জাতীয়

ভারত-মালয়েশিয়া-দুবাইয়ে নারীপাচার চক্রের সমন্বয়ক নদী

দুবাইয়ে তার নাম লায়লা। পাচার হওয়া নারীদের কাছে তিনি নিজেকে নদী হিসেবে পরিচয় দিলেও ভারতে সবাই তাকে ইতি নামে জানেন। ভারতীয় আধার কার্ডে তার নাম জয়া আক্তার জান্নাত। পাসপোর্টে তার নাম নূরজাহান। সাতক্ষীরা সীমান্তে তার নাম জলি আর যশোর সীমান্তে তিনি প্রীতি নামে পরিচিত। নদীর বাড়ি মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে। তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

Advertisement

২০০৫ সালে শীর্ষ সন্ত্রাসী রাজীব হোসেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ২০১৫ সালে তার স্বামী রাজীব বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। এরপর তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন পাচারকারী চক্রের অন্যতম মূলহোতা।

গ্রেফতার নদী ভারত, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে নারী পাচার চক্রের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন। এই দেশগুলোতে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তিনি হিন্দি, আরবি, মালয়, তামিল ও ইংরেজি ভাষায় খুবই দক্ষ। তরুণীদের পটিয়ে পাচারকারী চক্রের ফাঁদে ফেলতে তার জুড়ি নেই।

পুলিশ বলছে, পাচারকারীদের হাতে পড়েছেন এমন বেশ কয়েকজন এরই মধ্যে জানিয়েছেন, নদীর মাধ্যমে ভারতে চাকরির অফার পেয়েছিলেন তারা। সেখানে গিয়ে তারা বুঝতে পারেন তাদের বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এই চক্রে নদী বড় ভূমিকা রেখেছেন।

Advertisement

আন্তর্জাতিক নারীপাচার চক্রের অন্যতম হোতা নদী আক্তার ইতি ওরফে জয়া আক্তার জান্নাত ওরফে নূরজাহানসহ (২৮) মানবপাচার চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করেছে তেজগাঁও বিভাগের হাতিরঝিল থানা পুলিশ।

নদী ছাড়া গ্রেফতার অন্যরা হলেন- মো. আল-আমিন হোসেন (২৮), মো. সাইফুল ইসলাম (২৮), আমিরুল ইসলাম (৩০), পলক মণ্ডল (২৬), মো. তরিকুল ইসলাম (২৬) ও বিনাশ শিকদার (৩৩)।

নদীর কাছ থেকে ভারতীয় দুটি আধার কার্ড, পাসপোর্ট, একটি পুরাতন ডায়েরি ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। এছাড়া দুই তরুণীর ৮টি পাসপোর্ট সাইজের ছবি ও ব্যাঙ্গালুর থেকে গোয়াগামী বিমানের দুটি টিকিটের প্রিন্টেড কপি জব্দ করা হয়েছে।

তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, নারীপাচার চক্রের অন্যতম হোতা নদী আক্তার ইতি ওরফে জয়া আক্তার জান্নাত ওরফে নূরজাহান ভারত, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে নারীপাচার চক্রের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করতেন। ভারত, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তার।

Advertisement

তিনি বলেন, টিকটক বাবু চক্রের সদস্য হিসেবে নদী দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। টার্গেট করা নারীদের ফাঁসাতে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি নিজে যোগাযোগ করেন। ভারতে নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা অন্তত পাঁচ তরুণী ঢাকার হাতিরঝিল থানায় যে মামলা করেছেন, সেখানেও আসামির তালিকায় নদীর নাম রয়েছে। সর্বশেষ শনিবার ভারতফেরত তিন তরুণী মামলা করেন, যাতে নদীকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে।

এডিসি হাফিজ আল ফারুক আরও বলেন, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পুলিশের তদন্তেও নদীর নাম উঠে এসেছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আন্তর্জাতিক নারীপাচার চক্রের আরও তথ্য জানা যাবে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ভারত থেকে পালিয়ে আসা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত নদীর ১০টির মতো নাম পাওয়া গেছে। ভারতে গ্রেফতার হৃদয় বাবু ওরফে টিকটক হৃদয়, সাগর, সবুজ, বাবু শেখ ও রাফছান এবং যশোর ও সাতক্ষীরা সীমান্তের ইসরাফিল হোসেন খোকন, আব্দুল হাই সবুজ, আল আমিন, তরিকুল, মেহেদী হাসান বাবু, আনিছের সঙ্গে নদীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

তিনি বলেন, ব্যাঙ্গালুরে অবস্থানরত তাসলিমা ওরফে বিউটির সঙ্গে নদীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের মামলায় ভিকটিমের স্বামী জাহিদুল ইসলাম রনি নদী আক্তারের কাছে চল্লিশ হাজার টাকার বিনিময়ে ভারতে পাচারের জন্য তাকে বিক্রি করে বলে অভিযোগে করেছেন। হাতিরঝিল থানায় আরেক মামলায় ভিকটিমের বড় বোন ও খালাকে নদী আক্তার তার বাংলাদেশ ও ভারতে অবস্থানরত সহযোগীদের মাধ্যমে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ করেছে।

নির্যাতনের শিকার তরুণী ও পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িতদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে কি-না জানতে চাইলে ডিসি তেজগাঁও বলেন, ভারতে নারী নির্যাতন ও নারীপাচারের ঘটনায় উভয় দেশেই মামলা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতারে ভারতীয় পুলিশ আমাদের সহযোগিতা করছে। আমরাও এ বিষয়ে আমাদের কাছে থাকা সব তথ্য তাদের দিচ্ছি- যাতে চক্রের হোতাদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনা যায়। পাশাপাশি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে নির্যাতনের শিকার তরুণী এবং এ ঘটনায় জড়িতদের দেশে আনতে পুলিশ সদরদফতরের এনসিবি শাখার মাধ্যমে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

নদীর সঙ্গে টিকটক হৃদয়ের ঘনিষ্ঠতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদী, হৃদয় বাবুসহ আরও দুয়েকজনের নাম আগে উল্লেখ করেছিলাম। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের সহযোগিতায় তারা পাচার করেছে।

ভারতে যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে ওই ভিডিওর সঙ্গে নদীর সম্পৃক্ততা কতটুকু জানতে চাইলে তেজগাঁও ডিসি বলেন, টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে যেহেতু নদীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেহেতু ওই ভিডিওর সঙ্গেও নদীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।

টিটি/এআরএ/জিকেএস