কিছুদিন আগে বাবা দিবসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখে পড়ছিল অসংখ্য স্ট্যাটাস। অনেকেই যার যার টাইম লাইনে নিজের বাবার ছবি দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন। বেশ ভালো লাগছিল। কারণ আমি নিজেও আমার বাবাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। আমার কাছে মনে হয় জীবনে যত মানুষ দেখেছি তাদের মধ্যেই বাবা শ্রেষ্ঠ।
Advertisement
কিন্তু এর মধ্যেও দুজন মানুষের লেখা পড়ে চমকে উঠলাম। তাদের মধ্যে একজন মেয়ে অন্যজন ছেলে। তারা লিখেছে তাদের বাবার হাতে ভয়ংকরভাবে নির্যাতিত হওয়ার কথা। সেই লেখা পড়তে পড়তেই মনে পড়ছিল অসংখ্য সংবাদ শিরোনাম। ‘বাবার হাতে শিশু খুন’, ‘কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়ায় স্ত্রীকে তালাক’ ‘বাবার প্রহারে ছেলের মৃত্যু’, ‘সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার’ ইত্যাদি অসংখ্য খবর আমরা সকলেই কমবেশি দেখেছি। এমনকি নিজের কন্যাকে ধর্ষণ, নিজের পুত্রকে বিক্রি করে দেয়ার মতো ভয়ংকর ঘটনাগুলোও বাংলাদেশের সমাজেই অনেক ঘটেছে। স্ত্রী ও সন্তানদের ত্যাগ করে অন্য জায়গায় বিয়ে, কিংবা স্ত্রী সন্তান ফেলে চলে যাওয়ার ঘটনা তো অহরহ ঘটছেই। এরাও তো বাবা। কিন্তু এরা কি সত্যিই শ্রদ্ধার বা ভালোবাসার যোগ্য?
‘বাবা’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে যে কথাগুলো মনে পড়ে তা হলো দায়িত্ব, কর্তব্য, স্নেহ, রক্ষা করা, আদর্শ, আত্মত্যাগ ইত্যাদি। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে অসংখ্য বাবা কঠোর পরিশ্রম করেন, হয়তো নিজে একবেলা খেয়ে থাকেন। অসংখ্য বাবা নিজের সব আরাম আয়েশ ত্যাগ করেন সন্তানের মুখে একটু হাসি ফুটাতে। এইসব বাবা আর ওই সব নির্যাতনকারী নরপিশাচ বাবা কি এক? শুধু বায়োলজিকালি ফাদার হলেই কি বাবা হওয়া সম্ভব?
সমাজে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা, উন্নয়ন, বিকাশ এসব নিশ্চিত করার অর্ধেক দায়িত্ব পুরুষের। নারী ও নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে পুরুষকে মানুষ হতে হবে। কিংবা বলা যায় পুরুষকে ‘মানবিক পুরুষ’ হতে হবে। তাকে সত্যিকারের মহৎ পিতৃত্বের গুণগুলো অর্জন করতে হবে। শুধুমাত্র গর্ভে ধারণ করলেই যেমন মা হওয়া যায় না তেমনি শুধু স্পার্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না।
Advertisement
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনা স্মরণ করুন। পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বর নির্যাতন ও ধর্ষণের ফলে অনেক নারী তখন গর্ভবতী হয়ে পড়েন। জন্ম হয় অসংখ্য যুদ্ধশিশুর। স্বাধীনতার পর এমন অনেক যুদ্ধশিশু আশ্রয় পেয়েছেন পাশ্চাত্যের অনেক দেশে। সেখানে তারা পেয়েছেন বাবা মা পরিবার। এই যুদ্ধশিশুদের প্রকৃত বাবা কে? অবশ্যই সেই পালক পিতা যিনি তাদের দিয়েছেন স্নেহ মমতা, নাম পরিচয় এবং নিশ্চিন্ত জীবন। এই শিশুদের বায়োলজিকাল ফাদার যদিও পাকিস্তানি সৈন্যরা কিন্তু তারা কি বাবা ডাকার উপযুক্ত? নিশ্চয়ই না। বায়োলজিকালি জন্ম দিয়েও যেমন অনেকে বাবা-মা হয়ে উঠতে পারেন না। তেমনি একজন মানুষ বাবা অথবা মা হয়ে উঠতে পারেন বায়োলজিকালি কাউকে জন্ম না দিয়েও।
এখানে শুধু বাবা নয়, আমি মায়ের কথাটাও বলতে চাই। মা কর্তৃক শিশু হত্যার ঘটনাও কিন্তু সমাজে অনেক ঘটে। শুনতে যত অবিশ্বাস্য লাগুক এমন অনেক মা আছেন যারা শিশুকে নির্যাতন করেন, হত্যা করেন, বিক্রি করে দেন বা নির্যাতনকারীকে সহায়তা করেন। এই সব বাবা ও মা কখনও সত্যিকারভাবে ‘বাবা-মা’ হওয়ার উপযুক্ত নয়।
ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে মনে হয় এদেশে ‘ভালো বাবা’র অভাব নেই। তাহলে এত খারাপ পুরুষ, ধর্ষক পুরুষ, নির্যাতক পুরুষ আসে কোত্থেকে? এখানে একজন মানুষের দ্বিমুখী বা বহুরূপী চেহারার কথা বলতে হয়। একজন পুরুষ হয়তো তার কন্যার জন্য ভালো কিন্তু অন্যের কন্যার বেলায় সে ধর্ষক বা নির্যাতক। নিজের বোনের বেলায় ‘প্রোটেকটিভ’ অন্যের বোনের বেলায় ‘পারপিট্রেটর’। এরা আর যাই হোন মানবিক মানুষ নন।
এখানে সন্তানেরও কোন কোন ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার দরকার রয়েছে। দুর্নীতিবাজ, নির্যাতক, হিংস্র ও অমানবিক আচরণের অমানুষকে ‘বাবা’ না বলে তাকে পরিত্যাগ করা দরকার সকল সন্তানের। ‘ত্যায্য পুত্র’ হলে ‘ত্যায্য বাবা’ কেন নয়? অমানুষদের কোন অধিকার নেই ‘বাবা’র মতো একটি মহৎ সম্বোধনে সম্বোধিত হওয়ার। একই কথা আমি মায়ের বেলাতেও বলতে চাই। যে মা অসৎ, সন্তানের প্রতি নির্যাতনকারী, লোভী ও সন্তানের জীবন ধ্বংসকারী তারা মা সম্বোধন পাওয়ার অনুপযুক্ত।
Advertisement
পাশ্চাত্যের অনেক দেশে নির্যাতনকারী, অবহেলাকারী, বিকৃতরুচির বাবা-মাকে পরিত্যাগের অধিকার শিশুর রয়েছে। সমাজকল্যাণ বিভাগের লোক সেখানে নিয়মিত পর্যরবেক্ষণ করে যে বাবা মা শিশুকে ঠিকমতো দেখভাল করছে কিনা। যদি সমস্যা পায় তখন তারা শিশুটিকে সেফ হোমে নিয়ে যায়। আর শিশু নির্যতনকারী বাবা-মাকে পাঠায় সংশোধনাগারে এমনকি অপরাধের মাত্রা বুঝে জেলখানায়। মাদকাসক্ত, বিকৃতরুচি, নির্যাতক(শারীরিক ও মানসিক), অপরাধী বাবা-মায়ের কাছে শিশুকে দেয়া হয় না। তাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদের দেশেও এমন ব্যবস্থা চালু হওয়া দরকার।
প্রকৃতপক্ষে শিশুর স্বার্থ দেখতে হবে সবার আগে কারণ তারাই আমাদের ভবিষ্যত। পুরুষ ও নারী উভয়েই যেন মানুষ হয়ে ওঠে, মানবিক হয়ে ওঠে, সত্যিকারের বাবা ও মা হয়ে ওঠে সেটা নিশ্চিত করা দরকার। আর তার জন্য চাই মানবিক শিক্ষা। চাই মানবিক সমাজ।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/জিকেএস