মেহেদি হাসান শান্ত
Advertisement
সাহিত্য-সিনেমা থেকে শুরু করে লোকজ সংস্কৃতিতে উপস্থিত ‘মৎসকন্যা’ নিয়ে কখনো কি ভেবেছেন? শরীরের উপরিভাগ নারীর অবয়ব এবং নিচের অংশ মাছের শরীরের মতো দেখতে জলরাজ্যের অসম্ভব সুন্দর এই জলপরীদের অস্তিত্ব আসলেই কি পৃথিবীতে আছে?
ডায়নোসরের মতো মৎস্যকন্যারাও কি হাজার বছর আগে পৃথিবীতে বাস করতো? সত্যিই কি এই জলপরীরা জীবন্ত কোনো প্রাণী? চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক মৎস্যকন্যাদের ইতিহাস এবং পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে-
মৎস্যকন্যা কি?
Advertisement
‘মারমেইড বা মৎস্যকন্যা/জলকন্যা’ নামক প্রাণীটি আলোচনায় এসেছে মেরফোক বা মের্পিপলের গল্প থেকে। মেরফোক নামের রহস্যময় এই জলজপ্রাণীদের পুরুষ অবয়বের নাম মেরম্যান ও নারীদের বলা হয় মারমেইড। সমগ্র বিশ্বের সব লোককাহিনী ও পৌরাণিক কাহিনিতে কমবেশি মারমেইড তথা জলজগতের এই রহস্যময় প্রাণীটি আলোচনায় এসেছে।
সেসবের প্রেক্ষিতে জানা যায়, মানুষ এবং মাছের বৈশিষ্ট্য নিয়ে সৃষ্ট এই প্রাণীটি দেখতে নারীর মতো। যার আছে কোমর অব্দি সোনালী চুল। শরীরের উপরিভাগ নারীদের মতো এবং নিচের দিক মাছের মতো লেজযুক্ত। সমুদ্রের উপরিভাগে ভেসে বেড়ানো এবং বসবাসরত এই জলপরীরা মাছের মতোই দীর্ঘসময় পানি ছাড়া থাকলে নিস্তেজ হয়ে যায়।
মৎস্যকন্যা নিয়ে আলোচনার সূচনা
মৎস্যকন্যা নিয়ে সর্বপ্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় সম্ভবত অ্যাসিরিও সভ্যতায়। দেবী অ্যাটারগেটিস ভুলক্রমে তার প্রেমিককে হত্যা করেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে অভিশপ্ত হয়ে, তিনি সমুদ্রে আত্মহত্যা করতে গেলে সমুদ্রদেবতা পসাইডন রূপসী এই দেবীকে মৃত্যু না দিয়ে বরং অর্ধমানবী ও অর্ধমাছের শরীরের মৎস্যকন্যার জীবন দেন।
Advertisement
ব্যাবিলনীয় উপকথায় এই কাহিনিটিই আছে দেবী ‘ইয়া’কে নিয়ে। গ্রিক সাহিত্যে অ্যাটারগেটিসের বর্ণনা আছে ‘আফ্রোদিতি’ নামে। এ ছাড়াও গ্রীক সাহিত্যে অ্যাটারগেটিস ‘দেবী ডার্কেটো’ নামে পরিচিত। তার অনুসারী সাইরেন নামের একদল সামুদ্রিক প্রাণীর পরিচয় পাওয়া যায়। যারা সমুদ্রের নাবিকদের আকৃষ্ট করে তাদের দ্বীপে নিয়ে যেতে জলকন্যা সেজে ভেসে বেড়ায় ও মোহনীয় সুরে গান গায়।
যেন নাবিকরা সুরের মূর্ছনায় প্রেমে পড়ে পথ ভুল করে এবং তাদের শিকারে ধরা দেয়। কোনো কোনো ইতিহাসে এই ঘটনাকে সমুদ্রের দেবী মৎস্যকন্যা ও নাবিকের প্রেমময় উপ্যাখ্যান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কোথাও বা এমন ঘটনার প্রচলন আছে দুষ্টপ্রাণী মৎস্যকন্যাদের মনুষ্যজাতির প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণের বর্হিপ্রকাশ হিসেবে।
কেউ কেউ মনে করেন মৎস্যকন্যা ছিল প্রাচীন পূর্বাঞ্চলীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের ভয়ানক ড্রাগনের স্ত্রী। যারা স্থলভাগের রাজা ও সমুদ্রপৃষ্ঠে রাজত্ব করা ড্রাগনদের মধ্যে গোপন তথ্য আদানপ্রদানের বিশ্বস্তরূপে কাজ করতো। মৎস্যকন্যাদের নিয়ে আলোচনার দিক দিয়ে প্রথম সারিতে রয়েছে, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মেরফোকের প্রথম সারির লেখা একটি নথি যা ‘শানহাইজিং’ নামের চীনা শাস্ত্রীয় পাঠ।
যেখানে জীবজন্তু, পর্বতমালাসহ পৃথিবীর অপার্থিব ভৌগোলিক বর্ণনায় মৎস্যকন্যাদেরও উল্লেখ রয়েছে। মহাকবি হোমারের বিখ্যাত মহাকাব্য ‘ওডেসি’তে উল্লেখ থাকা মায়াবীপ্রাণী মারমেইড বা মৎস্যকন্যা যারা প্ররোচনাময়ী গান গেয়ে পুরুষ নাবিকদের আকৃষ্ট করে হত্যা করতো। এটিই ছিল সাহিত্যে মৎস্যকন্যা এবং তাদের মোহনীয় উপস্থিতি নিয়ে সর্বপ্রথম সৃষ্টি।
প্রথম দেখা মৎস্যকন্যা
আমেরিকা আবিষ্কারের সময়কালীন ক্রিস্টোফার কলম্বাসের লগবুকে ১৪৯৩ সালের ৯ই জানুয়ারি লেখা ঘটনায় মৎস্যকন্যার উল্লেখ পাওয়া যায়। কলম্বাস যখন ক্যারিবিয়ান দ্বীপ অতিক্রম করছেন; তখন না-কি তিনি নারী অবয়বের একটি মৎস্যকন্যাকে সমুদ্রের পারে বসে থাকতে দেখেন।
তিনি সেটি লোককাহিনির মতো জাদুকর বিষয় হিসেবে বর্ণনা না করে, সাধারণ মানুষের মুখাবয়ব বিশিষ্ট একেকরকম মাছের উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে বিশ্লেষকরা মনে করেন কলম্বাস ম্যানাটিস বা এ জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণী দেখেছিলেন যাদের দূর থেকে দেখলে মানুষ বলে বিভ্রান্তি হয়। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে হেনরি হাডসনের নরওয়ে ভ্রমণের কাহিনিতেও মৎস্যকন্যা দর্শনের বর্ণনা পাওয়া যায়। বেরিং মহাসাগরে ঘটনাটি ঘটেছে।
মৎস্যকন্যার প্রথম গল্প
১৮৩০ সালে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ানের লেখা একটি একক মৎস্যকন্যার করুণ জীবনী যে মানুষের আত্মার জন্য সমুদ্রের কাছে নিজের জীবন বির্সজন দিয়েছিলো। এই গল্পের সুন্দর একটি সমাপ্তি দেয়া হয়েছে এবং এটিই প্রথম লেখনী যেখানে মৎস্যকন্যাদের মায়াবী ও নিদোর্ষ রূপে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন লেখক।
এই গল্প থেকেই ‘দ্য লিটল মারমেইড’ ১৯৮৯ সালে ডিজনি প্রযোজিত প্রথম মৎস্যকন্যাদের নিয়ে নির্মিত বিখ্যাত একটি ছবি। তা ছাড়াও ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে এই গল্পের মতোই একটি মৎস্যকন্যার জনপ্রিয় স্মৃতিস্তম্ভ আছে।
বাস্তবে মৎস্যকন্যা
এতসব ঘটনার পরিক্রম থেকে এটি স্পষ্ট যে, মৎস্যকন্যাদের উপস্থিতি নিয়ে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের যুক্তিতর্ক সেই প্রাচীন যুগ থেকেই চলমান এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেটি চলতে থাকবে। মৎস্যকন্যা আসলেই আছে কি-না? এই প্রশ্নের উত্তর বাস্তবিক অর্থে অজানা। কেননা, দর্শন বা পাঠ্যশাস্ত্রে বর্ণিত ঘটনাগুলো তাদের উপস্থিতির পক্ষে কোন অকাট্য দলিল বা প্রমাণ বহন করে না।
আমরা লোককাহিনিতে যে মেরফোকের বর্ণনা পাই, যারা সমুদ্রে বাস করতো সেগুলোর অস্তিত্ব থাকতেও পারে। তবে মোহময় রূপসী এক অর্ধ-মানবী মৎস্যকন্যার যে নির্দিষ্ট অবয়বটি আমরা সাহিত্য, সিনেমা বা আমাদের মনোজগতে স্থিরভাবে সংরক্ষণ করে রেখেছি।
সবশেষে ভেবে দেখুন, পৌরাণিক যুগ থেকে আজ অব্দি সাহিত্য-সংস্কৃতি কিংবা গল্পে-ঘটনায় জীবন্ত এক চরিত্র এই মৎস্যকন্যারা। যারা লোককাহিনীর গল্প থেকে আধুনিকতার যুগে সমানতালে তাদের মোহনীয় এক চরিত্রে আকৃষ্ট করে রেখেছে মানবজাতিকে।
জেএমএস/এমকেএইচ