিব করে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। তাদের নেতৃত্বে আমরা ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকি।যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করে মুক্তিযোদ্ধা মুকুল বলেন, দেশে তখন অসহযোগ আন্দোলন চলছে। সাতই মার্চের ভাষণের পরই অস্ত্র সংগ্রহের জন্য প্রথমেই যাই শেরপুরের বিপ্লবী রবি নিয়োগীর কাছে। তিনি বললেন- কলমাকান্দা থানার লেংগুড়া গ্রামের ললিত চন্দ্র বর্ম্মনের কাছে কিছু অস্ত্র পেতে পারো। বন্ধু লক্ষ্মী সাহাকে নিয়ে  ছুটে গেলাম সেখানে। কিন্তু তিনিও বললেন, আমার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। তুমি বরং ভারতের বারাঙ্গাপাড়ার যতীন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে পারো। কিন্তু কোথাও অস্ত্রের সন্ধান না পেয়ে চলে এলাম নালিতাবাড়ীতে।আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে যে মিছিল, মিটিং ধর্মঘট হয়, তাতেই সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে থাকি। ২৫ মার্চের কালোরাতের পর দলে দলে মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলে ভারতে। আমি, আমার ভাই মাহফুজ ও বন্ধু লক্ষ্মীসহ বেশ ক’জন নাকুগাঁও সীমানা পার হয়ে চলে যাই ভারতের বারাঙ্গাপাড়ায়। তখনও ভারতে শরণার্থী ক্যাম্প খোলা হয়নি। দলে দলে লোকজন রাস্তাঘাটে, গাছতলায়, খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছে। খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। নামলো বৃষ্টি। নামলো রোদ। লাগলো মহামারী। মানুষের এ দুরবস্থা শুধু চোখে দেখা ছাড়া আর কিছু করার উপায় নেই। কারণ তখন আমাকেও রাত কাটাতে হয়েছে গাছতলায়। এর মধ্যে একদিন জানতে পারলাম বারাঙ্গাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য লোক নিয়োগ করা হচ্ছে। দেরি না করে সেখানে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলাম।তিনি বলেন, সারারাত অভুক্ত থেকে ভোরে পৌঁছলাম মেঘালয়ের তুরা জেলার রংনাবাগে। যেদিকেই তাকাই শুধু উঁচু উঁচু পাহাড় আর ঘন জঙ্গল। আমরা প্রথম ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধারাই জঙ্গল কেটে এখানে স্থাপন করলাম প্রশিক্ষণ শিবির। তারপর টানা ঊনত্রিশ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে নেমে পড়লাম মরণপণ যুদ্ধে। কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে প্রথমে আমাদের উপর দায়িত্ব ছিল সীমান্ত এলাকায় পাক হানাদারদের আতঙ্কগ্রস্ত রাখা। আমরাও গেরিলা প্রশিক্ষণের সেই ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে গোটা সীমান্ত এলাকায় অবস্থানরত পাক হানাদারদের তটস্থ রাখার দায়িত্ব পালন করি।মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, যুদ্ধদিনের কতো কথা, কতো স্মৃতি। বাবা-মাকে না বলে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় শুরু থেকেই মনের ভেতর একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। তাই একদিন নালিতাবাড়ি ক্যাম্প আক্রমণে এসে কোম্পানি কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসি। ভোগাই নদীতে তখন বর্ষার ভরা যৌবনের প্লাবন। সঙ্গে একটি ‘হ্যান্ড গ্রেনেড’ নিয়ে নদী সাঁতরে পার হয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। ধীরে ধীরে মায়ের ঘরের কাছে গিয়ে ফিঁসফিঁসিয়ে মা বলে ডাকলাম। মুহূর্তেই মা দরজা খুলে দিয়েই ভূত দেখার মতোই চমকে উঠলেন। পরনের ভেজা কাপড় থেকে টপটপ করে নিংড়ে পড়ছে পানি। মায়ের কোনো হুশ নেই।আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ’এখানকার অবস্থা ভালো না। তুই মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লেখানোয় পাকিস্তানিরা তোর বাবা ও মামাকে ধরে আহমেদ নগর ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল। মানুষের ভালোবাসায় তোর বাবা জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারলেও, তোর মামা আব্দুর রাজ্জাক চেয়ারম্যানকে পাকিস্তানিরা তিনানিতে মেরে ফেলেছে। তোরও এখানে থাকার দরকার নাই। তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যা।’ঘুম থেকে উঠে এসে বাবাও একই কথা বললেন। খুব ইচ্ছে ছিল, মায়ের হাতের রান্না করা একটু গরম ভাত খাওয়ার। সে ইচ্ছেটুকুও পূরণ হলো না। বাইরে কিছু মানুষের কোলাহল শোনা গেলো। মনে হলো ওরা আমাকে ধরে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতে এগিয়ে আসছে। আমার হাতে একটি মাত্র গ্রেনেড। তাই বেশি ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না ভেবে নদীর পথে পা বাড়ালাম। সাঁতরে নদীর অপর পারে যেতেই দেখতে পেলাম কিছু লোকের জটলা। সাহসের উপর ভর করে বললাম, ‘সরে যাও, তানা হলে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করবে। ভয়ে লোকগুলো সরে গেলো। আমিও দ্রুত সামনে দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু আমার সহযোদ্ধারা ততক্ষণে আমাকে ফেলে চলে গেছে সেই ফুলপুর গ্রামে। পরে সেখানে গিয়েই তাদের নাগাল পেলাম।মুস্তাফিজুর রহমান আরেক দিনের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, আমরা তখন তন্তুর গ্রামে অবস্থান করছি। রাতের বেলা বেলতৈল প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকা ‘রেকি’ করে আনসার আলীর বাড়িতে বিশ্রাম করছি। এমন সময় আন্ডাখালি থেকে পুরো গ্রামটি ঘিরে ফেলে পাক হানাদার বাহিনী। প্রথমে আমরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলি। কিন্তু আমাদের আর্মস অ্যামুনেশন এতো কম ছিল যে, ওদের ভারী অস্ত্রের কাছে দাঁড়াবার মতো সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই আমরা পিঁছু হটে আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত নিলাম। এতেও আমাদের শেষ রক্ষা হয়নি। সেদিন সহযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ, আব্দুল লতিফ, লাল মিয়া মাঝি, আনসার আলীর শিশুপুত্রসহ অনেককে জীবন দিতে হয়েছিল।মুকুল বলেন, যুদ্ধের ন’টি মাস কখনও মৃত্যুভয় হৃদয়ে স্পর্শ করেনি। বরং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই বেঁচে থাকতে হবে অহর্নিস- এরকম ভবনাই ছিল আমাদের। লোমহর্ষক কাঁটাখালি ব্রিজ অপারেশনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন, সীমান্ত এলাকায় পাক হানাদারদের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে নালিতাবাড়ি-ঝিনাইগাতী-শেরপুর সড়কের কাঁটাখালি ব্রিজ অপারেশন জরুরি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পাক হানাদারদের তিনটি ক্যাম্পের ভেতরের অবস্থিত এ ব্রিজটির অপারেশন ছিল দুরূহ ব্যাপার। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর দুঃসাহসিক এ অপারেশনের দায়িত্বটি তুলে নেন কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসান। দিনটি ছিল ৪ জুলাই। আমরা ৫৩ জনের একটি দল ভারত থেকে পায়ে হেঁটে খাটুয়াপাড়া গ্রামে চলে আসি কাঁটাখালি ব্রিজ ও তিনানি ফেরি ধ্বংসের অপারেশনে। ৫ জুলাইয়ে ব্রিজ ধ্বংসের সফল অপারেশন শেষে আশ্রয় নেই রাঙ্গামাটি গ্রামে। ৬ জুলাই পাকিস্তানিরা রাজাকার আলবদরদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পাকড়াও করতে গ্রামটিকে ঘেরাও করে।নিজের ডান পায়ের উরুতে গুলির আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে তিনি জানান, ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে আমি সেই অপারেশনে অংশ নিয়েছিলাম। গত্যন্তর না পেয়ে আমরা আত্মরক্ষার্থে বিলের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। হাসের মতো বিলের পানিতে তড়তড়িয়ে বেঁচে যেতে থাকি। এ সময় প্রচণ্ড গোলাগুলিতে ডান পায়ের উরুতে গুলিবিদ্ধ হই। আহত হন আবু সাঈদ মাস্টার, আব্দুল জুব্বার মাস্টারসহ বেশ কয়েকজন। শাহাদৎ বরণ করেন কোম্পানি কমান্ডার নাজমূল আহসান, তার চাচাতো ভাই সহযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন ও তার ভাইপো সহযোদ্ধা আলী হোসেন। এতোকিছুর পরও হাতের অস্ত্রটি ছাড়িনি।মুকুল বলেন, এখনও কাঁটাখালি ব্রিজের উপর দিয়ে শেরপুর জেলা শহরে যাই। তখন বারবার তাকাই স্বাধীনতা যুদ্ধের নীরব সাক্ষী কাঁটাখালি ব্রিজটির দিকে এবং অদূরের খাটুয়াপাড়া রাঙ্গামাটি গ্রামটির দিকে। সেদিনের সেই তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ছয়জন গ্রামবাসীর আত্মত্যাগের কাহিনী ছিল ভয়াবহ নৃশংসতাপূর্ণ। সারি করে গুলি করা হলে ছয়জন গ্রামবাসী লাশ হয়ে পড়ে থাকে দিনভর। পাঁচটি লাশ কোনোমতে দাফন করা সম্ভব হলেও, রাজাকারদের বাধার মুখে একটি লাশ ভাসিয়ে দিতে হয়েছিল নদীতে। ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ সবই ঘটেছিল সেই গ্রামে।তিনি বলেন, কাঁটাখালি ব্রিজ অপারেশনের যে কাহিনী তা নিয়ে নাটক-সিনেমাও হতে পারে। অথচ এ বীরত্বগাঁথা অপারেশনে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযোগ্য সম্মান দেয়া হয়নি, স্বীকৃতি মেলেনি রাঙ্গামাটি গ্রামের শহীদদের এবং সংরক্ষণ হয়নি সেই ব্রিজটিও। যৌবনে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও থেমে থাকেননি দেশের বীর সন্তান। দেশমাতৃকার টানে যেভাবে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। সেভাবেই স্বাধীনতার পর দেশকে পুনর্গঠনে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। জড়িয়ে পড়েন নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য জনমত সংগঠনে নানাভাবে কাজ করতে থাকেন। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে তিনি এলাকাবাসীর সহায়তায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে বিদ্যালয়টির নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা উচ্চ বিদ্যালয়’। নাকুগাঁও স্থলবন্দর যেতে চারালি বাজারে সন্নিকটেই এ বিদ্যালয়টির অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাফিজুর রহমান মুকুল নালিতাবাড়িতে একজন সংগঠক হিসেবেও সমধিক পরিচিত।তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই শেষ হবার নয়। একাত্তরে লড়াই করেছি, দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজও চলছে। এখন আমি নতুন লড়াই শুরু করছি বাল্যবিয়ে ও মাদকের বিরুদ্ধে।’মুস্তাফিজুর রহমান জানান, সবকিছু আজ ছবির মতোন মনে হয়। টানা দু’দিন যুদ্ধ শেষে নালিতাবাড়ি মুক্ত করে নকলা পিয়ারপুর হয়ে চলে গেলাম ময়মনসিংহের টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। সেখানেই অস্ত্র জমা দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। বিএসসি পাস করলাম। বকসীগঞ্জ থানার নিলক্ষিয়া গ্রামের খালেদা বেগমকে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করলাম। কিন্তু ঘরে দুই কন্যা জন্ম নেয়ার পর সে স্ত্রী আকস্মিক মারা যান। তাই দ্বিতীয় বিয়ে করি হালুয়াঘাটের নাসিমা খাতুনকে। প্রথম স্ত্রীর ঘরে কন্যা সামিয়া সুলতানা রুম্পা ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে এখন গৃহীণী। দ্বিতীয় মেয়ে সাফিয়া সুলতানা মুমু এসএসসি পাস করে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করে। আর দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের কন্যা সাজিয়া সুলতানা মিতুল এইচএসসি পসি করার পর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, দ্বিতীয় মেয়ে ফারহানা সুলতানা ময়মনসিংহ মমিনুন্নেসা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ও একমাত্র ছেলে তাহমিদ রহমান নাবিদ ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ১০ম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে।পাঁচ ভাই, দুই বোনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা মুকুল ছিলেন বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। বাবা আলহাজ ডা. আব্দুল হামিদ ও মা আলহাজ জোবায়দা খাতুন। বর্তমানে দু’জনেই মৃত। সম্ভ্রান্ত ও  রাজনৈতিক সচেতন পরিবারে জন্মগ্রহণ করার সুবাধে চিন্তা-চেতনায়, ধ্যান-ধারণায় মুস্তাফিজুর রহমান মুকুল সবসময়ই ছিলেন অগ্রসর। ময়মনসিংহের গৌরিপুর কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে তার হাতে খড়ি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নালিতাবাড়ি থানা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বেশ কিছুদিন তিনি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত একটানা এবং মাঝখানে কিছুদিন ছাড়া ২০০২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত একটানা নালিতাবাড়ি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের থানা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের পাশপাশি তিনি ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। তিনি নাকুগাঁও স্থলবন্দর আমদানি-রফতানিকারক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান কমিটিরও তিনি সভাপতি। নালিতাবাড়ি উপজেলা চালকল মালিক সমিতিরও তিনি সভাপতি। বর্তমানে তিনি নিজের ব্যবসার পাশাপাশি নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। নিজের বাসায় তিনি ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে নানা বইয়ের এক বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তুলেছেন। তার অবসরের বেশিরভাগ সময় কাটে বই পড়ে আর নিজের প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা এবং সমমনা মানুষদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক ‘চেতনা’ নামে নালিতাবাড়িতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলেছেন। যারা এলাকায় এলাকায় মেডিকেল ক্যাম্প, যৌতুক-বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও সুদের ফাঁদমুক্ত সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন।মুকুল বলেন, সময় দ্রুত পার হয়ে যায়। যারা ছিল স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি, তারাই আজ নানা কৌশলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন, তাদের অধিকাংশেরই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিলেন না। আর যাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল, যারা উঁচু দরের নেতা ছিলেন, তাদের অনেকেই সরাসরি যুদ্ধ করেন নাই। তাই যুদ্ধের ত্যাগ, কষ্ট তারা অনুধাবন করতে পারেন নাই। এ কারণেই যাদের মূল্যায়ন পাওয়ার কথা ছিল তারা পান নাই। আর যাদের তিরস্কার পাওয়ার কথা ছিল, তারাই পুরস্কৃত হয়েছেন।তিনি বলেন, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা নয়। রক্তের ঋণ পরিশোধ করতেই সবার সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। দুঃখের কথা কী বলবো, রাজনীতির ফাঁক-ফোকর গলে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণ থেকে পালিয়ে আসা একজন আত্মসমর্পনকারী আজ আমাদের কমান্ডার হয়ে গেছে। এ জন্যই মুক্তিযোদ্ধাদের এ লড়াই থামার লড়াই নয়।শেরপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত লেখালেখি করছেন নালিতাবাড়ির সাংবাদিক এমএ হাকাম হীরা। মুস্তাফিজুর রহমান মুকুল সম্পর্কে তিনি বলেন, উনি প্রচণ্ড সাহসী একজন মানুষ। যা বলেন, স্পষ্ট করেই বলেন, তার কোনো লুকোচুরি নেই। তিনি যুদ্ধাহত একজন মুক্তিযোদ্ধা হলেও প্রচারবিমুখ একজন মানুষ। সবাইতো যার যার কথাই বলে, কিন্তু তিনি তার ব্যতিক্রম।সমাজকর্মী আবদুল মান্নান সোহেল বলেন, তার ডেডিকেশন সাংঘাতিক। প্রচণ্ড তার প্রাণশক্তি। তার বাড়ির লাইব্রেরির মতো বইয়ের সংগ্রহ সারা নালিতাবাড়িতে আরেকটি নেই। সহযোদ্ধা সম্পর্কে আরেক মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা মো. আব্দুল খালেক বলেন, ওর সাংগঠনিক দক্ষতা এবং সাহসের তুলনা নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে তার অদম্য সাহস এবং মনোবল অন্য সবাইকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। যুদ্ধ শেষেও সে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেছে, তাদের উন্নয়নে কাজ করেছে। এখন নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছে। সত্যিই তার তুলনা সে নিজেই।হাকিম বাবুল/বিএ

Advertisement