ইসরায়েলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ১২ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে। সেখানে আটটি দল মিলে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে চলতি জুনে এবং তাদের চুক্তি অনুযায়ী ডানপন্থী দল ইয়ামিনা পার্টির প্রধান নাফতালি বেনেত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর তিনি ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট মধ্যপন্থী দল ইয়েশ আতিদ পার্টির নেতা ইয়াইর লাপিদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।
Advertisement
এই দলগুলোর মধ্যে নীতিগত অমিল থাকলেও নেহানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে হটানোর ব্যাপারে তারা একমত। নেতানিয়াহু এখনও রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন এবং বলছেন যে তিনি আবারও ক্ষমতায় আসবেন। বর্তমানে দুর্নীতির মামলায় তিনি বিচারাধীন রয়েছেন। গত মার্চে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নেহানিয়াহু চূড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হন। সেটি ছিল গত দুই বছরে দেশটিতে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচন, যার পর তিনি জোট গঠনের জন্য মিত্র পেতে ব্যর্থ হন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে নেতানিয়াহুর পরিবর্তন কি ফিলিস্তিনে শান্তি আনতে পারবে? বিশ্লেষকরা তা মনে করেন না। কারণ নতুন প্রধানমন্ত্রীও নীতিগতভাবে ফিলিস্তিনিদের বিরোধী। ফিলিস্তিনে আদৌ শান্তি আসবে কি-না সেটি আবারও আলোচনায় সামনে এসেছে। গত মে মাসে লড়াইয়ে ২৪২ ফিলিস্তিনি এবং ১০ ইসরায়েলির নিহত হওয়ার পরের দফার লড়াইয়ের মাঠ পরিষ্কার করা ছাড়া কিছুই অর্জন করতে পারেনি।
আমেরিকা তিন দশক আগে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আলোচনার তদারকি শুরু করেছিল। তবে পবিত্র ভূমির দুই দল লোক এমন রক্তক্ষয়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছে যে তাদের মেলানো যাচ্ছে না। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল- দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার করা। সে চুক্তিতে জমিবিনিময়, নিরাপত্তা গ্যারান্টি, জেরুজালেমকে দু’পক্ষ মিলে ব্যবহার করা এবং ফিলিস্তিনিদের সীমিত ‘প্রত্যাবর্তনের অধিকার’ ছিল। ইসরায়েল এটিকে পুরষ্কার ভেবেছিল- একটি সমৃদ্ধ গণতন্ত্র এবং ইহুদিদের জন্য একটি অভয়ারণ্যের সুযোগ আসছে মনে করে। আর ফিলিস্তিনিদের কাছে এটি ছিল স্ব-শাসনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। কিন্তু এর কিছুই হয়নি কারও জন্য। দুই-রাষ্ট্রনীতির প্রক্রিয়া বার বার ব্যাহত হয়েছে।
Advertisement
দুই-রাষ্ট্রের চিন্তা এখন ক্রমেই স্বপ্নধরা হয়ে যাচ্ছে, যদিও এটি মানতে অনেকেই আগ্রহী হবেন না। অসলো চুক্তির অধীনে একটি বাস্তব, স্বচ্ছল, সার্বভৌম প্যালেস্টাইনের আকাঙ্ক্ষা এখন হ্রাস পেয়েছে। পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনি অঞ্চলটি ক্রমশ ইসরায়েলি জনবসতিতে ভরে যাচ্ছে। প্রায় আট লাখ ইহুদি অবৈধ আবাস গড়েছে সেখানে, যা জাতিসংঘের চোখে এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ।
মিশর এবং ইসরায়েলের অবরোধে গাজা পরিণত হয়েছে একটি অবরুদ্ধ দ্বীপে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ একটি অপেক্ষমাণ সরকার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তরুণ ফিলিস্তিনিরা তাকে বিবেচনা করছে দখলদার ইসরায়েলের এজেন্ট হিসেবে। এমনকি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য গাজাকে শাসনকারী হিংসাত্মক ইসলামপন্থী দল হামাসের প্রশংসা করেছে তারা।
ফিলিস্তিনে বৈধ সরকার নেই অনেক বছর। মাহমুদ আব্বাস রাষ্ট্রপতি হিসেবে চার বছরের মেয়াদে ক্ষমতায় বসে ১৭ বছর রয়েছেন। তার ফাতাহ পার্টির বেহাল দশা। হামাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ নারী ও সংখ্যালঘুসহ তার জনগণের অধিকারকে পদদলিত করছে। নিজেরা গণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহি প্রশাসন না চালালে ইসরায়েলের কাছে তারা জবাবদিহির দাবি কী করে করবে!
২০১৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রশ্নে এক নতুন প্রস্তাব রেখেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন, এই দুই রাষ্ট্র শান্তি ও নিরাপদে পাশাপাশি অবস্থান করবে- মার্কিন সরকারের এই নীতি থেকে সরে এসে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পাশে রেখে বলেন, ‘আমি দুই-রাষ্ট্র ও এক-রাষ্ট্র, উভয়ই (প্রস্তাব) বিবেচনায় রাখছি। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন যে প্রস্তাবে খুশি, আমি তাকেই সমর্থন করব।’
Advertisement
অথচ এই দুই-রাষ্ট্রনীতি কাগজে-কলমে এখন পর্যন্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, জাতিসংঘ, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমর্থন করে আসছে। এই চার পক্ষকে নিয়ে গঠিত ‘কোয়ার্ট্রেট’-এর মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আলোচনার মূলভিত্তিও হচ্ছে দুই-রাষ্ট্রনীতি। ২০০৯ সালের এক ভাষণে তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু শর্তসাপেক্ষে কোয়ার্ট্রেটের প্রস্তাবিত ‘রোড ম্যাপ’-এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন।
অবশ্য, আগপাছ বিবেচনা না করে, মিত্রদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এককথায় মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রশ্নে আন্তর্জাতিক কূটনীতির সেই মূলভিত্তিকে এককভাবে বদলানোর পক্ষে মত দিলেও তার বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন বক্তব্য দেন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হেইলি। জাতিসংঘ সদরদফতরে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দুই-রাষ্ট্রনীতির প্রতি সম্পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ, যারা ভাবে আমরা এই নীতি সমর্থন করি না, তারা ভুল ভাবে।’
বর্তমান বাইডেন প্রশাসনও দুই-রাষ্ট্রনীতির পক্ষে কথা বলে কিন্তু এই নীতি থেকে যে ইসরায়েল অনেক দূর সরে গেছে সে সম্পর্কে কিছু বলে না। শান্তি সবসময় বাস্তবতা স্বীকার করেই শুরু করতে হয়। রাজনীতিকে যুগপোযোগী, জীবনকে উন্নত করার মাধ্যমে এর মূলভিত্তি তৈরি হয়। এই ছাড়া শান্তি বিকাশ লাভ করতে পারে না। ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নতুন করে কথা বলা শুরু করতে হবে- সেখানে তারা ঠিক করবে এক রাষ্ট্র নাকি দুই রাষ্ট্রনীতিতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনে শান্তি আসবে।
তবে অসলো ত্যাগ করাকে, মানে একক রাষ্ট্রের দিকে গেলে এখন স্পষ্টই তা ঝুঁকি মনে হতে পারে দু’পক্ষের। কাঁটাতারের ঘেরার বাইরে যেসব ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা আছে, তারা ফিলিস্তিনের আরও বেশি ভূখণ্ডের দখল নিয়ে ঠেলাঠেলি করতে পারে মনে করতে পারে ফিলিস্তিনিরা। আবার ইসরাইল মনে করতে পারে ফিলিস্তিনিরা ইহুদিদের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে হামাস যেখানে তার প্রতিরোধকে দ্বিগুণ করতে পারে। এর জন্য দরকার কূটনৈতিক মাধ্যমে শান্তি চাপানোর পরিবর্তে আরও বাস্তববাদী লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা।
বুঝতে হবে, ইসরায়েল আগামীকালই ফিলিস্তিনিদের পুরো অধিকার প্রদান করবে না। তবে ফিলিস্তিনিদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটাতে পারে এবং যুদ্ধ লাগানোর ইস্যুগুলো যাতে ঘটতে না পারে সে জন্য প্রশাসনকে আরও বেশি সজাগ রাখতে পারে। অবশ্যই পশ্চিমতীর এবং গাজায় যে দুর্ভোগ তার দায়দায়িত্ব ইসরায়েলকে নিতে হবে- এবং এটি নিরসনে তাদের আরও কঠোর পরিশ্রম করা উচিত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com
এইচআর/এমকেএইচ