দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে, দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমন ক্রান্তিকাল আর আসেনি। বর্তমান সময়ে এসে বিএনপি সরকারবিরোধী রাজনীতিতে যেমন সফল হতে পারছে না, তেমনি জোট রাজনীতি বা দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও দেখাতে পারছে না কোনো চমক।
Advertisement
দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকলেও অতীতে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তারা যতটা কর্মচঞ্চল ছিল বর্তমানে তেমনটিও দেখা যাচ্ছে না। এখন কার্যত দলের নিয়ন্ত্রণ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের কাছে থাকায় বিএনপি অনেকটাই নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। তার নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে দলে রয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। বলা হচ্ছে, দলে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করার ফলে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কিছু পদ শূন্য। পাশাপাশি অঙ্গ সহযোগী সংগঠন এবং বিএনপিপন্থী পেশাজীবী সংগঠনেরও করুণ দশা। তবে দায়িত্বশীলদের দাবি, দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলমান। এ প্রক্রিয়ায় ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রফিক শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব সময় দেখা গেছে যে অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করার কারণে অনেক সময় সঠিকভাবে কাজ হয়নি। আমাদের এই কমিটিতেও অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীকে মূল্যায়ন করা হয়নি এবং ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয় না বলেই কখনো কখনো আন্দোলন সফল হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত একটা রাজনৈতিক দল ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত সেই রাজনৈতিক দল সত্যিকার অর্থে যৌক্তিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্যপদ কেন পূরণ হচ্ছে না আমি জানি না। নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করার ফলে দলের স্তরে স্তরে ঘাটতি তৈরি হয়। ত্যাগী নেতাদের যখন মূল্যায়ন করা হয় না, তখন নতুন করে ত্যাগী নেতা তৈরি হয় না। তাদের দেখে নতুন করে কেউ ত্যাগী হতে চায় না। এতে সংগঠনগুলো দুর্বল হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে আন্দোলন বা মুভমেন্ট করতে গেলে সেটা আর পারে না। রাজনীতি হলো- ফুটবল ক্রিকেটের মতো, অনুশীলন করতে হয়।’
Advertisement
নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বাধা প্রসঙ্গে রফিক শিকদার বলেন, ‘সত্যের সঙ্গে মিথ্যার একটা লড়াই চলে, ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের লড়াই আছে। সেখানেই আমি বলবো যে, রাজনীতিবিদরা বোধ হয় হেরে যাচ্ছেন অরাজনীতিকদের কাছে। সেখানেই বাধা, সামগ্রিক রাজনীতি এটার জন্য দায়ী। রাজনীতিবিদদের হাতে যদি রাজনীতি যায়, তাহলে রাজনীতি সঠিকভাবে চলে।’
বিএনপির চিকিৎসক সংগঠন ড্যাবের নেতা ডা. মাজহারুল ইসলাম দোলন বলেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, যারা দুঃসময়ে কাজ করে তাদের মূল্যায়ন করা হয় না, এ কারণে আজকে মাঠের এ অবস্থা। আমরা নামাজ পড়ি বেহেশতে যাওয়ার জন্য। দলের নেতাকর্মীরা কাজ করি পরবর্তীতে মূল্যায়ন করা হবে ভেবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দলের দুঃসময়ে যারা কাজ করি সুসময়ে আমাদের মূল্যায়ন করা হয় না। এজন্য মাঠে লোক পাওয়া যায় না। দলের ত্যাগী নেতাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে না। এ নিয়ে নেতার (তারেক রহমান) সঙ্গে বহু ঝগড়া করেছি, আর করতে চাই না। অবমূল্যায়নের কারণে মাঠে এখন লোক পাওয়া যায় না। এর দায় নেতাকেই নিতে হবে।’
নির্বাহী কমিটির সদস্য একরামুল কবির বিপ্লব বলেন, ‘নেতৃবৃন্দ যে সিদ্ধান্ত নেন সেটা বাস্তবায়ন করা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাজ। কিন্তু তৃণমূলের নেতাকর্মীদের একান্ত ভাবনা একান্তেই থাকে, সেটা আর প্রকাশ হয় না।’ বিএনপির গত নির্বাহী কমিটির সহ-দফতর সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করলেও বর্তমান কমিটিতে পদাবনমিত হয়েছেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দলে তারেক রহমানের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মূলত অভিজ্ঞ নেতৃত্বকে কোণঠাসা করা হচ্ছে, যা বিএনপির জন্য মোটেও শুভ নয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে চরম ব্যর্থতার পর দল পুনর্গঠনের চেষ্টা চলছে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের নির্দেশনায়। তার নির্দেশনা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে রয়েছে নানা অসন্তোষ। দলের মহাসচিব ও সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিবের মধ্যে যে রাজনৈতিক দূরত্ব তার জন্যও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনই দায়ী। ফলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের মহাসচিব হলেও কার্যত ক্ষমতা শূন্যের কোটায়। তার ক্ষমতা নিয়ে দলের সর্বস্তরের নেতাদের মধ্যেও সন্দেহ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের যথার্থ মূল্যায়ন না হওয়ায় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় কমিটির বেশকিছু পদ খালি। সবশেষ স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে আরও একটি পদ শূন্য হলো। এছাড়া বেশ কয়েকজন সদস্য অসুস্থ থাকায় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থিতি খুবই কম দেখা যায়। এমতাবস্থায় দলের ত্যাগী, অভিজ্ঞ নেতাদের দিয়ে স্থায়ী কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণের কথা বারবার বলা হলেও তা হচ্ছে না। অনেকেই মনে করেন দলের অভিজ্ঞ ও প্রবীণ নেতৃত্বের প্রতি বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের আস্থা খুবই কম। সে কারণেই তিনি এই শূন্য পদগুলো পূরণ করতে চাচ্ছেন না। বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির পাঁচটি পদ শূন্য। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান চাইলে স্থায়ী কমিটিতে শূন্যপদ পূরণ করতে পারেন। এছাড়া দলে আরও বেশ কিছু শূন্য পদ রয়েছে। সেগুলোও পূরণ করতে পারেন। কিন্তু কেন করছেন না, তা কারও কাছে পরিষ্কার নয়।’
Advertisement
ওই নেতা আরও বলেন, ‘২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করেছিল বিএনপি। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় নির্বাহী কমিটি তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হবে এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাহী কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত এ কমিটিই দায়িত্ব পালন করবে। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জুনে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটির শূন্যপদে নিয়োগ দেয়া হয়। সেলিমা রহমানের নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক না থাকলেও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নিয়োগ নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে।
দলের প্রবীণ নেতারা প্রকাশ্যে এ নিয়োগের বিরোধিতা না করলেও তারা আর আগের মতো দলের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন না। কেউ কেউ একেবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। সুযোগ পেলে দলের বর্তমান নেতৃত্বের সমালোচনা করতে ছাড়েন না কেউ কেউ। আবার দু-তিনজন বাদ দিলে দলের স্থায়ী কমিটিতে এখন যারা আছেন তাদের যোগ্যতা ও অবস্থান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
ছাত্রদলের এক সময় সভাপতি থাকলেও বিএনপিতে পদাবনমিত হয়ে আছেন এমন এক নেতা বলেন, ‘দলের স্থায়ী কমিটির যে পদগুলো ফাঁকা রয়েছে সেই পদগুলো পূরণের জন্য বিভিন্ন সময় আব্দুল্লাহ আল নোমান, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শাজাহান ওমর, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, শামসুজ্জামান দুদু, আসাদুজ্জামান রিপন, রিজভী আহমেদ, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, এজেডএম জাহিদ হোসেনদের মতো নাম নেতাকর্মীদের আলোচনায় এলেও তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এম মোরশেদ খান অভিমানে দল ত্যাগ করেছেন, আসাদুজ্জামান রিপনের সমসাময়িক বা জুনিয়ররা যুগ্ম-মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যান বা উপদেষ্টা পরিষদে জায়গা পেলেও তাকে বিশেষ সম্পাদক পদ দেয়া হয়েছে। শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির সম-সাময়িকরা যুগ্ম-মহাসচিব পর্যায়ে ঠাঁই পেলেও তাকে প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে। ফজলুল হক মিলন, নাজিম উদ্দিন আলম, শিরিন সুলতানা, আব্দুল লতিফ জনি, শামীমুর রহমান শামীম, আসাদুল করিম শাহীনসহ ছাত্রদলের সোনালি ফসলগুলোকে বিএনপি মূল্যায়ন করতে পারেনি এদের পদাবনমিত করা হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাহী কমিটির সদস্য থেকে রুমিন ফারহানাকে সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক এবং শামা ওবায়েদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে অতি মূল্যায়ন করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম ক্ষেত্র জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ছাত্রদলের অভিভাবক হচ্ছেন বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক। গত কমিটিতে শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এবং সুলতান সালাউদ্দিন টুকু যথাক্রমে ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক এবং সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেও বর্তমান কমিটিতে পদ দুটি ফাঁকা। ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক পদটি ঘিরে সর্বত্র একমাত্র বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের নাম আলোচনায় থাকলেও ওই পদটি মনে হচ্ছে এখন বিলুপ্তির পথে। ছাত্রদল কার্যত অভিভাবকহীন। অন্যান্য অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের মধ্যে জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি পদে সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুকে নিয়ে প্রত্যাশা ছিল নেতাকর্মীদের। সেখানে তাকে সাধারণ সম্পাদক করে বিতর্কিত একজনকে সভাপতি করা হয়েছে। নির্ধারিত কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও যুবদল পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি। কৃষিনির্ভর, শ্রমনির্ভর এই দেশে কৃষক দল এবং শ্রমিক দলের পরিস্থিতি দেখলে বুক ফেটে কান্না আসে। স্বেচ্ছাসেবক দল, তাঁতী দল, ওলামা দল কার্যত নামসর্বস্ব সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ড্যাব-অ্যাব-জাসাস নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব সারাদেশের দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে তো দূরের বিষয়, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছেও খুব বেশি পরিচিত নন।’
বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য বলেন, ‘জান কোরবান করে যারা রাজপথে, তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। মাঠে কী করলেন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কী আছে, নেতৃত্বের প্রতি আপনার কী আনুগত্য আছে সেগুলো বিএনপিতে বিচার করা হচ্ছে না, বিচার করা হচ্ছে টাকা। শোনা যায়, দেখি নাই; টাকা দিলে নাকি বিএনপিতে বড় বড় পদ পাওয়া যায়। এছাড়া পরিবারতন্ত্র চর্চা চরম আকার ধারণ করেছে। যারা অতীতে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন বা দলের দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন তারা তাদের স্ত্রী, সন্তান, পুত্রবধূদের অতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রকৃত অর্থে ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করছেন।’
তিনি বলেন, ‘সারাদেশে দল সেভাবে নেতাকর্মী সৃষ্টি করতে পারেনি। চট্টগ্রামে দুজনের খামখেয়ালি মেনে নিয়ে নেতাকর্মীদের দল করতে হয়। কুমিল্লায় এক ‘স্যার’ আছেন যার একারই লাগে তিনটি আসন। সেখানে নেতাকর্মী সৃষ্টি হবে কীভাবে? দল সিলেট বিভাগে সাইফুর রহমানের মতো নেতৃত্ব আর তৈরি করতে পারেনি। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে তাবিথ আউয়াল এবং ইশরাক হোসেনদের মতো জুনিয়ররা সভামঞ্চে জায়গা করে নিচ্ছেন।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটিতে যেমন সুবিধাবাদীদের আধিক্য, তেমনি পেশাজীবী ও পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি নিয়েও রয়েছে নানা সমালোচনা। আইনাঙ্গনে এক সময় বিএনপির একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও নেতৃত্বের অভাবে এখন তাতে ভাটা পড়েছে। একসময় বিএনপির আইনজীবীদের নেতৃত্ব দিয়েছেন নাজমুল হুদা, মওদুদ আহমদ, জমিরউদ্দিন সরকার, খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমেদ, রফিকুল ইসলাম মিয়া। তাদের শূন্যতায় এখন আইজীবীরা বিভক্ত। এখন আইজীবীদের নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন, ফজলুর রহমান, কায়সার কামাল।
দলের একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘খন্দকার মাহবুব হোসেন জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপিতে এলেও এখনো বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। ফজলুর রহমান আওয়ামী লীগ থেকে কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ তারপর বিএনপি। মাঝে ১/১১-এর সময় ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর নেতৃত্বে পিডিপি গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের কারণে কায়সার কামালের গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোটায়।’
তিনি বলেন, ‘পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মধ্যে সাংবাদিক সমাজের প্রভাবও এখন কমতে শুরু করেছে। সর্বশেষ বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করা হলেও সেখানে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পাদককে দেখা যায়নি। আগে দু-একজন সম্পাদককে বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল দেখা গেলেও এখন আর তা দেখা যায় না। একসময় সাংবাদিকদের সংগঠনে বিএনপির আধিপত্য থাকলেও বর্তমানে বিএনপিপন্থী বিএফইউজে ও ডিইউজে প্রকারান্তরে জামায়াতপন্থীরাই নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান মিঞা, অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক ড. আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন, অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ, অধ্যাপক ড. মাহফুজ উল্লাহ একসময় বিএনপির শিক্ষক রাজনীতির ধারালো হাতিয়ার থাকলেও বর্তমানে বিএনপি থেকে অনেক দূরে সেখানকার নেতৃত্ব।’
দলের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে অনেকটাই জোড়াতালি দিয়ে চলছে বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি। এই কমিটিতে এমন সদস্যও আছেন, যাদের কেউ কেউ আন্তর্জাতিক কৌশল সম্পর্কেই জানেন না। এসব কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে বারবার ব্যর্থ হয় ফরেন কমিটি। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করায় দলের অনেক নেতাই ক্ষুব্ধ। কারণ তাকে চীন পছন্দ করে না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ঢাকায় তাইওয়ানের কনস্যুলেট অফিস খোলাকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে দলটির সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর পেছনে ছিলেন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু। সেই ঘটনায় এখনো চীন বিএনপিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। অন্যদিকে ভারতীয়দের কাছেও তার গ্রহযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।’
দলের সার্বিক অবস্থা নিয়ে অন্য এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘৬০০ সদস্যের কমিটি করে বিএনপি শুধু নেতা তৈরি করেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দলের মনোনয়ন না হয় বিক্রি হলো, সেটা আলাদা জিনিস। আজকে কি বিএনপি আছে বলে মনে হয়? ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, জাতীয় প্রেসক্লাব, ডিআরইউ ছাড়া বিএনপিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়? তৃণমূলের অনেকেই মনে করেন, আছেন একজন আবাসিক কাম সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব, প্রতিদিন ব্রিফিং করতে হবে কেন? লোকজন এখন হাসিঠাট্টা করে। আওয়ামী লীগের লোকজন বলেন, বিএনপি মানে ব্রিফিং অ্যান্ড নিউজ পার্টি। বিএনপিকে ব্রিফিংয়ের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, ওখান থেকে বের করা যাচ্ছে না। যারা ত্যাগী, যারা দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। ব্যক্তি আনুগত্য নয়, যোগ্যতা ও যার যেটি পাওনা সেটি দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করলে আগামী দিনে বিএনপি আবারও সুসংঠিত দলে পরিণত হবে। অন্যথায় বিএনপির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’
জোট রাজনীতি বা দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও কোনো চমক দেখাতে পারছে না বিএনপি
বিএনপির মিত্র হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপিতে অনেক দক্ষ ও চৌকস নেতা আছেন; শূন্য পদগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূরণ করে সেখানে তাদের দায়িত্ব দেয়া উচিত।’
দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করায় স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কিছু ফাঁকা পদ পূরণ হচ্ছে না- এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহামুদ চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান
বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘আমাদের কেন্দ্রীয় পদ খালি থাকলে সেখানে পদ পূরণ করা হবে। এগুলো তো ধারাবাহিকতা, সেগুলো হচ্ছে। কাজেই হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়। ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে না, এটাও ঠিক নয়। চেষ্টা করা হচ্ছে, দলকে পুনর্গঠিত করা হচ্ছে। এখন অনেকে কথার কথা বলে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে দল পুনর্গঠিত হচ্ছে।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ। শূন্যপদ পূরণের এখতিয়ার তার হাতে। তিনি সুস্থ হলে বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান যখন চাইবেন এসব পদ পূরণের উদ্যোগ নেবেন।’
বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি এখন অনেকটাই দায়সারা বলে অভিযোগ তৃণমূলের
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘বৈঠকে যত বেশি নেতা উপস্থিত থাকবেন তত বেশি মতামত ও পরামর্শ আসবে। স্থায়ী কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণের এখতিয়ার চেয়ারপারসনের। তবে মনে হচ্ছে শূন্যপদ পূরণে করণীয় নিয়ে ভাবা হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘দলের অনেক পদ শূন্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেতারা মারা যাওয়ায় এসব পদ শূন্য হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদে নতুনদের জায়গা দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যগুলোতেও পদায়ন হবে। দলের চেয়ারপারসন বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান কাউন্সিল ছাড়া চাইলে এসব পদায়ন করতে পারবেন।’
কেএইচ/এমআরআর/এইচএ/জেআইএম