জাতীয় পার্টির কো-চেয়ার এবং সাংসদ এডভোকেট সালমা ইসলাম বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেছেন, দেরিতে হলেও সরকার বুঝতে পেরেছেন যে, বেসরকারি খাতকে সত্যিকার অর্থে চাঙ্গা করতে না পারলে দেশ সামনের দিকে এগোবে না। কারণ ঋণের বোঝা বাড়িয়ে উন্নয়ন করা হলেও সেখানে এসডিজি অর্জিত হবে না। প্রবাসী আয় দিয়ে রিজার্ভ বাড়িয়েও লাভ নেই। রিজার্ভ দিয়ে অর্থনীতিরচাকাকে বেগবান করা যায় না। এছাড়া সরকার চাইলেও ২০ শতাংশের চেয়ে বেশি কর্মসংস্থান করতে পারবে না। বাকি ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান নির্ভর করে বেসরকারি খাতের ওপর। তাই বেসরকারি খাত যত শক্তিশালী ও স্বনির্ভর হবে দেশ তত দ্রæত উন্নত হবে।
Advertisement
উল্লেখ্য, এডভোকেট সালমা ইসলাম সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি জাতীয় পাটির এমপি হিসেবেই ওই পদ লাভ করেছিলেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে দেশের বেসরকারি খাতের ভিত শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে না পারলে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দেশের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান পরিপূর্ণ করা যাবে না। এখন আমাদের বুঝতে হবে যে এই বেসরকারি খাত বলতে আমরা কি বুঝি ও কি বোঝাতে চাই বা বোঝাতে চাইছেন সালমা ইসলাম।
উন্নয়নের যে সব খাত রয়েছে, তার মধ্যে বেসরকারি শিল্পখাত সবচেয়ে বড়। না, ঠিক বলা হলো না। সবচেয়ে বড় বেসরকারি খাত হচ্ছে কৃষি। আর এই কৃষি খাতে নিয়োজিত দেশের দক্ষ, অদক্ষ কোটি কোটি মানুষ। যেহেতু এ-খাতের উন্নয়নে তেমন কোনো পূর্ণ রোডম্যাপ লক্ষ্য করা যায়নি কখনোই, তাই এটা বলতে পারি, সরকার এই খাতের উপরিকাঠামো নিয়ে যতটা সজাগ ও কর্মচঞ্চল, এর ভেতর কাঠামো বা ডিপ স্ট্রাকচার নিয়ে তেমন কোনো ভাবনাস্রোতে লক্ষিত নয়।
ভূমি ব্যবস্থাপনা এক অসহনীয় জটিল প্রক্রিয়ার ভেতরে নিয়তই ঘোরপাক খাচ্ছে। এর নিরসন বা ভূমির ব্যবস্থপনায় জটিল প্রক্রিয়া পরিহার করে সরল পথে নিয়ে আসতে হবে। যাতে ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার করা যায়। দ্বিতীয়ত ফসল নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের খাদ্যশস্য রকমভেদ বিবেচনায় রেখে, আমাদের খাদ্যের প্রয়োজন, পুষ্টির প্রয়োজন বিবেচনায় রেখে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় ভিন্নতা আনতে হবে। খাদ্য বলতে এখানে কেবল শস্যকে বোঝানো হয়নি। মাছ-মাংস-দুধ পুষ্টিকর এই খাদ্যের উৎস ধরে অন্যান্য পথে এগুতে হবে। সেই সঙ্গে উৎপাদক শ্রেণির অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা ও শিক্ষাকে কেন্দ্রভূমি হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। কৃষি সেক্টরে দক্ষ জনবল আমাদের পুষ্টিপ্রবাহ বাড়াতে সহায়ক হবে। এই উন্নতির সুফল পাওয়া যাবে কৃষি খাতের সাফল্য দেখে। মনে রাখতে হবে দেশের কৃষি সেক্টর অর্থনীতির ৮০ ভাগের জোগানদাতা। বাকি কুড়ি শতাংশের মধ্যে সিংহভাগের অর্জন শিল্প সেক্টরের। এই শিল্প সেক্টরের সিংহভাগই আবার বেসরকারি শিল্পপতি ও উদ্যোক্তাদের হাতে।
Advertisement
এডভোকেট সামলা ইসলাম একজন শিল্পপতি হলেও তিনি তার নিজের জন্য বিশেষ করে বলেননি, তিনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপরই বক্তব্য রেখেছেন। কৃষিখাতের ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতির গতি শাদা-চোখে বোঝা যায় না। কারণ তার আকার বিশাল এবং গতি মন্থর। সাংবাৎসরিক হিসাবের পরই কেবল বোঝা যায় জিডিপি-তে কৃষির শক্তি কতোটা এবং এর অবদান জাতীয় ক্ষেত্রে কতো ব্যাপক।
আর শিল্পক্ষেত্রে প্রণোদনার বিষয়টি দ্রæতগতি সম্পন্ন । আর বেসরকারি খাতই মূলত পুঁজিবাদি ব্যবস্থায় সবচেয়ে অগ্রগামী । কারণ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মাথার ওপর চাপ থাকে প্রকল্প বাস্তবায়নের। ঋণ পরিশোধের চাপের পরও থাকে উৎপাদনে যাওয়ার বিষয়টি, যা থাকে না সরকারি খাতের ওপর। সরকার গত ১২ বছরে গৃহীত প্রকল্পগুলোর মধ্যে কতোগুলো সম্পন্ন করতে পেরেছেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে? এর উত্তর আমার জানা নেই। তবে লোকেরা বলে একটাও করতে পারেননি। হয়তো লোকেদের কথা ঠিক না, তবে, সরকারি খাতের বাস্তায়িত প্রকল্পের সংখ্যা নিতান্তই সামান্য।
অধিকাংশ প্রকল্পের ব্যয় যেমন বিপুল তেমনি সময় বাড়ানোর সংস্কৃতিও। এ-কারণেই সরকারি খাতের চেয়ে বেসরকারি খাত উন্নতির জন্য, সার্বিক উন্নয়নের জন্য সঠিক। এডভোকেট সালমা ইসলাম এই বিষয়ে বলেছেন বেসরকারি খাতকে চালকের আসনে বসিয়েছে এবারকার বাজেট, কিন্তু সেই খাতটির পরিচালনার রোডম্যাপ দেখানো হয়নি। অর্থাৎ বাস্তবায়নের পথ দেখানো হয়নি। ফলে এটাকে একটি অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বলে আমরা ধরে নিতে পারি। কোনো অসম্পূর্ণ স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়ন করা যায় না, যদি সেই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও তার রোডম্যাপের নির্দেশনা না থাকে।আমরা চাই সরকার এ-বিষয়ে সজাগ-সচেতন হয়ে দেশের সার্বিক উন্নতির রূপরেখা নকশা করে দেখান, যা স্বপ্ন নয়, কল্পনাও নয়, বাস্তব হয়ে উঠবে কংক্রিটের মতো। দেশের আপামর জনগণ যা দেখে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনুধাবন করতে পারবে।
এবারকার বাজেটে ২ লক্ষ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রেখে প্রণীত হয়েছে। এই ঘাটতি সরকার কোন কোন উৎস থেকে মেটাবেন, তাও দেখানো হয়েছে। তবে এখানে কথা থেকে যায় যে জাতীয় রাজস্ব আয়, ব্যাংক ঋণ, জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবার কথা বলা হলেও দেশের ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা যে ভালো নয়, খেলাপি ঋণ, অবলোপিত ঋণ আর লুটেরাদের হাতে পড়ে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন কোনো সাহায্য করতে পারবে বলে মনে হয় না। এর পর আমরা কেবল ‘আল্লাহ ভরসা’ ছাড়া আর কী বলতে পারি?
Advertisement
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/এএসএম