ভ্রমণ

সমুদ্রে ভেসে আছে এক দেশ, জনসংখ্যা ৩ জন

সুবর্ণা জামান

Advertisement

মাত্র ৫৫০ স্কোয়ার মিটার আয়তনের দেশের বাসিন্দা মাত্র ৩ জন। আছে নিজস্ব পতাকা, পাসপোর্ট এমনকি মুদ্রা ও রাজধানী। এই তথ্যগুলো আপনার কপালের ভাঁজ দীর্ঘ করলেও এটা কোনো রূপকথার গল্প নয়। বাস্তবে এখনো আছে এই দেশটি। বিশ্বের ক্ষুদ্রতম দেশ এটি। এর রাজধানীর নাম এইচ এম ফোর্ট। মুদ্রার নাম সিল্যান্ড ডলার। বাইরের কোনো দেশে এই মুদ্রা চলে না।

বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ কোনটি? এর জবাবে কিছু না ভেবেই যে কেউ বলবেন ভ্যাটিকান সিটি। তবে বর্তমানে সিল্যান্ডই বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ। বর্তমানে ৩ জন মানুষের বাস হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে ১৫০-৩০০ সেনা বসবাস করত। তবে যুদ্ধের পর সিল্যান্ডের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। সেসময় এই স্থানটিকে হেলিকপ্টারের ল্যান্ডিং প্যাড হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

৩ জন মানুষের বসবাস এই দেশে। অথচ তাদের জন্য রয়েছে নিজস্ব মুদ্রা, পাসপোর্টসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা। প্রিন্সিপ্যালিটি অব সিল্যান্ড নামের দেশটির অবস্থান ব্রিটেনের সাফল্ক সমুদ্রের ধারে। দেশটি আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত একটি সমুদ্র বন্দর। যা সে সময় রয়্যাল নেভি ব্যবহার করত।

Advertisement

জার্মান সেনারা যেকোনো সময় ইংল্যান্ড আক্রমণ করতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই ব্রিটিশ সেনা ইংল্যান্ড উপকূলে দূর্গ বানানোর পরিকল্পনা করে। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী উপকূল থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে বানানো হয় মাউনসেল সি ফোর্ট। একটি ফুটবল মাঠের সমান এ দেশটির অবকাঠামো গড়ে ওঠে একটি বিশাল ডুবন্ত জাহাজের উপরে।

১৯৪২ সালে প্রথমে একটি ফেরির ন্যায় বিশাল ভাসমান সমতল জাহাজ নেওয়া হয়। এরপর এর উপরে পাটাতন যুক্ত দু’টি কংক্রিটের ফাঁপা টাওয়ার যুক্ত করা হয়। যাতে এর উপরে অন্যান্য কাঠামো তৈরি করা যায়। এই দুই টাওয়ারের প্রতিটি ছিল মোট সাত তলা করে। এগুলো খাবার ও ঘুমানোর ঘর, গুদাম ঘর ও নানা যুদ্ধোপকরণ রাখার কাজে ব্যবহৃত হতো।

এর নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর তিনটি টাগবোটের সাহায্যে একে ‘রাফ স্টান্ড’ বালুতটে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে নিয়ে আসার পর এটির সেই বিশাল সমতল জাহাজটিকে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সেটি উপরের গোটা কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। উপরে সমস্ত কাঠামোর ক্ষেত্রফল ১৫X৪০ গজ। এখান থেকে শত্রুদের রণতরীর উপর নজরদারি চালানো হত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে অন্যান্য অসংখ্য দুর্গের সঙ্গে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এটিকেও পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। এরপরই ১৯৬৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ নাগরিক মেজর প্যাডজ রয় বেটস ও তার পরিবার এই দ্বীপের স্বত্বাধিকারী হন। তারপর তারাই একে স্বাধীন মাইক্রো রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। পৃথিবীর কোনো দেশে এখনও সিল্যান্ডকে স্বীকৃতি না দিলেও বিরোধিতাও করেনি।

Advertisement

মজার কথা হলো, জনসংখ্যার ৩ জনই বেটস পরিবারের সদস্য। তারাই দেশের রাজা, রানি ও রাজপুত্র। প্রায় ৫০ বছর ধরে এই পরিবারই সিল্যান্ডের বাসিন্দা। মূলত মেজর প্যাডজ রয় বেটস তার স্ত্রীকে এই দেশটি উপহার দিয়েছিলেন। যা জোয়ান বেটস খুবই পছন্দ করেন এবং বাকি জীবন এখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তারা তাদের দুই পুত্রকে নিয়ে এখানে চলে আসেন।

এরপর ১৯৭০ সালের দিকে এখানে ৫০ জন মানুষ বাইরের বিভিন্ন জায়গা থেকে থাকতে আসে। যারা বেশিরভাগই ছিলেন বেটসের বন্ধু এবং তাদের পরিবার। যারা যুক্তরাজ্যের বাইরে এসে নিজেদের মতো করে বাঁচতে চায়। সেসময় এখানে বেশ কয়েকটি ঘর তৈরি করা হয়। রান্নাঘরই হয়েছিল ১০টি। সেইসঙ্গে থাকার ঘর। বিদ্যুৎ সরবারহ করা হয়। নিয়মিত এখানে নৌকায় করে খাবার, পানীয়, খবরের কাগজ আসত। তবে ধীরে ধীরে তা আসা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৭৮ সালে আলেকজান্ডার অচেনবাচ নামের এক ব্যক্তি এখানে আসেন। তিনি নিজেকে সিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী দাবি করে বসেন। বেটসের পুত্র মাইকেলকে তিনি জিম্মি করে রাখেন ৪ দিন। সেসময় মেজর বেটস কাজে সিল্যান্ডের বাইরে গিয়েছিলেন। মেজর এসে পাল্টা আক্রমণ করায় তারা পালিয়ে যায়। এরা সবাই ছিলেন জার্মানের নাগরিক।

সিল্যান্ড কখনোই নিরাপদ ছিল না। কেননা দেশটির উপর নজর ছিল সবারই। ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে আরেক অবৈধ বেতার সম্প্রচারকারী রয় বেটস এখানের আগের অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে এই স্থানটি দখল করে নেয়। রয় বেটস এর আগে ‘রেডিও এসেক্স’ নামের আরেকটি অবৈধ বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করতো। তবে এটি ৩-মাইল ব্রিটিশ এলাকার মধ্যে হওয়ার একসময় বেটস ধরা পড়ে যায় ও তাকে জরিমানা দিতে হয়।

ফলে বেটস তার সমস্ত যন্ত্রপাতি ও ১৫ বছর বয়সী ছেলে মাইকেলকে নিয়ে রাফস টাওয়ারে এসে ওঠে ও দীর্ঘ এক লড়াইয়ের পর এটি দখল করে নেয়। কিন্তু তবুও এই টাওয়ারটি পরবর্তীতে আর পরিপূর্ণভাবে বেতারকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ ১৯৮০ সালে সমুদ্র আইনে কিছু পরিবর্তন এসেছিল। আর সেই পরিবর্তন অনুসারে ব্রিটিশ এলাকার বাইরের বেতার সম্প্রচারগুলো অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

১৯৬৮ সালে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সিল্যান্ডের কাছাকাছি থাকা কিছু পুরানো সামরিক টাওয়ার ধ্বংস করতে হেলিকপ্টার এবং নৌকা পাঠিয়েছিল। রখন তারা সেখানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে টাওয়ারগুলো ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তবে ধোঁয়া আর শব্দ শুনে বেটস পরিবার খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছিল।

কেননা এর আগে বহুবার বিভিন্নভাবে তাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। নিজেদের বাঁচাতে আর শত্রুদের সতর্ক করতে বেটসের ছেলে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এতে তড়িঘড়ি করে সৈন্যরা যুক্তরাজ্যের দিকে পালিয়ে যায়। পরে অবশ্য প্যাডি রায় রেটস এবং মাইকেল বেটসকে তাদের কর্মের জবাব দেওয়ার জন্য মূল ভূ-খণ্ডে ডাকা হয়েছিল।

যেহেতু সিল্যান্ড ব্রিটিশ ভূখণ্ডের বাইরে ছিল, তাই তাদের কোনো বিচার হয়নি। একজন বিচারক বলেছিলেন, তারা যেহেতু আলাদা ভূখণ্ডের। তাই এই দেশের শাস্তি দেয়া যায় না। এ ছাড়াও এটি যুক্তরাজ্যের আদালতের কোনো এখতিয়ার নেই। বেটস পরিবার একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে সিল্যান্ডকে মনে ধারণ করেছিল।

যদিও ব্রিটিশ সরকার তাতে দ্বিমত পোষণ করেছিল। এমনকি ইংল্যান্ডের খুব কাছে সিল্যান্ডের অবস্থান হওয়ায় এটিকে ইংল্যান্ডের পূর্ব উপকূলের কিউবা হিসেবে ধরেন তারা। তবে সিল্যান্ড পুরোপুরি স্বাধীন একটি দেশ। যেখানে ২০১২ সালে মেজর বেটসের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী এবং দুই পুত্র বসবাস করছেন।

বর্তমানে সিল্যান্ডকে পরিচালনা করেন প্রিন্স মাইকেল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও সিল্যান্ড কিছু ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে একবার বেটস পরিবারকে পাসপোর্ট জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। পরে অবশ্য তাদের সিল্যান্ড পাসপোর্টগুলো পুনরায় ফিরিয়ে দেয় ব্রিটিশরা।

২০০৬ সালে সিলল্যান্ডে একটি অগ্নিকাণ্ড মূল বিদ্যুত জেনারেটরটিকে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। যা আবারো ঠিকঠাক করে ব্যবহার করছেন তারা। বর্তমানে পৃথিবীর কোনো দেশ সিল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব ও বৈধতার স্বীকৃতি না দিলেও এটি বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। সিল্যান্ডে আছে একটি মাত্র ভবন ও একটি হেলিপ্যাড। 

ইন্টারনেটে সিল্যান্ডের নিজস্ব একটি ওয়েবসাইটও আছে। সেখানে সিল্যান্ডের নানা স্মারক, ডাকটিকিট, মুদ্রা ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও আপনি চাইলে সিল্যান্ডের লর্ড, ব্যারন, কাউন্ট প্রভৃতি পদবী কিনতে পারবেন। সেই সঙ্গে সিল্যান্ডের পাসপোর্ট করে চাইলে ঘুরেও আসতে পারবেন দেশটি থেকে।

যদিও ২০০৭ সালে প্রিন্স মাইকেল সিল্যান্ড বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। অনেকে আগ্রহ দেখানোর পরও মাইকেল তাদের কাছে বিক্রি করেননি। তার মনে হয়েছে এরা এখানে এসে বিশৃঙ্খলা করবে। যা সিলল্যান্ডের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে হুমকি স্বরূপ। এই ভূখণ্ডে শুধুমাত্র কর্মচারী, সাংবাদিক এবং বাটস পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। তবে যারাই সেখানে এসেছেন মুগ্ধ হয়েছেন। তাদের মতে, এতো সুন্দর জায়গা পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

সূত্র: অ্যামিউজিং প্ল্যানেট

জেএমএস/এএসএম