সাহিত্য

অপ্রকাশিত কথামালা : শ্রদ্ধাঞ্জলি কামাল লোহানী

কামাল লোহানী পরবর্তীকালে স্বাধিকার-সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন। একজন গণমুখী সাংবাদিক এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব- মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক কামাল লোহানী। তার পারিবারিক নাম ‘আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী।

Advertisement

কামাল লোহানীর সঙ্গে পরিচয় ১৯৯৭ সালে ঢাকায় উদযাপিত উদীচীর গণসংগীত উৎসবে। সে উৎসবের আহ্বায়ক ছিলেন গণসংস্কৃতির রূপকার, সংগঠক- কামাল লোহানী। দীর্ঘ প্রায় সাত দশক ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ মিনার, পল্টন ময়দান বা বাংলা একাডেমির বটতলায় অনুষ্ঠিত গণসংগীতের বিভিন্ন উৎসবের প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। গণসংগীত ও গণসংস্কৃতিকে সঙ্গী করে ঘুরে বেরিয়েছেন সারাদেশে। ‘৯৭ এর গণসংগীত উৎসবে শিল্পী কফিল আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার, আবৃত্তিকার রেজিনাওয়ালী লীনাসহ আরও অনেকের সঙ্গে আমিও ছিলাম সে উৎসব উদযাপন কমিটিতে। সংগঠক কামাল লোহানীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় সে উৎসবে।

সরদার ফজলুল করিম স্মৃতি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠান ও বাংলার পাঠশালার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকবার কথা হয়েছে ভিন্ন প্রাসঙ্গিকতায়। কাজের অবসরে তার বৈচিত্র্যময় জীবনের গল্প শোনাতেন। সংগীত প্রসঙ্গে বলতেন, ‘আমি তো গান গাইতে পারতাম না, তাই গাওয়ানোই ছিল আমার দায়িত্ব। শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, আবদুল হাকিম, খান আতাউর রহমান, অজিত রায়, সাইদুল ইসলাম, শম্ভু জোয়ারদার প্রমুখ গণসংগীত শিল্পীর সঙ্গে আমার সখ্য প্রায় পারিবারিক।’ ‘ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীকে নিয়ে বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গেছি, পল্টন থেকে টঙ্গী, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের জাম্বুরি ময়দান, কুলাউড়ার কৃষক সম্মেলন থেকে নওগাঁর ঈদগাহ, এসব জায়গায় গেছি মার্কসবাদের টানে। আমরা সমাজবদলের গান গেয়ে মহান মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।’ প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক কামাল লোহানী ছিলেন কলমযোদ্ধা। প্রকাশিত তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধের বই ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’ প্রভৃতি। তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘আমরা হারবো না’ : জাহানারা ইমাম স্মারকগ্রন্থ, ‘মোহাম্মদ সুলতান কয়েকটি রেখায়’, ফয়েজ আহমদ ‘স্মারকগ্রন্থ’ প্রভৃতি।

১১ জানুয়ারি ২০১২ তে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, পাবনায় রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে শিরীন বানু মিতিলের। সে সময়ে ‘একাত্তর মুক্তিযোদ্ধার মা’ শিরোনামে আমার গবেষণার কাজটি চলছিল। একাত্তরের সশস্ত্র যুদ্ধে শিরীন বানু মিতিল ছেলেদের পোশাকে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় শিরীন বানু আমাকে দেখিয়েছিলেন তাকে নিয়ে কামাল লোহানীর মন্তব্য; তিনি লিখেছিলেন, ‘দখলদার হায়েনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এক দুরন্ত যৌবনের লড়াকু প্রতীক হয়ে আছেন শিরীন বানু মিতিল।’ ১৯৭১ সালে ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকায় তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর শিরোনাম ছিল- ‘এ শাই গার্ল উইথ গান’। সেদিনই ভেবেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠসৈনিক কামাল লোহানীর সাক্ষাৎকার নেয়ার বিষয়টি।

Advertisement

১১ মে, ২০১২। এক ছুটির দিনে, উত্তর ধানমন্ডির বাসায়- তার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল দিনের কথা শুনতে গিয়েছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম যুদ্ধদিনে তার মায়ের ভূমিকা, অনুপ্রেরণা কিংবা আত্মত্যাগের কথা। আমার সাক্ষাৎকারের প্রশ্নপত্রে দুটি অংশ ছিল- একটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এবং অপরটি ছিল- মুক্তিযোদ্ধাদের মা’র জন্য প্রশ্নমালা। যেহেতু শৈশবেই মাতৃহারা হন কামাল লোহানী তাই ২য় অংশটি- মুক্তিযুদ্ধে তার মায়ের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সাক্ষাৎকার গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত আমার অজানা ছিল ছয় বছর বয়সে কামাল লোহানীর মাতৃহারানোর ঘটনা। সে কারণে গবেষণাগ্রন্থে কামাল লোহানীর সাক্ষাৎকারটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

অবশেষে ২০১৯ সালে অবসর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘একাত্তর মুক্তিযোদ্ধার মা’। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা বইটিতে ২০৩ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ৭১ জন মুক্তিযোদ্ধার মা সম্পর্কে ৭১টি অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত হয়; প্রকাশিত হয় কামাল লোহানীর সাক্ষাৎকারটি ব্যতিরেকেই।

ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সাক্ষী- কামাল লোহানী জন্মেছিলেন ২৬ জুন ১৯৩৪ এ। সেদিন ত্রিকালদর্শী কামাল লোহানী বলেছিলেন তার বৈচিত্র্যময় জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশবিশেষ। মাতৃহারা বালক কামাল সাত বছর বয়সে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থেকে কলকাতায় ফুফুর কাছে যান, সেখানের স্কুলে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। কলকাতায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর হানাহানির চালচ্চিত্র, ৪৬ এর মনান্তরের বিভীষিকা, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন - এসব কিছুই তার বর্ণাঢ্য জীবনের অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। ১৯৪৭ এ ঐতিহাসিক দেশভাগের পর কলকাতা থেকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন।

কামাল লোহানীর পরিচয়ের সঙ্গে মিলেমিশে আছে রাজনীতি, সাংবাদিকতা আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ভাষা-আন্দোলনে পূর্ববঙ্গের যে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়, তা স্কুলের ছাত্র কামাল লোহানীকেও জাগিয়ে তোলে। সেই জাগরণের মূলে ছিল ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ভাষা-সংস্কৃতিকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবোধ। একুশে ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা রক্ষা আন্দোলনে কামাল লোহানী মিশে যায় রাজপথের প্রতিবাদে আর মিছিলে।

Advertisement

‘স্মৃতিচৈতন্যে পাবনা’য় লিখেন আত্মকথা-‘আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী, ছাত্রহত্যার খবরটা শোনার পর আমার মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। পরদিন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে যে, মিছিল বেরিয়েছিল পাবনায়, অন্যান্য জেলার মতো, সেখানে আমি স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করেছিলাম।... তীব্র ক্ষোভ জন্মেছিল আমার মনেও। সেই থেকেই রাজনীতির জন্ম আমার মনে।... সেই ক্ষোভ ক্রোধে পরিণত হয়ে আমার মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটালো এক নতুন অভিজ্ঞানের।’

ভাষা-আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ স্তিমিত হয়ে এলে কামাল লোহানী ১৯৫২ সালের শেষ দিকে ভর্তি হন এডওয়ার্ড কলেজে। সহপাঠী হিসেবে পেলেন এক ঝাঁক মেধাবী তরুণ - যারা বিপ্লব আর জাতীয়তাবোধের উজ্জীবিত ছিলেন। প্রগতিশীল সেই তালিকায় ছিলেন আব্দুল মতিন, এইচটি ইমাম, জিয়া হায়দার, রণেশ মৈত্র, জয়নাল আবেদীন খান, মোজাম্মেল হক, এম এ সামাদ প্রমুখ। এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়েই প্রগতিশীল এই তরুণদের প্যানেলে ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে কামাল লোহানী বিজয়ী হন সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে।

১৯৫৩ সালে এডওয়ার্ড কলেজে মুসলিম লীগের কাউন্সিলে নুরুল আমিন ও অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতার আগমনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে কারাবরণ। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে পুনরায় গ্রেফতার। শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কারাবাস। ১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভ।

এরপর পাবনা থেকে পালিয়ে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। যুক্ত হন ন্যাপের রাজনীতিতে। সে সময় সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক আজাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক জনপদ, দৈনিক বঙ্গবার্তা ও দৈনিক বার্তায় চাকরি করেন। দুই পর্বে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হন। প্রথম পর্বে প্রতিমন্ত্রীর রোষে পড়ে সেখান থেকে সরে এসে যোগ দেন প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে (পিআইবি)।

দৈনিক বার্তায় কাজ করার সময় রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গী হয়ে বিদেশ সফরের সময় পোশাক-বিড়ম্বনার কারণে বিদেশ সফর থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করেন। তিনি চেয়েছিলেন, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে যাবেন কিন্তু রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব বলেছিলেন, ‘স্যুট পরে যেতে হবে’। (সূত্র: রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন: জেলাভিত্তিক ইতিহাস)

মে ১১, ২০১২ তে কামাল লোহানীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সময় আপনার বয়স কত ছিল?কামাল লোহানী: ৬ মে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের লক্ষ্যে আমি ঘর ছাড়ি। সে সময়ে আমার বয়স ছিল ৩৫ বছর।

প্রশ্ন : ১৯৭১ এর পূর্বে কোন আন্দোলনে আপনার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সমর্থন অথবা সম্পৃক্ততা ছিল? রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা সাংগঠনিক?কামাল লোহানী: ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক চেতনার শুরু। সে সময়ে আমি পাবনা জেলা স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ১৯৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে আমাকে কারাগারে যেতে হয়। যুক্তফ্রন্টের পক্ষে ১৯৫৪ সালে কাজ করার সময় আবার গ্রেফতার হই। এ সময় আমার রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড একসঙ্গে মিলেমিশে যায়।

বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন যেমন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি; লড়াই করেছি, প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি।

সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। যেমন- ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী, গণশিল্পী সংস্থা, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী এছাড়া ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গেও ছিলাম।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে প্রধান যৌক্তিকতা কি ছিল আপনার?

কামাল লোহানী: মার্কসবাদী আদর্শ- মানুষের মুক্তির জন্য এবং দেশের মুক্তির জন্যই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রেক্ষাপট কি ছিল?কামাল লোহানী: বৈষম্য, পাকিস্তানিদের দুঃশাসনই মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ছিল। পাকিস্তানিদের অন্যায্যতা, নির্যাতন-নিপীড়ন, বৈষম্য আর দুঃশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।

প্রশ্ন : বিশেষ কোন ঘটনার পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন? কামাল লোহানী: ১৯৭১ এর মে মাসের শুরুতেই সাংবাদিকরা সিদ্ধান্ত নেন, সেনাবাহিনীর কোন সংবাদ ছাপা হবে না। সে সিদ্ধান্তের পর, বন্ধুরা বলছিল, ‘তোমার আর এখানে (দেশে) থাকা ঠিক হবে না। সে কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আবার কলকাতায় চলে যাওয়ার।’

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রধান প্রতিবন্ধকতা কি ছিল ? কীভাবে তা অতিক্রম করেন?কামাল লোহানী: স্ত্রী-সন্তানের প্রতি দায়িত্ব-ভালোবাসাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল। ১৯৭১ সালে স্ত্রী দীপ্তি লোহানী ছিলেন মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট স্কুলের শিক্ষক। মতিঝিল কলোনিতে থাকাকালীন গেরিলারা বিভিন্ন সময় বাড়িতে আশ্রয় নেন। পরিচিত কয়েকজন রাতে বাসায় থাকতেন, ভোরবেলায় চলে যেতেন। ফলে বিপদের আশঙ্কা ছিল। স্ত্রীর ভরসায়ই ছেলেমেয়েদের রেখে মে মাসের ৬ তারিখ কলকাতায় চলে যাই।

প্রশ্ন : কোন সেক্টরে যোগ দিয়েছিলেন?কামাল লোহানী: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগে যোগ দিয়েছিলাম। কলকাতা যাওয়ার পর কমরেড নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি আমাকে নিয়ে যান বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে বিদ্রোহী বেতার কেন্দ্র স্বাধীন বাংলা বেতারে। সেখান থেকেই ইথারে ছড়িয়ে পড়ত রণাঙ্গনের খবর, মুক্তিযোদ্ধাদের সফলতার প্রতিবেদন। ‘চরমপত্র’, ‘অগ্নিশিখা’, ‘দর্পণ’, ‘জল্লাদের দরবার’, ‘বজ্রকণ্ঠ’র মতো অনুষ্ঠান। পরবর্তীতে সেখানে বার্তা বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কে আপনাকে উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন? কামাল লোহানী: স্ত্রী-দীপ্তি লোহানী সব কাজের অনুপ্রেরণা ছিলেন। তার সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের।

প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার কোন রাষ্ট্রীয় পদক বা সনদ আছে কি?কামাল লোহানী: নেই ।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের কথা কবে জানতে পেরেছিলেন? কামাল লোহানী: ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর কিংবা ১৩ ডিসেম্বরের দিকে মনে হয়েছিল আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছি।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন উল্লেখযোগ্য কোন কার্যক্রম- যা মনে পড়লে আপনি অহংকার বোধ করেন ?কামাল লোহানী: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি যে খবরটি শোনার জন্য উন্মুখ হয়েছিল, সেই বিজয়ের খবরটি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। স্বাধীন বাংলা বেতারের বার্তা সম্পাদক ছিলাম। বার্তা বিভাগ থেকে আমার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল আমারই লেখা সেদিনের সেই বিশেষ বার্তাটি। সেটি আমার অহংকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা ছিল, ‘আমরা বিজয় অর্জন করেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।’

প্রশ্ন : সরকারের কাছে আপনার কোনো প্রত্যাশা রয়েছে কিনা?কামাল লোহানী: ব্যক্তিগত কোনো প্রত্যাশা নেই; তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। কামাল লোহানীর সাক্ষাৎকারের অধিকাংশ প্রশ্নই ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কিত; কিছু প্রশ্ন ছিল ব্যক্তিগত- সাধারণ তথ্য সম্পর্কিত। শৈশবে মাতৃহারা কামাল লোহানী সেদিন প্রশ্নোত্তরে বলেছিলেন, সারাজীবনের অনুপ্রেরণা- স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর কথা। এমনকি ২০ জুন, ২০২০ এ মৃত্যুর পরে সমাহিত হয়েছেন তিনি স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর কবরে।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সোনতলা গ্রামের কবরস্থানে তার বাবা মুসা লোহানী ও মা রিজিয়া লোহানীর কবরের পাশে স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর কবরে দাফন করা হয় তাকে। ছেলে সাগর লোহানী দাফনের আগে বলেন, ‘বাবা, কামাল লোহানী মৃত্যুর পর তার দেহ দান করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু করোনার সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর কারণে সে ইচ্ছা পূরণ করা যায়নি। তিনি চেয়েছিলেন আলাদা করে কবর খুঁড়ে যেন জায়গা নষ্ট করা না হয়।’

সাক্ষাৎকারগ্রহণ : মার্জিয়া লিপি : লেখক, গবেষক, পরিবেশবিদ

এইচআর/এমকেএইচ