বিশেষ প্রতিবেদন

আসছে না রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী, খালাস পাচ্ছে মানবপাচারের আসামিরা

মানবপাচার বল প্রয়োগের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ, যা মানুষের মুক্ত চলাচলের অধিকার হরণ করে। এটা মূলত নারী ও শিশু পাচারকেই ইঙ্গিত করে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী, মানবপাচার মানুষের অধিকার লঙ্ঘন করে। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন এবং এ অপরাধের শিকার ব্যক্তির সুরক্ষা, অধিকার বাস্তবায়ন ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আইন প্রণীত হয়। এ আইনে মানবপাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। মানবপাচারের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ময়মনসিংহ বাদে দেশের সাত বিভাগে মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনুমতি দেয়া হয়। এরপর ২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকায় মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২৫২টি মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত। এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন ২৪৯টি মামলার আসামি।

Advertisement

অধিকাংশ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে আসামিদের খালাস দেন আদালত। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে সমন জারি করার পরও তারা আদালতে উপস্থিত হন না।

ঝুলে আছে ১২২০টি মামলা২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকায় মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মানবপাচার আইনের মামলার বিচার হতো। ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত {চলতি বছরের ১৭ জুন} ২৫২টি মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত। এর মধ্যে খালাস দেয়া হয়েছে ২৪৯টি মামলার আসামিদের।

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা দেখা গেছে, অধিকাংশ মামলায় সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় আসামিদের খালাস দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিনটি মামলায় পাঁচ আসামিকে সাজা দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে একজনের যাবজ্জীবন, দুজনের ১৪ বছর, দুজনের ১০ বছর ও একজনের সাত বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। বর্তমানে ঢাকার মানবপাচার টাইব্যুনালে এক হাজার ২২০টি মামলা বিচারাধীন।

Advertisement

ঘটনা-একরাজধানীর মিরপুর মডেল থানার মনিপুর এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে অসামাজিক কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৬ জুন তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরা হলেন- রত্না আক্তার (২০), মামুন (২৪) ও জাহিদুল। এ ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে তিনজনের বিরুদ্ধে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ সালের ১২(১) ধারায় মামলা করেন। ছয়জনকে মামলার সাক্ষী করা হয়।

একই বছরের ১৭ আগস্ট রত্না ও মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। ৩১ আগস্ট রত্না ও মামুনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা একই থানার এসআই আতাউর রহমান। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি জাহিদুলকে অব্যাহতি দানের সুপারিশ করেন।

পরে জাহিদুলকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন আদালত। বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা ছাড়া ছয় সাক্ষী হলেন—এসআই মিজানুর রহমান, কনস্টেবল হামিদুল, রফিকুল, জহির, নিয়ামত আলী ও মোহন। অভিযোগ গঠনের পর থেকে রায় ঘোষণা পর্যন্ত কোনো সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হননি। চলতি বছরের ১ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষ কোনো সাক্ষী উপস্থিত না করায় আসামিদের খালাস দেন ঢাকার মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল।

ঘটনা-দুই২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর শাহবাগ থানার বঙ্গবাজার এলাকায় অবস্থিত ইউনাইটেড আবাসিক হোটেলে অসামাজিক কার্যকলাপ হচ্ছে, এমন খবরের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানকালে সেখান থেকে ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাররা হলেন- মানিক, সেলিম, রেশমা আক্তার, শিল্পী, মানিসা, হাসান, নূপুর আক্তার, ঝুমুর, জেসমিন, নূপুর, সোনিয়া, মুন্নি, সুমা, মুক্তা আক্তার, স্মৃতি আক্তার, তাজুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম ও কামাল হোসেন। এরপর শাহবাগ থানার এসআই আবুল আনছার তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইন-২০১২ এর ১২(১) ধারায় মামলা করেন।

Advertisement

মামলার অভিযোগে বাদী বলেন, হোটেলের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় মালিক, ম্যানেজার ও কর্মচারীদের সহযোগিতায় কিছু সংখ্যক নারী অবস্থান করে অবৈধভাবে যৌন ব্যবসা করছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে নিজেদের ‘যৌনকর্মী’ বলে স্বীকার করেন আসামিরা।

২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই আনারুল ইসলাম ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। এতে কামালকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। এছাড়া নতুন আরও দুজনকে চার্জশিটভুক্ত করে পুলিশ।

মামলার সাক্ষী করা হয় ১১ জনকে। বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ছাড়া অন্য ৯ সাক্ষী হলেন—এসআই মোকতার হোসেন, রূপক চন্দ্র, কনস্টেবল সুরুজ্জামান, কহিনুর, লিটন, নাইম ও পারভেজ। এরপর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। অভিযোগ গঠনের পর থেকে রায় ঘোষণা পর্যন্ত কোনো সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হননি। ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো সাক্ষী উপস্থিত না করায় আসামিদের খালাস দেন ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল।

সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করতে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতার নজির দুই মামলার রায়ে বিচারক উল্লেখ করেন, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত হওয়ার জন্য সব ধরনের প্রক্রিয়া ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। ইতোমধ্যে মামলার প্রায় সাত বছরের বেশি সময় পার হয়েছে।

বিচারক বলেন, সাক্ষী উপস্থাপনে রাষ্ট্রপক্ষের অনুরূপ ব্যর্থতার কারণে একটি ফৌজদারি মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকার কোনো আইন বা যুক্তিসঙ্গত বিধান নেই, পারিপার্শ্বিক অবস্থায় আদালত কর্তৃক ফৌজদারি কার্যবিধি ২৬৫-এর এইচ ধারা মতে, আসামিদের খালাস প্রদান ন্যায়সঙ্গত। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক সাক্ষী উপস্থানে ব্যর্থতার কারণে একটি ফৌজদারি মামলাকে দীর্ঘদিন বিচারাধীন না রেখে আসামিদের খালাস প্রদানের মাধ্যমে নিষ্পতি করার বিধান রয়েছে। মামলায় আসামিদের খালাস প্রদান করা হলো।

সাক্ষীরা আদালতে না এলে অপরাধ প্রমাণ সম্ভব নয়এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানবপাচার আইনের মামলাগুলো আদালতে আসার পর সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে সমন পাঠানো হয়। জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় সাক্ষীদের বিরুদ্ধে। এরপরও অধিকাংশ সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেন না। সাক্ষীদের উচিত আদালতে এসে সাক্ষ্য দেয়া।’

আইনজীবী খালেদ হোসেন বলেন, ‘সাক্ষীর মাধ্যমেই আদালত মামলা প্রমাণ করেন। মানবপাচার আইনের অধিকাংশ মামলায় আদালতে উপস্থিত হন না সাক্ষী। তারা আদালতে না আসায় অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করানো। সাক্ষীর মাধ্যমেই ন্যায়-অন্যায় প্রমাণ হবে।’

জেএ/এমএসএইচ/এইচএ/এমএস