ছেলের কথা শুনে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তার মুখের দিকে পলকহীন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সংশয় নিয়ে বললাম-: কী খাবা বললা?জাহিন মিয়ার চেহারায় কোন ভাবান্তর পরিলক্ষিত হল না; সে আগের মতোই নির্লিপ্ত গলায় বলল-: ব্যাঙ খাব। এ মাসের ২০ তারিখে জাহিন মিয়ার ৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। ৪ বছর বয়সী একটা ছেলের আগ্রহের তালিকায় আইসক্রিম, চকোলেট, চিপস, জুস থেকে শুরু করে হাজিবাজি নানা কিছু থাকতে পারে; কিন্তু তাই বলে ব্যাঙ! খুবই রহস্যময় ব্যাপার। আমি বিস্ফোরিত চোখে লবণ বেগমের দিকে তাকালাম। লবণ বেগমের চেহারা দেখে মনে হলো, ছেলের কথা শুনে সে খুবই মজা পাচ্ছে। ভয়ার্ত গলায় বললাম-: এইটা কী কারবার! এই ছেলে কোরিয়ানদের মতো হঠাৎ ব্যাঙ খাওয়ার জন্য অস্থির হইছে কেন? এর রহস্য কী?আমার কথা শুনে লবণ বেগম খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর বলল-: এইটা আমি কেমনে বলব? সে তো আমার সঙ্গে শলাপরামর্শ করার পর ব্যাঙ খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে নাই।লবণ বেগমের কথায় মাথা নাড়লাম- তাও তো ঠিক। বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করার এক পর্যায়ে মনে একটা বিষয় উঁকি মারল। মাঝেমধ্যেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা দলবল নিয়ে দেশের বিভিন্ন কারখানা ও দোকানে অভিযান চালাচ্ছেন। সেসব অভিযানে পচা-বাসি ও ভেজাল খাবার-দাবারের সন্ধান পাওয়ার পর জরিমানাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের সচিত্র প্রতিবেদন টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রচার করা হচ্ছে। জাহিন মিয়া কি টেলিভিশনে এসব দেখে প্রচলিত খাবারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলল? আশংকার কথা ব্যক্ত করতেই লবণ বেগম হাসতে হাসতে বলল-: আজব দেশের আজব হাল; ছাগল চাটে বাঘের গাল। তোমার মাথা ঠিক আছে তো? তিন বছরের পুইচ্চা একটা ছেলে খাবারে ভেজাল দেওয়ার বিষয়-বৃত্তান্ত টেলিভিশনে দেখার পর নিজেরে ব্যাঙখাদক বইলা ঘোষণা দিবেÑ এই কথাও কি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে। এইসব হইল পোলাপানের পোলাপাইন্যা কারবার। খেয়ালের বশবর্তী হইয়া তাদের মনে কখন কী উদয় হয়, আর কখন কী বলেÑ তার কোনো ইস্টিশন নাই। লবণ বেগমের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। বললাম-: এইটা তুমি ঠিক বললা না। এরা হইল ডিজিটাল যুগের মাল্টি-ডিভাইসযুক্ত পোলাপান। এদের ক্যাচিং পাওয়ার খুবই শক্তিশালী। টেলিভিশনের খবর দেইখা অবশ্যই সে নেগেটিভ বিষয়গুলা বুঝতে পারছে। তা না হইলে দুনিয়াতে এত খাবার থাকতে সে ব্যাঙের প্রতি আগ্রহী হবে কীজন্য?আমার কথা শুনে লবণ বেগম কটমট করে তাকিয়ে বলল-: হায় মাবুদ, এত বেক্কল তুমি! ইচ্ছা করলে বিষয়টা লইয়া আমার সঙ্গে তুমি বাজি ধরতে পার। কিসের ব্যাঙ-ছ্যাঙ; আমি এখনই এই ছেলের হাতে একটা জুসের বোতল দিব- দেখবা, সে চোঁ চোঁ কইরা গিলতেছে।লবণ বেগমের কথা শুনে জাহিন মিয়া মিটমিট করে তাকায়। আমরা যাচ্ছি বয়ড়া ইউনিয়ন পরিষদে। স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ময়মনসিংহ শহর ও এর আশপাশের চারটি ইউনিয়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কর্মসূচি, কিশোরী ক্ষমতায়ন ও প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন প্রকল্প, অধিকার ও সুশাসন কর্মসূচি এবং নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ প্রকল্পসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চারটি ইউনিয়নের একটি হচ্ছে বয়ড়া। বয়ড়া ইউনিয়নে অধিকার ও সুশাসন কর্মসূচির অধীনে পরিচালিত মানবাধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমাজের বিশিষ্টজনরা আজ এক পুনর্মিলনীর আয়োজন করেছেন।
Advertisement
স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মী হিসাবে সেখানে লবণ বেগম আমন্ত্রিত। লেজ হিসেবে আমি ও জাহিন মিয়া লবণ বেগমের সঙ্গে আছি। আমাদের বহনকারী রিকশা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরের পাকা রাস্তা দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে। জব্বারের মোড়ে যাওয়ার পর আমি রিকশাওয়ালাকে থামতে বললাম। তারপর একটা দোকানের দিকে জাহিন মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,: জাহিন মিয়া, চিপস খাবা?: না।: চানাচুর?: না। : জুস?: না।: অন্যকিছু?: না। : তাইলে কী খাবা?: ব্যাঙ খাব। জাহিন মিয়ার কথা শুনে লবণ বেগমের জবান বন্ধ হয়ে গেল। বিজয়ীর ভঙ্গিতে লবণ বেগমের দিকে তাকিয়ে রিকশাওয়ালাকে বললাম-: ভাই, এইবার চলেন। রিকশা চলতে শুরু করার পর আগ্রহ নিয়ে রাস্তার দু’পাশের ক্ষেত-খামার ও জলাভ‚মির দিকে চোখ রাখছিÑ দেখা যাক, জাহিন মিয়ার জন্য কোনো ব্যাঙ জোগাড় করা যায় কিনা? সবই বৃথা। চোখে দেখা তো দূরের কথা, আশপাশে কোথাও ব্যাঙের ডাকও শুনতে পাচ্ছি না। এখন আষাঢ় মাস। এ সময় খাল-বিল-জলাশয়ে ব্যাঙের লাফালাফি-দাপাদাপির দৃশ্য অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু কোথায় ব্যাঙ? কোথায় তাদের ‘গাতুর-গুতুর’ আওয়াজ?
বয়ড়া ইউনিয়ন পরিষদে পৌঁছে দেখলাম- ঘরোয়া আয়োজন। আয়োজকরা খাবারের অধিকাংশ আইটেম নিজেরাই তৈরি করেছেন। এখন সাজন-পাজনের কাজ চলছে। আমি কিছুক্ষণ বসে তাদের কাজ দেখার পর জাহিন মিয়ার হাত ধরে বাইরে বের হলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে কাঁচা সড়ক ধরে অনেকটা দূরে চলে গেলাম। চারপাশে মাঠ। জাহিন মিয়ার হাত ধরে খেতের আইলে নেমে ধানগাছের ফাঁক-ফোকরে ব্যাঙ খুঁজতে লাগলাম। বিপরীত দিক থেকে আসা এক বৃদ্ধ এ দৃশ্য দেখে দু’চোখে কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলেন-: কিছু হারাইছে নাকি মিয়াসাব?: জি না।: তাইলে আথাইল-পাথাইল হইয়া কী খুঁজতাছুইন?: ব্যাঙ।: ব্যাঙ? ব্যাঙ দিয়া কী করবাইন?: এই ছেলে খাবে। : ওষুধ কইরা খাওয়াইতান?: না। এমনেই তার ব্যাঙ খাওয়ার খুব ইচ্ছা হইছে।বৃদ্ধ ডান হাতে অবিন্যস্ত দাড়ি চুলকালেন কিছুক্ষণ। তার চোখে-মুখে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের রোদ-ছায়া খেলা করছে। একপর্যায়ে বৃদ্ধ যখন বুঝতে পারলেন- ব্যাঙ খোঁজার ব্যাপারে আমরা বাপ-বেটা দু’জনেই সিরিয়াস; তখন তিনি আফসোসের সুরে বললেন-: কইনছেন দেহি কী আচানক কারবার! ব্যাঙ যে ব্যাঙ- এইতারেও আইজকাইল খুঁইজ্যা পাওয়া যায় না!আমি বৃদ্ধের কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললাম-: ব্যাঙ সব গেল কই?বৃদ্ধ উদাসীন ভঙ্গিতে উত্তর দিলেনÑ: যাইত আর কই? সব মইরা তুষ হইছে। শুধু কী ব্যাঙ? এই যে আপনের সামনে খেত-খোলা দেখতাছুইন, ছোডকালে এইখানে যে কী পরিমাণ মাছ ধরছি- এই কাহিনী কইলে বেহুশ হইয়া যাবাইন। মাছ ধরতে ধরতে এমনও হইছে- রাখনের জন্য আর কোন বাসন-কোসন না পাইয়া শেষে পিন্ধনের লুঙ্গি খুইলা তাতে মাছ ভইরা লইয়া বাড়িতে গেছি। আর অহন দেহেন, একটা তিতপুঁটিও চোখে পড়ে না। বৃদ্ধের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। ১৫-১৬ বছর আগেও যেসব দেশীয় প্রজাতির মাছ দেশে সুলভ ছিল, আজ তার অনেকগুলোই দুর্লভ, এমন কী নিশ্চিহ্ন পর্যন্ত হয়ে গেছে। আমরা খেতে-খামারে নির্বিচারে সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী ব্যাঙ-কেঁচোসহ অন্যান্য উপকারী কীট-পতঙ্গ সমূলে ধ্বংস করেছি। তারপরও আমাদের মধ্যে কোন বিকার নেই। নেই কোন বোধোদয়। প্রকৃতির অকৃপণ দান ধ্বংসের এ মহাতাণ্ডব চালানোর মধ্য দিয়ে আমরা যে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত করছি- তা দেখার দায়িত্ব সরকারের হলেও এদিকে তাদের নজর দেয়ার সময় নেই। তারা ব্যস্ত আবুল-গাবুলদের নিয়ে। হাঃ! দুঃখ রাখি কোথায়! আরও কিছুক্ষণ ‘আলে-ডালে’ ঘোরাঘুরির পর জাহিন মিয়াকে বললামÑ : তুমি খাইতে চাও- এইটা শোনার পর ব্যাঙ মনে হয় ভয় পাইয়া গেছে। এই জন্য সে তোমার কাছে আসতেছে না। এক কাজ কর। তুমি একটা ঘোষণা দিয়া বল- ব্যাঙ ভাইয়া, আমি তোমাকে খাব না; তোমার সঙ্গে খেলা করব। তাইলে দেখবা, সে ঠিকই আইসা পড়ছে।জাহিন মিয়া মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনল। তারপর ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে দূর দিগন্তের পানে তাকিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলল-: ব্যাঙ ভাইয়া, তুমি আস... ছোট্ট একটা ছেলে হাত উঁচু করে প্রকৃতির সন্তান ব্যাঙকে ডাকছে। আমি মুগ্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখছি। কোনো ব্যাঙ কি তার এ ডাক শুনতে পাচ্ছে?
লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক।
Advertisement
এইচআর/জিকেএস