চারদিকে হাজারো প্রজাতির ফলজ ও বনজ গাছ-গাছালির সমারোহ। সেই সবুজ প্রকৃতির অভ্যন্তরে নিরাপদ ও নির্ভয়ে বিচরণ করে হরেক প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় বন্যপ্রাণি। যেখানে গত এক দশক আগেও কোনো সবুজ প্রকৃতির চিহ্ন ছিল না সেখানে সবুজ বনাঞ্চল সৃজন করে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে বিরল বিপ্লব ঘটিয়েছে যুবক হাবিব উল্লাহ হাবিব। জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক ক্ষতি থেকে উপকূলীয় এলাকার মানুষকে রক্ষা ও শখের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর বনবিটের আওতাধীন এলাকায় হাবিবের সৃজিত বিশাল বনভূমি এখন পরিণত হয়েছে শত প্রজাতির বন্য পশু পাখির অভয়ারণ্যে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৩ সালের দিকে বাহারছড়া শামলাপুর এলাকার মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে হাবিব ঢাকা শহরের ইট পাথর আর যানজটের দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে নিজ গ্রামে এসে বনায়নের উদ্যোগ নেন। ওই সময় টেকনাফ বাহারছড়ার শামলাপুর বিটের আওতাধীন হাজার হাজার একর পাহাড়ি ভূমি বৃক্ষ শুন্য হয়ে বিরাণ ভূমি ছিল। চারদিকে সবুজের চিহ্নহীন ন্যাড়া পাহাড়। দেখভাল করার শর্তে দক্ষিণ বনবিভাগের হাতে সেসব জমি থেকেই প্রায় ১২`শ একর পাহাড়ি ও সমতল জায়গা নিয়ে সেখানে হাবিব রোপণ করেন শত প্রজাতির প্রায় দুই লক্ষাধিক গাছের চারা। আম, জাম, পেয়ারা, লেবু, কাঠাল, বড়ই, কলা, আনারস, শরিফা, সুপারি, জলপাইসহ অর্ধশত প্রজাতির ফলজ গাছ ছাড়াও ওই বনে রয়েছে আরো অর্ধশত বনজ প্রজাতির গাছগাছালি। শুরুর দিকে চারাগুলো বাঁচিয়ে রাখা নিয়ে শঙ্কায় পড়লেও বনায়নে তাকে কোনো ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়নি। চারাগুলো দ্রুত বড় হয়ে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ধীরে ধীরে পরিণত হয় এক বিশাল বনভূমিতে। এখানে বর্তমানে শত প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় বন্য পশু পাখি নির্ভয়ে আবাস গড়েছে। হাতি, হরিণ, ভাল্লুক, শূকর, বানর, বিরল প্রজাতির সাপ, বন মোরগ, কাঠ বিড়ালি, টিয়া, ময়না, বন বিড়াল, শিয়াল, ঠোঁট কাটা পাখি, বন ঘুঘুসহ প্রায় হরেক প্রজাতির পশু পাখি সবুজ প্রকৃতি প্রেমী হাবিবের পরিবারের সদস্যদের মতোই।উদ্যোক্তা হাবিব উল্লাহ হাবিব জাগো নিউজকে জানান, ছোটবেলা থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সর্ম্পকে জানার আগ্রহই আজ তাকে এ বনায়নে উদ্যোগী করেছে। এর ব্যাখা দিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানতে পেরেছি বঙ্গবন্ধু সবুজ প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণি ভালবাসতেন। তার স্বপ্ন ছিল চারদিকে সবুজের সমারোহে ভরে উঠবে। বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িকভাবে অর্জিত টাকা ও পৈত্রিক সম্পতি বিক্রি করে এ বিশাল বনভূমিতে বনায়নের সাহস করি। আজ আমি সফল। কারণ চারদিকে দৃষ্টিজুড়ে এখন শুধু সবুজ গাছ পালায় ভরপুর। যেখানে আশ্রয়হীন বন্যপ্রাণিরা এখন নির্ভয়ে বেঁচে থাকে।তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছরই তার বাগানে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের ফল বিক্রি করে আয় হচ্ছে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে আট হাজার লেবু গাছ ও ২৫ হাজার পেয়ারা গাছে ভালোই ফলন হয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার আম গাছের মুকুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। বনায়নের পশ্চিম অংশে ফলজ গাছ রোপণ করলেও পূর্বাংশে শুধুই বনজ গাছ পালা। বন্য প্রাণির আবাসস্থল যাতে নষ্ট না হয় সেদিক বিবেচনা করেই পূর্বাংশে ঝোপ ঝাড় আরও বাড়ানো হয়েছে। এমনকি হাতির খাদ্যের যোগান দিতে ওই বনাঞ্চলে রোপণ করা হয়েছে প্রায় এক হাজার কলাগাছ। বিশেষ করে ওই বনাঞ্চলে উৎপাদিত ফল ফলাদির বেশির ভাগই বন্য পশু পাখির খাদ্য।স্থানীয়দের মতে, শুরু থেকেই হাবিবের সৃজিত বনায়নে কর্মসংস্থান হয়েছে অর্ধশত কর্মহীন মানুষের। এরমধ্যে বেশিরভাগই পাহাড়ি ক্ষুদ্র চাকমা নৃ-গোষ্ঠী। পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারীর সংখ্যাও কম নয় এখানে। হাবিব আরও জানান, এসব ফলজ বাগান ও বন্যপ্রাণির আবাসস্থল তৈরি করতে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বর্তমানে বাগানে বার্ষিক ও মাসিক নারী-পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ৩০ জন। এরমধ্যে পুরুষ শ্রমিকের মজুরি প্রতিদিন সাড়ে ৩`শ টাকা আর নারীদের মজুরি ৩`শ টাকা। প্রতিমাসে সব মিলিয়ে ব্যয় পড়ে অন্তত ৮০ হাজার টাকার মতো। বর্তমানে আয়-ব্যয়ে কিছুটা সামঞ্জস্য হলেও ভবিষ্যতে ব্যয়ের পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা তার। এই বনায়ন থেকে আয় করাটা মুখ্য উদ্দেশ্য নয় জানিয়ে হাবিব বলেন, ভবিষ্যতে এই বনায়ন আরো বিশাল এলাকাজুড়ে করতে গিয়ে যদি অর্জিত ও পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সকল সম্পদ বিক্রি করতে হয় তাতেও দ্বিধা নেই। কারণ এই সবুজ বনায়ন ও তার মাঝে লুকিয়ে থাকা বন্যপ্রাণিরাই তাকে জীবনের সম্পূরক স্বাদ প্রদান করে। তাই প্রতিদিন হাবিবের সূর্য উঠে আর অস্ত যায় শখের এই বনায়নেই।হাবিবের বাগানে কর্মরত শ্রমিক অন্ত চিন চাকমা জাগো নিউজকে জানান, তার বাড়ি উখিয়ার মনখালী এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি হাবিবের বাগানের সঙ্গে জড়িত। তার সঙ্গে তার পরিবারের আরও ২০ সদস্য ওই বাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। হাবিবের বাগানে কাজ করেই তাদের পরিবারের ফিরেছে সচ্ছলতা। তিনি আরও জানান, বিশাল বনায়নে প্রায় ১০ একরের মতো চাষাবাদের উপযুক্ত সমতল জমি রয়েছে। ওই বাগানে যেসব চাকমা সম্প্রদায় স্থায়ীভাবে কাজ করে তারা এখানে ধান চাষ করে থাকেন। ওই জমিতে উৎপাদিত ধানের কোনো অংশ হাবিবকে দিতে হয় না। বরং ওই জমিতে চাষাবাদের জন্য হাবিব সব ধরনের উপকরণ ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেন। নারী শ্রমিক মাই ফ্রু চাকমা জাগো নিউজকে জানান, হাবিবের বাগানে প্রায় ১০ জন নারী শ্রমিক রয়েছে। এক সময় কর্ম সংস্থানের অভাবে অনাহারে দিনাতিপাত করলেও এখন তারা সচ্ছল। শুধু দিনের মজুরি নয় যেকোন সময় কোনো ধরনের আর্থিক সমস্যায় পড়লেও হাবিব তাদেরকে সহযোগিতা করেন। রোগে আক্রান্ত হলে সকল চিকিৎসার ভার বহন করেন হাবিব। এছাড়া তাদের পরিবারের সন্তানদের পড়ালেখার খরচও বহন করেন এ উদ্যোক্তা। তিনি আরও জানান, বাগানে শ্রমিকদের তেমন কোনো কাজ নেই। বিশেষ করে বন্য পশু পাখি ও গাছ পালার উপর কোনো ধরনের আক্রমণ হচ্ছে কিনা সেসব দেখাশোনা করাই তাদের প্রধান কাজ।বাহারছরা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান হাবিব উল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, তরুণ উদ্যোক্তা হাবিবের এ উদ্যোগ যুব সমাজের জন্য মডেল। বন বিভাগ উদ্যোগী হয়ে বনায়নে সহযোগিতা দিলে এরকম আরো অসংখ্য হাবিব সৃষ্টি করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি। কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও-দক্ষিণ) মোহাম্মদ আলী কবির জাগো নিউজকে জানান, আমি সম্প্রতি কক্সবাজারে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে হাবিবের ব্যক্তি উদ্যোগের বাগান সম্পর্কে জেনেছি। তার এ বাগান বিরান বনভূমিতে সবুজায়নের পাশাপাশি বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য তৈরী ও জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবেলায় আশার আলো জাগিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি স্বচ্ছল ও উদ্যমী যুব সমাজ বনায়ন সৃষ্টিতে এভাবে এগিয়ে আসলে আবারো পাহাড়ে পাহাড়ে সবুজের বিপ্লব হবে, আবাসস্থল ফিরে পাবে বন্যপ্রাণিরা। তাই হাবিবের মতো অন্যরা এগিয়ে এলে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন ডিএফও। এমজেড/পিআর
Advertisement