দেশজুড়ে

অবহেলায় পড়ে আছে ঝিনাইদহের গণকবরগুলো

শৈলকুপা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বে কুমার নদের পাড়ে ২৭ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ৫টি গণকবর আজও অবহেলিত। স্বাধীনতা লাভের পর পরই গঠিত হয় `কামান্না ২৭ শহীদ স্মৃতি সংঘ`। কিন্তু যাদের স্মৃতি রক্ষার জন্য এ সংঘের জন্ম তাদের স্মৃতি রক্ষার কিছুই হয়নি গত ৪৪ বছরে। এত বছরেও শহীদদের এ গণকবরগুলো অবহেলিত ও উপেক্ষিত। বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ তথা শৈলকুপাবাসীর জীবনে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞের দিন। ২৭ নভেম্বর ভোর রাতে ফজরের আজানের পর পরই গর্জে উঠে রাইফেল-স্টেনগান, এসএলআরসহ অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র।  পাকহানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকার, আল শামসরা রক্তের বন্যা বইয়ে দেয় এই কামান্না গ্রামে। পাখির মত গুলি করে নির্বিচারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলো দুই সহযোগীসহ ২৭ জন মুক্তিপাগল দামাল ছেলেকে।তারা জানায়, ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার কামান্না এ সময় ছিল শত্রুমুক্ত এলাকা। তাই ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যার পর পরই মুজিব বাহিনীর ৪২ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দামাল ছেলে শৈলকুপা সদরকে হানাদার মুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে কামান্নায় এসে আশ্রয় নেয়। এদের বাড়ি পার্শ্ববর্তী মাগুরা জেলার হাজিপুর এলাকার বিভিন্ন গ্রামে। হাজিপুরের আবু বকর ও শৈলকুপা উপজেলার মালিথিয়া গ্রামের আলমগীর ছিল এদের দলনেতা।  রাতের খাওয়া সেরে ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা মাধবচন্দ্র ভৌমিকের টিনের ঘরে এবং ১০ জন বিধবা সামেনা বেগমের খড়ের দুটি ঘরে ঘুমাতে যায়। এদিকে রাতের আধারে শুরু হয় রাজাকার-আলবদর-আল শামসদের-গোপন তৎপরতা। দ্রুত খবর চলে যায় ঝিনাইদহ সদরে অবস্থিত অস্থায়ী সেনা সদরে। সেখান থেকে মাগুরা সদরে অস্থায়ী আর্মি ক্যাম্পে। দুপাশ থেকে রাতের আধারে কামান্নার দিকে এগিয়ে যায় দলে দলে পাকসেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের এই অস্থায়ী আস্তানা। এ সময় শৈলকুপা ধলহরাচন্দ্র ও আবাইপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি প্রধান ঘাঁটি ছিল। দুটি ঘাঁটি থেকেই বিপদের সংকেত জানিয়ে কামান্নায় সতর্ক বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু সতর্কবাণী পৌঁছার আগেই ঘটে ইতিহাসের নারকীয় এই হত্যাকাণ্ড। সময় নেয়নি পাকহানাদাররা। চারপাশ ঘিরে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই মাধব ভৌমিকের টিনের ঘর লক্ষ্য করে বৃষ্টির মত গোলা বর্ষণ শুরু করে তারা। টিনের বেড়া ভেদ করে ছুটে আসতে থাকে গুলি। হঠাৎ আক্রমণে ঘুম ভাঙা মুক্তিযোদ্ধারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় পায়নি তারা। যে যেভাবে পেরেছে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে কেউ ঘরের মধ্যে, কেউ ঘরের বারান্দায় আবার কেউ উঠানে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে। পাশেই বৃদ্ধা ছামেনা বেগমের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা, পেছনের চাটাইয়ের বেড়া কেটে ঘর থেকে ৫ মুক্তিযোদ্ধা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু অন্য ঘরের ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাক হানাদারদের গুলিতে উঠানে লুটিয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে কামান্নার এই দুঃসংবাদ পৌঁছে যায় শৈলকুপার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী আস্তানাগুলোতে। মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে এগিয়ে যান ঘটনাস্থলের দিকে এবং কিছু দূরে দূরে অবস্থান নিয়ে ফাঁকা গুলির আওয়াজ করে তাদের উপস্থিতি ঘোষণা করে। অতর্কিত আক্রমণের আশঙ্কায় পাকসেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসররা তাড়াহুড়ো করে মাগুরার দিকে দ্রুত পালিয়ে যায়। রাত গড়িয়ে ভোর হয়। দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। দলে দলে লোক জমা হয় ঘটনাস্থলে। ঘরে, ছাদে, মেঝেতে, উঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ২৭টি লাশ এক জায়গাতে জড়ো করা হয়। এ সময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কামান্না হাইস্কুলের মাঠের পাশে বয়ে যাওয়া কুমার নদের পাড়ে ৫টি গণকবরে (৬ জন করে দুটিতে ১২ জন এবং ৫ জন করে ৩টিতে ১৫ জন) মোট ২৭ জনকে সমাহিত করা হয়। এ ২৭ জন হলেন- মোমিন, কাদের, শহীদুল, ছলেমান, রাজ্জাক, ওয়াহেদ, রিয়াদ, আলমগীর, মতলেব, আলী হোসেন, শরিফুল, আলীমুজ্জামান, আনিছুর রহমান, তাজুল, মনিরুজ্জামান, নাসিম, রাজ্জাক-২, কউসার, সালেক, আজিজ, আকবর, সেলিম, হোসেন, রাশেদ, গোলজার, অধির ও  গৌর। এই ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আরও যে দু’জন মারা যান তারা হলেন-রঙ্গ বিবি ও মুক্তিযোদ্ধাদের পথপ্রদর্শক ফণি ভূষণ কুন্ডু। এসএস/পিআর

Advertisement