ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এ দেশের স্বাধীনতায় ভারতীয়দের অবদান অনস্বীকার্য। তবে তার যোগ্য প্রতিদান দিতে কখনো কার্পণ্য করেনি ঢাকা। দিন দিন দুই দেশের সম্পর্ক হয়ে উঠেছে আরও মজবুত, শক্তিশালী। সম্প্রতি ভারতের টিকা কূটনীতির কারণে সৃষ্ট সংকটে সেই সম্পর্কে কিছুটা টান পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার জবাব বাংলাদেশ ‘ইলিশ কূটনীতি’র মাধ্যমে দিচ্ছে বলে মনে করছে ভারতের বিভিন্ন মহল।
Advertisement
সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ ১৮-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ‘স্বর্ণালি অধ্যায়’ সম্প্রতি ফিকে হয়ে আসছে। বাংলাদেশের ১৬ লাখ মানুষ টিকার দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু ভারত বলছে, এ মুহূর্তে টিকা পাঠানো সম্ভব নয়।
ঢাকার সূত্রের বরাতে সংবাদমাধ্যমটি বলছে, টিকা ইস্যুতে বাংলাদেশের ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে। তার সরাসরি প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাঙালির প্রিয় মাছ ইলিশের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ অনেক দিন হয় ভারতে ইলিশ রফতানি বন্ধ করেছে। তা সত্ত্বেও গত বছর শেখ হাসিনার সরকার জামাইষষ্ঠীতে পশ্চিমবঙ্গে দুই হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছিল। এ বছর কাহিনি ভিন্ন।
অনেকেই বলছেন, ভারত প্রতিশ্রুত টিকা না দেয়ায় বাংলাদেশ ইলিশ রফতানি বন্ধ রেখেছে- এমন সহজ সমীকরণ মেলানো ঠিক নয়। এটাও সত্য যে, ইলিশ কূটনীতির পর দুই দেশের সম্পর্ক আগের মতো মসৃণ নেই।
Advertisement
নিউজ ১৮-এর মতে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে উত্থান-পতনের কূটনৈতিক প্রতীক হয়ে উঠেছে ইলিশ। এর আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যখন সীমান্ত চুক্তি করতে ঢাকা এসেছিলেন, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাংলাদেশ ইলিশ পাঠাচ্ছে না কেন? ত্বরিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিস্তার পানি আসলেই মাছ সাঁতার কেটে চলে যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের মৎস্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এখনো বাংলাদেশ থেকে ইলিশ পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভারতে কোনো ইলিশ রফতানি করেনি বাংলাদেশ। ২০১৯ সাল থেকে বিভিন্ন উপলক্ষ ঘিরে ফের ইলিশ পাঠানো শুরু হয়। ২০১৯ ও ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের বাজারে বাংলাদেশের ইলিশ পেয়েছিল স্থানীয়রা।
পশ্চিমবঙ্গের মৎস্য আমদানিকারক সমিতির সেক্রেটারি অতুল চন্দ্র দাস বলেন, গত দুই বছর ৫০০ থেকে ১ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন ইলিশ বাংলাদেশ থেকে আমদানি হয়েছে। এ বছর এর পরিমাণ আরও বাড়বে। তাছাড়া মিয়ানমার, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট থেকেও মাছ আসবে। অবশ্যই সেগুলোর স্বাদ বাংলাদেশের ইলিশের মতো ভালো হবে না।
বাংলাদেশি সূত্রের বরাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, গত মার্চে ঢাকা সফরকালে টিকা ইস্যুতে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পরপরই বাংলাদেশ, ভুটান, শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে টিকা রফতানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। গত ২০ জুন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, যত দ্রুত সম্ভব তারা বাংলাদেশে টিকা রফতানি শুরু করতে আগ্রহী। কিন্তু ঠিক কবে নাগাদ এ কার্যক্রম শুরু হতে পারে তা নির্দিষ্ট করে বলেননি তিনি।
Advertisement
গত নভেম্বরে সই হওয়া চুক্তি অনুসারে, বাংলাদেশকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকার তিন কোটি ডোজ সরবরাহ করার কথা ছিল ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের। এজন্য আগাম অর্থও দেয়া হয়েছিল তাদের। কিন্তু নিজস্ব চাহিদা মেটানোর কথা বলে গত এপ্রিলে আচমকা টিকা রফতানি বন্ধ করে দেয় ভারত।
চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে বাংলাদেশকে ৫০ লাখ টিকা সরবরাহের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৭০ লাখ ডোজ পাঠিয়েছে সিরাম। ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাকি ২ কোটি ৩০ লাখ ডোজ পাওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়েছে রাশিয়ার ‘স্পুটনিক ভি’, চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের তৈরি টিকা, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের উৎপাদিত পৃথক দুটি টিকার। ইতোমধ্যে সেগুলোর বেশকিছু চালান দেশে পৌঁছানোর পর ব্যবহারও শুরু হয়েছে। সবশেষ গত বুধবার চীনের ‘ভেরো সেল’ টিকার পরীক্ষামূলক ব্যবহারের (ট্রায়াল) অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি, ভারত সরকার টিকা রফতানি স্থগিত করার সুযোগে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে নিজেদের টিকা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা চালাচ্ছে চীন-রাশিয়ার মতো দেশগুলো।
তবে করোনা মহামারির হাত থেকে জনগণের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকে।
কেএএ/জিকেএস