ভ্রমণ

বান্দরবানের মারায়ন তং পাহাড় চূড়ায় এক রাত

নুরুল করিম

Advertisement

পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আটকে থাকা প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম মারায়ন তং জাদির চূড়ায়। ততক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। চারপাশে শুধু অন্ধকার, বিন্দুমাত্র আলোর নাম-নিশানা নেই। অথচ আকাশের দিকে তাকিয়েই ‘হা’ হয়ে গেলাম! চোখে ধরা দিচ্ছে সুবিন্যস্ত ছায়াপথ। তারাগুলোর দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে যেন মহাশূন্যে আছি! আমরা তাঁবু গেড়েছিলাম ঠিক লাখো তারার নিচে। সেই তারাদের সঙ্গেই রাতভর গল্প জমেছিল অচেনা এক গাছে হেলান দিয়ে।

লাখো তারাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে থাকলাম এদিক-ওদিক। তখন রাত ৩টা। হুট করেই প্রবল স্পর্শকাতর অনুভূতি হয় পুরো শরীরে। যেন শীতল কিছু একটা ছুঁয়ে দিয়ে গেছে। পরক্ষণে বুঝতে পারলাম, একখণ্ড মেঘ এসে দারুণ একটা অনুভূতি দিয়ে চলে গেছে। আর তাতেই অপেক্ষা বেড়ে গেল সকালের জন্য। আগেই জানা ছিল সকালে মেঘের সমুদ্রে ভাসবো আমরা!

ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মনে হচ্ছিলো সাদা জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। কাছে-দূরের সব পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মেঘ জমে আছে। সোনালি আলোয় ভেসে যাচ্ছিল পুরো উপত্যকা। আর একটু পর দেখলাম, সূর্যটা নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রতিটা ক্ষণেরই আলাদা রূপ। আমরা বেলায় বেলায় মারায়ন তং জাদির বদলে যাওয়ার রূপ দেখেছি।

Advertisement

মেঘ দেখতে আমরা দার্জিলিং যাই, শিলং যাই কিংবা দেশের ওভাররেটেড জায়গা সাজেক যাই; কিন্তু কে জানত, দেশের মধ্যেই এমন জায়গা আছে, যেখানে সত্যিকারের মেঘ এসে নিত্য ভিজিয়ে দেয়, ঝাপসা করে দেয় চারদিক! পাহাড়ের কোলে জমে থাকা মেঘগুলোকে মনে হয় নদী কিংবা জলাশয়। এই যেন আপনি ডুবে গেলেন!

মারায়ন তং জাদিতে দাঁড়িয়ে এমন সুখ পাওয়া কেবলই রোমাঞ্চকর নয়; বরং সেখানে চ্যালেঞ্জটাই মুখ্য। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই পাহাড়ের উচ্চতা ১৬৬০ ফুট। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে নৈসর্গিক রূপ দেখার তীব্র লালসায় আমরা চারজন ছুটে যাই বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার মারায়ন তং জাদি পাহাড়ে।

এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে আমাদের হাঁটতে হয়েছিল প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা। গুনতে হয়েছে সর্বমোট ৫টি ট্রেইল, যার মধ্যে সবচেয়ে খাড়া ট্রেইলটা ৭২ ডিগ্রি কোণে ভূমি থেকে চূড়ার দিকে চলে গিয়েছে। যেখানে কোথাও এক ফুটের জন্য রাস্তা নিচের দিকে নামেনি! ট্রেইলের শুরু থেকে একদম চূড়া পর্যন্ত পুরোটাই খাড়া রাস্তা।

চূড়ায় উঠে প্রথমেই চোখে পড়ে বিশাল এক জাদি। বৌদ্ধদের পূজা-অর্চনার জন্য বানানো বুদ্ধমূর্তিকেই মূলত জাদি বলা হয়। এমনভাবে জাদিটি বানানো হয়েছে, যেন দূরের কোনো প্রকৃতির রহস্য নিয়ে ভাবছে আর স্মিত হাসি ফুটে উঠছে তার ঠোঁটে। জাদির চারদিকে খোলা ও ওপরের দিকে চালা।

Advertisement

খাড়া পথ বেয়ে পাহাড়টি উঠতে হলেও এর উপরের অংশ সমতল। এর নিচে সাপের মতো এঁকে-বেঁকে বয়ে চলেছে মাতামুহুরী নদী। কান পাতলে শোনা যেতে পারে বঙ্গোপসাগরের গর্জন। এখান থেকে যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সেসবের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় জুমঘর। এতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। এদের মধ্যে ত্রিপুরা, মারমা ও মুরং অন্যতম।

মারায়ন তং জাদির ঠিক নিচেই মারমাদের বসবাস। তারা বেশ সাহস নিয়ে থাকে সেখানে। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক করবে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আটকে থাকা মুরংদের ঘরগুলো। মাটি থেকে সামান্য ওপরে এদের টংঘর। এসব ঘরের নিচে থাকে বিভিন্ন গবাদি পশু যেমন-গরু, ছাগল, শূকর ও মুরগি। কখনো গবাদি পশুর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জ্বালানি কাঠও রাখা হয় স্তূপ করে।

এখানকার দিনের বেশিরভাগ সময়ই অলস কাটে। তাঁবু বা খোলা জায়গায় বসে বা শুয়ে মেঘের আনাগোনা দেখে, নয়তো বই পড়েই সময় পার করে দেওয়া যায়। হঠাৎ এক টুকরো মেঘ অথবা বৃষ্টি এসে বড়জোর ভিজিয়ে দিয়ে যাবে। এভাবেই বদলে যায় দৃশ্যপট। রোজ সকাল আর বিকেলের দিকে আদিবাসী ঘর থেকে ভেসে আসে সুমধুর গান। তাদের নিজস্ব ভাষা ও সুরের।

যাওয়া ও থাকা

ঢাকা থেকে আলীকদম সরাসরি বাস যায়। বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন রকম বাস রয়েছে। ভাড়া ৮৫০ টাকা থেকে শুরু। রাত ৮-১০টার মধ্যে বাসগুলো ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়, পৌঁছায় সকালে। আপনাকে নামতে হবে আলীকদমের আবাসিক রাস্তার মাথায়। এখান থেকেই যাত্রা শুরু।

সেখান থেকে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই মারায়ন তং যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিবে। সেখান থেকে হেটে মারায়ন তং পাহাড় চূড়ায় পৌঁছতে ২ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। তবে কারও কারও সময় আরও বেশি লাগতে পারে।

মারায়ন তং পাহাড়ে মূলত সবাই যায় ক্যাম্পিং করার জন্য। কাজেই সেটি মাথায় রেখে পরিকল্পনা করাই ভালো। তবে আপনার যদি আলীকদমে থাকার প্রয়োজন হয়ে তাহলে উপজেলা রোডের ‘দ্যা দামতুয়া ইন হোটেল’ অথবা ‘জেলা পরিষদের ডাক বাংলো’তে থাকতে পারবেন। এছাড়া পান বাজারে সাধারণ মানের একটি বোর্ডিং আছে।

পরামর্শ ও সতর্কতা

পাহাড়ে যাওয়ার সময় পর্যাপ্ত পানি, স্যালাইন, গ্লুকোজ, শুকনো খাবার, ফাস্ট এইড বক্স ও দরকারি ওষুধপত্র সঙ্গে রাখুন। ক্যাম্পিং করতে চাইলে একা না গিয়ে কমপক্ষে চার-পাঁচজন যাওয়া ভালো। ক্যাম্পিংয়ের জন্য তাঁবু, রান্নার উপকরণ ও সামগ্রী নিতে ভুলবেন না।

ট্রেকিংয়ের জন্য ট্রেকিং বুট ব্যবহার করুন। চাইলে প্লাস্টিক বা রাবারের স্যান্ডেল ব্যবহার করতে পারেন। অনুমতি না নিয়ে আদিবাসীদের ছবি তুলবেন না। আদিবাসীদের সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছুই করবেন না।

জেএমএস/এমএস