ধর্ম

বাবার প্রতি সন্তানের করণীয়, ইসলাম কী বলে?

কারো বাবা বেঁচে আছে, কারো নেই। বাবা-সন্তানের আবেগ ও ভালোবাসা অতুলনীয়। তারপরও বাবার প্রতি ভালোবাসায় হাজারো কণ্ঠ গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে জনপ্রিয় একটি-

Advertisement

‘বাবা মানে হাজার বিকেল আমার ছেলে বেলা বাবা মানে রোজ সকালে পুতুল পুতুল খেলাবাবা মানে কাটছে ভালো যাচ্ছে ভালো দিনবাবা মানে জমিয়ে রাখা আমার অনেক ঋণ।’

আজ বাবা দিবস। প্রতি বছরের ন্যয় জুনের তৃতীয় রোববার, আজও পলিত হচ্ছে দিবসটি। যদিও কোনো দিবস উদযাপনে যেমন বাবার ঋণ পরিশোধ করার মতো নয়। আবার বাবার মর্যাদাও দিবস উদযাপনে হয় না। তারপরও হাল আমলে সমাজের অবহেলিত বাবার মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় দিবসটি গুরুত্ব অপরিসীম।

ইতিহাস মতে, ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় পালন করা হয় ফাদার্স ডে। তারপর অনেক পথ পেরিয়ে ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন জুন মাসের তৃতীয় রোববারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাবা দিবস’ নির্ধারণ করেন।

Advertisement

বাবা দিবস বরাবরই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি বিখ্যাত হাদিসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হাদিসটি হলো-যে ব্যক্তি তার বাবা-মাকে পেল কিন্তু তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না, তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত।’

সন্তানের জন্য বাবা-মার খেদমত, খোঁজ-খবর, আদর-যত্ন অনেক বড় ইবাদত। বাবা-মা সন্তানের জন্য জান্নাত। আবার বাবা-মার অনাদরেই পরকালের শাস্তি ও জাহান্নাম সুনিশ্চিত।

কম হোক আর বেশি; দিবসটি আসলে অনেকেই তাদের বাবাকে স্মরণ করেন। যদিও ইসলাম এমনটি চায়নি। বাবা যেমন ছেলেবেলায় সব সময় আদর-সোহাগ ও পরিশ্রমে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন। সন্তানের উচিত, বাবার প্রতি সদা সজাগ দৃষ্টি রাখা।

বাবার মর্যাদায় ইসলামের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কুরআনুল কারিমের ১৫ স্থানে বাবার প্রসঙ্গে ওঠে এসেছে। বাবা পরিবারের চালিকা শক্তির প্রধান। বাবা সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ বন্ধু, অভিভাবক ও উত্তম পথপ্রদর্শক। হাদিসে পাকে এসেছে-১. ‘বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন; আবার বাবার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।’২. ‘তুমি এবং তোমার সম্পদ, উভয়টিই তোমার বাবার।'৩. 'কিছু ব্যক্তির দোয়া মহান আল্লাহ ফেরত দেন না। তার মধ্যে এক ব্যক্তি হলো- সন্তানের জন্য বাবার দোয়া।'

Advertisement

পৃথিবীতে সন্তানের সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তার কথা শুধুমাত্র বাবা এবং মা-ই ভেবে থাকেন। এ জন্যই পৃথিবীর সকল ধর্মেই বাবা-মাকে সর্বাধিক সম্মান দিয়েছে। বাবার মর্যাদা-সম্মান রক্ষায় এবং তাদের সেবায় বেশ কিছু করণীয়ের প্রতি দিকনির্দেশনা দেয় ইসলাম। যা তুলে ধরা হলো-

১. বাবার কথা মেনে চলাবাবার কথা মেনে চলা জরুরি। কুরআন-হাদিসে এ মেনে চলার নির্দেশকে বলে- 'বিররুল ওয়ালেদাইন'। ইসলামের নির্দেশনা হলো- তারা (বাবা ও মা) যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো অন্যায় আদেশ না করবে ততক্ষণ তাদের কথা মেনে চলা।

২. উচু কণ্ঠে কথা না বলাবাবার সঙ্গে কথা বলার থেকে ভদ্র-নম্রভাবে কথা বলা। এমন ভাবে কথা না বলা; যাতে বাবা-মার শব্দের চেয়েও সন্তানের কথা শব্দ উঁচু হয়ে যায়। রাগ বা কর্কশ ভাষায় কথা বলা যাবে না। কুরআনের নির্দেশ হলো- তাদের সঙ্গে কোমল ভাষায় কথা বলতে হবে। তাহলো- 'যখন তোমরা তাদের (বাবা-মার) সঙ্গে কথা বলবে তখন তাদরে সঙ্গে ধমক দিয়ে কথা বলবে না।'

৩. সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মান করাহজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, কেউ যদি বাবার সামনে তার নিজের জামা-কাপড় ঝাড়া দেয়, ধূলো-বালি থেকে এটাকে (জামা-কাপড়কে) পরিষ্কার বা মুক্ত করার জন্য ঝাড়া দেয় তবে সে ক্ষেত্রে এ সন্তান বাবা (মার) অবাধ্যতার গোনাহে লিপ্ত হলেন। কবিরাহ গোনাহ তথা মহাপাপ করলেন। কারণ, জামা-কাপড় ঝাড়া দেয়ার মাধ্যমে সে বাবার প্রতি অসম্মান করলেন।'

সুতরাং বাবাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা যতভাবে করা যায়, সবভাবেই তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখানো। বাবা-মার সামনে এমন কোনো আচরণ করা যাবে না, যাতে তাদের প্রতি অশ্রদ্ধাবোধ বা অসম্মান হয়।

৪. সব বিষয়ে বাবার সঙ্গে পরামর্শ করাযে সন্তান শিশু-কিশোর বয়সে বাবার সঙ্গে সকাল-বিকাল কাটিয়েছে। পরবর্তী জীবনের প্রতিটি সময়ই বাবা হবে সন্তানের জন্য প্রধান পরামর্শদাতা। যে কোনো প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত কিংবা উপদেশ গ্রহণে বাবার সঙ্গে পরামর্শ করা সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

৫. বাবার জন্য ব্যয় করানিজ সম্পদ থেকে বাবা-মার জন্য ব্যয় করা। তাদের পেছনে যে কোনো ধরনের ব্যয় করা সন্তানের জন্য আবশ্যক। তাদের চলাফেরার জন্য যদি প্রয়োজন হয় তবে সন্তানের প্রতি হুকুম ও কর্তব্য হলো বাবা-মার জন্য খরচ করা। তাছাড়া বাবার ভরণপোষণের দায়-দায়িত্ব সন্তান হিসেবে আমাদের উপর বর্তায়। তাই বাবা মার পেছনে ব্যয় করা।

বাবার মৃত্যুর পর কণীয়১. বাবার জন্য বিশেষ ৩টি দোয়া করাবাবার প্রতি সন্তানের অন্যতম কর্তব্য হলো তার জন্য দোয়া করা। তার জীবদ্দশায় যেমন দোয়া করা, তেমনি তার মৃত্যুর পরও এ দোয়া অব্যাহত রাখা সন্তানের জন্য একান্ত আবশ্যক। কুরআনুল কারিমে বাবার জন্য বিশেষ ৩টি দোয়া এসেছে-> رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًاউচ্চারণ : ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।’অর্থ : (হে আমাদের) পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া কর; যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৪)

> رَبَّنَا ٱغْفِرْ لِى وَلِوَٰلِدَىَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ ٱلْحِسَابُউচ্চারণ : ‘রাব্বানাগফিরলি ওয়ালিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিলমুমিনিনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব।’অর্থ : ‘হে আমাদের রব! যেদিন হিসাব কায়েম হবে, সেদিন আপনি আমাকে, আমার বাবা-মাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪১)

> رَّبِّ ٱغْفِرْ لِى وَلِوَٰلِدَىَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيْتِىَ مُؤْمِنًا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَٱلْمُؤْمِنَٰتِ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّٰلِمِينَ إِلَّا تَبَارًۢاউচ্চারণ : ‘রাব্বিগফিরলি ওয়ালিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিমান দাখালা বাইতিয়া মুমিনাও ওয়া লিলমুমিনিনা ওয়াল মুমিনাত ওয়া লা তাযিদিজ জ্বালিমিনা ইল্লা তাবারা।’অর্থ : ‘হে আমার রব! আমাকে, আমার বাবা-মাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন আর আপনি জালিমদের ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না।’ (সুরা নুহ : আয়াত ২৮)

২. বাবার বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করাবাবা-মা জীবদ্দশায় যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছেন, চলাফেরা করেছেন, বাবা-মার সেসব বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের সঙ্গে উত্তম ও সুন্দর আচরণ করা।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, মক্কার এক রাস্তায় আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে এক বেদুঈনের দেখা হলো। আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে সালাম দিলেন এবং তিনি যে গাধার পিঠে আরোহণ করতেন, সে গাধটি তাকে আরোহণের জন্য দিয়ে দিলেন। তিনি তার মাথার পাগড়ীটিও তাকে দান করলেন।

তখন (উপস্থিত) আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাকে বললেন যে, আমরা তাকে বললাম-‘আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন। বেদুঈনরা তো অল্পেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়। (এতো দেওয়ার প্রয়োজন কী ছিল?)তখন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এ ব্যক্তির (বেদুইনের) বাবা ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর বন্ধু ছিলেন।আর আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, ‘কোনো ব্যক্তির সর্বোত্তম নেকির কাজ হচ্ছে তার বাবার বন্ধুর সঙ্গে সহমর্মিতার সম্পর্ক বজায় রাখা।’(মুসলিম)

৩. বাবার ঋণ পরিশোধ করাবাবার ঋণ পরিশোধ করা। বাবা-মা যদি কোনো ঋণ করে মৃত্যুবরণ করেন, তবে তা পরিশোধ করা সন্তানের জন্য আবশ্যক। কোনো সন্তানের সাধ্য থাকলে সে ঋণ পরিশোধে যথাযথ সচেষ্ট থাকতে হবে।

৪. বাবার অসিয়ত পূরণ করাবাবা-মা যদি ইসলামি শরিয়ত সম্মত কোনো ওসিয়ত করে যান তবে তা পূরণ করা সন্তানের ওপর আবশ্যক। হাদিসে এসেছে-হজরত শারিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, তাঁর মা তাঁকে তাঁর (মায়ের) পক্ষ থেকে একজন মুমিন দাসী আজাদ করার জন্য অসিয়ত করে যান। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা (তাঁর মৃত্যুর সময়) তাঁর পক্ষে একজন মুমিন দাসী আজাদ করার জন্য ওসিয়ত করে গেছেন। এখন আমার কাছে হাবশের 'নূবিয়্যা' অঞ্চলের একজন দাসী আছে। এরপর আগের হাদিসে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে, তাহলো-‘তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাঁকে আমার কাছে নিয়ে আস। রাবি বলেন, তখন আমি তাকে নিয়ে আস। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করেন- আল্লাহ কোথায়? সে বলে, আসমানে। এরপর তিনি জিজ্ঞাসা করেন- আমি কে? সে বলে, আপনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তাকে আজাদ করে দাও। সে মুমিন।’ (আবু দাউদ)

৫. বাবার জন্য দান করাহয়তো বাবা বেঁচে থাকতে সন্তানের যত্ন নিতে গিয়ে কিংবা কোনো কারণে দান-সাদকাহ করে যেতে পারেননি অথবা বেঁচে থাকলে হয়তো আরও বেশি দান-সদকাহ করতেন। সে জন্য বাবার পক্ষ থেকে সন্তানের উচিত বেশি বেশি দান করা। হাদিসে এসেছে-হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! হঠাৎ করে আমার মা মারা গেছেন এবং কোনো ওয়াসিয়ত করে যেতে পারেননি। আমার মনে হয়- তিনি যদি কথা বলতে পারতেন তাহলে ওয়াসিত করে যেতেন। এখন আমি যদি তার পক্ষ থেকে সাদকাহ করি তাহলে কি তিনি এর সাওয়াব পাবেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’।’ (মুসলিম)

৬. বাবার জন্য রোজা রাখাবাবা জীবিত নেই। যদি তাদের কোনো মানতের বা কাজা রোজা থাকে তবে তাদের পক্ষ থেকে এ রোজা পালন করার নির্দেশ রয়েছে হাদিসে। এতে তাদের মানতের ও কাজা রোজা আদায় হয়ে যাবে। এছাড়াও সন্তানরা তাদের উদ্দেশ্যে যে কোনো দিনে রোজা রাখতে পারেন। হাদিসে এসেছে-হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রোজার কাজা (যিম্মায়) রেখে যদি কোনো ব্যক্তি মারা যায় তবে তার অভিভাবক (রেখে যাওয়া সন্তান বা আপনজন) তার পক্ষ থেকে সওম বা রোজা আদায় করবে।’ (বুখারি)

তবে অনেক ইসলামিক স্কলার বাবা-মার জন্য সন্তানের রোজা রাখার বিষয়ে শুধু ফরজ ও ওয়াজিব রোজা রাখার বিষয়টি নির্ধারণ করেছেন। নফল রোজা রাখার ব্যাপারে কোনো প্রমাণ যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন।

৭. বাবা হজ ও ওমরাহ করামা-বাবার পক্ষ থেকে হজ ও ওমরাহ করা। বাবা-মার উদ্দেশ্যে হজ ও ওমরাহ করলে তা আদায় হয়ে যাবে। হাদিসে এসেছে-হজরত ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, জুহাইনা গোত্রের এক নারী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, আমার মা হজের মান্নত করেছিলেন; তবে তিনি হজ করার আগেই ইন্তেকাল করেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ করতে পারি?রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তার পক্ষ থেকে তুমি হজ আদায় কর। তুমি এ ব্যাপারে কি মনে কর যে, ‘যদি তোমার মার উপর কোনো ঋণ থাকত, তাহলে কি তুমি তা আদায় করতে না?সুতরাং আল্লাহর হক (হজের মান্নত) আদায় করে দাও। কেননা আল্লাহর হকই সবচেয়ে বেশি আদায়যোগ্য।’ (বুখারি)

তবে বাবা-মার পক্ষ থেকে হজ আদায় করার আগে নিজের হজ বা ওমরাহ আদায় করতে হবে। নিজের হজ-ওমরাহ আদায়ের পর বাবা-মার পক্ষ থেকে হজ ও ওমরাহ আদায় করবে।

৮. বাবার জন্য কুরবানিমৃত বাবার জন্য সাওয়াবের উদ্দেশ্যে সন্তনরা কুরবানি করতে পারবে। তাতে তারা সাওয়াবের অধিকারী হবে। হাদিসে এসেছে-হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানি করার জন্য দুই শিং বিশিষ্ট দুম্বা আনতে আদেশ দেন। যেটি কালোর মধ্যে চলাফেরা করতো (সেটির পায়ের গোড়া কালো ছিল)। কালোর মধ্যে শুইতো (পেটের নিম্নাংশ কালো ছিল)। আর কালোর মধ্য দিয়ে দেখতো (চোখের চারদিকে কালো ছিল)। সেটি আনা হলে তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন, ‘ছুরিটি নিয়ে এসো। তারপর বললেন, ওটা পাথরে ধার দাও। আমি (হজরত আয়েশা) ধার দিলাম। পরে তিনি সেটি নিলেন এবং দুম্বাটি ধরে শোয়ালেন। অতঃপর সেটা জবেহ করলেন এবং বললেন-بِاسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍঅর্থ : আল্লাহর নামে (জবাই করছি)। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মদ, মুহাম্মাদ পরিবার ও তার উম্মাতের পক্ষ থেকে এটা কবুল করে নাও। এরপর এটা কুরবানি করেন।’ (মুসলিম)

৯. বাবা আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাবাবা-মার আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা সন্তানের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে বিশ্বনবি বলেছেন-مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَصِلَ أَبَاهُ فِي قَبْرِهِ،فَلْيَصِلْ إِخْوَانَ أَبِيهِ بَعْدَهُ‘যে ব্যক্তি তার বাবার সঙ্গে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালোবাসে, সে যেন বাবার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সুসম্পর্ক রাখে।’ (ইবন হিববান)

১০. বাবা ঋণ পরিশোধ করাদুনিয়াতে বেঁচে থাকাকালীন সময়ে বাবা-মা কোনো ঋণ করার পর তা পরিশোধ করার আগে মারা গেলে সন্তানের জন্য আবশ্যক বাবা-মার ঋণ পরিশোধ করা। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঋণ পরিশোধ করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে-হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুমিন ব্যক্তির রূহ তার ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, যতক্ষণ না তা পরিশোধ করা হয়।’ (ইবনে মাজাহ)

এমনকি ঋণ পরিশোধ না করার কারণে জান্নাতের যাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যায়; যদি সে আল্লাহর রাস্তায় শহিদও হয়। হাদিসে এসেছে-‘যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দার ঋণ পরিশোধ না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (নাসাঈ, তাবরানি, মুসতাদরাকে হাকেম)

১১. বাবার কাজের কাফফারা আদায় করাশপথ, ভুলকৃত হত্যাসহ যে কোনো কারণে যদি বাবা-মার কাফফারা বাকি থাকে তবে তা আদায় করা সন্তানের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। হাদিসে এসেছে-হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গভীর রাত পর্যন্ত দেরি করে (ইশার নামাজ পড়ে)। এরপর তার পরিবারের কাছে গিয়ে দেখে যে, বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার স্ত্রী তার খাবার নিয়ে এলে সে সন্তানদের কারণে কসম করলো যে, সে খাবে না। পরে তার ভাবান্তর ঘটলো এবং সে খেয়ে নিল। তারপর সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসে ও তাঁকে এ ঘটনা বলে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি কোনো বিষয়ে কসম করে, পরে তার বিপরীতটিকে তা থেকে উত্তম মনে করে, সে যেন তা করে ফেলে এবং নিজের কসমের কাফফারা দেয়।’ (মুসলিম)

কাফফারার এ বিধান জীবিত-মৃত সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। যদি কোনো বাবা-মার এ রকম কোনো কাফফারা বাকি থাকে তবে সন্তানের ওপর তা আদায় করা আবশ্যক।

১২. বাবা-মার কবর জিয়ারত করাবাবা-মার কবর জিয়ারত করা সন্তানের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর মাধ্যমে সন্তান এবং মা-বাবা উভয়ই উপকৃত হয়। হাদিসে এসেছে-হজরত সুলাইমান ইবনে বুরাইদা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তার বাবার সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি তোমাদের কবর জিয়ারাত করতে নিষেধ করেছিলাম। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার মায়ের কবর জিয়ারত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা কবর জিয়ারত কর। কেননা, তা পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (তিরমিজি)

তবে কবর জিয়ারতে কোনো দিনকে নির্দিষ্ট না করা উত্তম। কবর জিয়ারত করার সময় এ দোয়া পড়া-السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ لَلَاحِقُونَ أَسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمْ الْعَافِيَةَউচ্চারণ :‘ আস-সালামু আলাইকুম আহলাদদিয়ারি মিনাল মুমিনিনা ওয়াল মুসলিমনিা ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু লা লাহিকুনা আসআলুল্লাহু লানা ওয়া লাকুমুল আফিয়াতি।’অর্থ : ‘হে ক্ববরবাসী ঈমানদার মুসলিমগণ! তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহর ইচ্ছায় আমরাও তোমাদের সাথে মিলিত হব। আমি আমাদের ও তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে নিরাপত্তার আবেদন জানাচ্ছি।’ (মুসলিম)

১৩. কোনো গোনাহের কাজ করে গেলে তা বন্ধ করাবাবা-মা বেঁচে থাকতে কোনো গোনাহের কাজের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে বা চালু করে গেলে তা বন্ধ করা আবশ্যক। হাদিসে এসেছে-হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে লোক সঠিক পথের দিকে ডাকে তার জন্য সে পথের অনুসারীদের প্রতিদানের সমান প্রতিদান রয়েছে। এতে তাদের প্রতিদান হতে সামান্য ঘাটতি হবে না। আর যে লোক বিভ্রান্তির দিকে ডাকে তার উপর সে রাস্তার অনুসারীদের পাপের অনুরূপ পাপ বর্তাবে। এতে তাদের পাপরাশি সামান্য হালকা হবে না।’ (মুসলিম)

সুতরাং বাবা দিবসে সব সন্তানের জন্য প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছোট্ট এ হাদিসটি বছরজুড়ে আমল করা জরুরি। তাহলো-'বাবার সন্তুষ্টিতেই রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি।'

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব সন্তানকে বাবার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করার তাওফিক দান করুন। বাবার জীবদ্দশায় যথাযথ তদারকির পাশাপাশি মৃত বাবার জন্য যথাযথ করণীয়গুলো আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/এমএস