রোদেলা হানিফ সুমি
Advertisement
“কাটে না সময় যখন আর কিছুতে/বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না/জানলার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা/মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না/ আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়...।” হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া এ গানটি সন্তানদের এক অসীম নস্টালজিয়ায় ডুবিয়ে দেয়।
বাবা, সন্তানের মাথার ওপর যার স্নেহচ্ছায়া বটবৃক্ষের মতো, সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয় তাকে, আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা হলো বাবা। বাবার তুলনা বাবা নিজেই। বাবা, সে তো বাবাই। যার কল্যাণে এই পৃথিবীর রূপ, রঙ ও আলোর দর্শন। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন।
‘মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোন ক্ষয়পিতৃস্নেহের কাছে হয়েছে মরণের পরাজয়’-
Advertisement
মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একটি ঘটনা সবাইকে হতচকিত করে। তা ছিল সম্রাট বাবর রোগগ্রস্ত পুত্র হুমায়ুনকে বাঁচাতে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তার নিজের জীবনের পরিবর্তে পুত্রের জীবন ভিক্ষার। সেই প্রতিজ্ঞার ফলে ধীরে ধীরে হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ওঠে। বিনিময়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সম্রাট বাবর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঙলা ছোটগল্পের অসাধারণ সৃষ্টি ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের নায়ক রহমত। রহমত দেশে রেখে আসা নিজের ছোট্ট মেয়ের স্মৃতিচিহ্ন বুকে ধারণ করে সওদা করে কলকাতার পথে পথে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “কাগজের ওপর একটি ছোট হাতের ছাপ। ফটোগ্রাফ নহে, হাতে খানিকটা ভূসা মাখাইয়া কাগজের উপরে তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে। কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতি বৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে-যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশুহস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধাসঞ্চার করিয়া রাখে”। ছেলে-মেয়ের প্রতি বাবাদের যে স্নেহ তার তুলনা শুধু বাবাই হতে পারেন আর কেউ নয়।
আজ রোববার বিশ্ব বাবা দিবস। আজকের দিনটি শুধুই বাবাদের জন্য। সারা বিশ্বের সন্তানরা পালন করবেন এই দিবস। পিতার প্রতি সন্তানের সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের জন্য দিনটি বিশেষভাবে উৎসর্গ করা হয়। সন্তানরা তাদের প্রিয় জন্মদাতার জন্য নানা উপহার কিনবে, দিবে। যাদের বাবা বেঁচে নেই, তারা হয়তো আকাশে তাকিয়ে অলক্ষ্যে বাবার স্মৃতি হাতড়াবে।
হাজারো কষ্ট সয়ে তিলে তিলে যে সন্তানকে বড় করেছেন একজন বাবা, তাকে ঘিরেই এদিন হবে ব্যতিক্রমী উৎসব। তবে বাবা কি শুধুই একটি বিশেষ দিনের জন্য! এরকম বিতর্ক থাকলেও এই বিশেষ দিনটিতে একটি লাল গোলাপ, একটি কার্ড অথবা ‘মাই লাভ ফর ড্যাড’ লেখা মগ নিয়ে শুভেচ্ছা জানালে বাবা তাতেই খুশি। বাবার চাহিদা এতটুকুই। ছোট-বড়, অখ্যাত-বিখ্যাত সবার কাছেই বাবা অসাধারণ। বাবার স্নেহ-ভালোবাসা সবারই প্রথম চাওয়া আর পাওয়া।
Advertisement
এনসাইক্লোপেডিয়ার মতে, জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বের প্রায় ৭৪টি দেশে বাবা দিবস পালিত হয়। তৃতীয় রোববার হিসাবে এ বছর ২০ জুন পালিত হচ্ছে বাবা দিবস। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানোর জন্যই এই দিবস।
সর্বপ্রথম বাবা দিবস পালন করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। তবে ঠিক কবে থেকে সেটি সঠিক জানা যায়নি। কেউ কেউ বলেন, ১৯০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় চার্চের মাধ্যমে দিনটির প্রচলন। অন্যরা বলেন, ওয়াশিংটনের ভ্যাঙ্কুবারে প্রথম বাবা দিবস পালন করা হয়। বাবা দিবসের প্রবক্তা হচ্ছেন সোনার স্মার্ট ডোড। ১৮৮২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। পিতা উইলিয়াম জেকসন ছিলেন কৃষক। ১৬ বৎসর বয়সে ডোড তার মাকে হারান। জানা যায় ষষ্ঠ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তিনি মারা যান।
ছয় ভাই বোনের মধ্যে সোনারই ছিলেন একমাত্র কন্যা। সোনার একসময় অনুভব করেন তাদের মানুষ করতে তার বাবাকে অনেক কষ্ট করতে হয়। সোনারের চোখে তার বাবা ছিলেন সাহসী, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগী একজন ভালো মানুষ। যিনি সন্তানের সুখের জন্য নিজের চাওয়া পাওয়া বিসর্জন দিয়েছিলেন। সোনার স্মার্ট বিয়ে করেন জন ব্রোস ডোডকে। তাদের সন্তান জ্যাক ডোড জন্মের কিছুকাল পরে সোনারের স্বামীও মারা যায়। তখন সোনার স্মার্ট ফিরে যায় তার বাবার কাছে। সেই থেকে বাবা আর মেয়েতে মিলেই পুরো জীবন পার করে দেয়। তাই বাবার প্রতি ভালোবাসা আর সন্মান জানাতে বাবা দিবস পালনের চিন্তা সোনারের মাথায় আসে।
১৯০৯ সালে মা দিবসের এক অনুষ্ঠানে সোনার অংশগ্রহণ করেন। তখন থেকে তিনি ভাবতে থাকেন মা দিবসের মতো বাবা দিবস নামে একটি দিন পালন করা উচিত। যেখানে মা’দের পাশাপাশি বাবাদেরও ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানানো হয়। ১৯১০ সালের ১৯ জুন প্রথম বাবা দিবস উদযাপিত হয় স্পোকেনস শহরে। শহরের তরুণ-তরুণীরা সাদা ও লাল দুটি করে গোলাপ নিয়ে যায় বাবা দিবস উৎযাপনের জন্য। লাল গোলাপ জীবিত পিতাদের শুভেচ্ছার জন্য, আর সাদা গোলাপ মৃত পিতাদের। এভাবে শুরু হয় পৃথিবীর সব বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার প্রচলন। কিন্তু এই দিনটিকে অনুমোদনের জন্য কংগ্রেস নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। পরে ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বিষয়টি অনুমোদন করেন। ১৯২৪ সালে প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কোলিজ এটিকে জাতীয় দিবসে রূপ দেন। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন রাষ্ট্রীয়ভাবে জুনের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস উদযাপনের ঘোষণা দেন। সোনারার উদ্যোগ সফল হয়। মূলত তার কারণেই বিশ্বে বাবা দিবসের সূচনা।
সাধারণত সন্তানের বেশিরভাগ আবদার মা’র কাছে হলেও জন্মের পর থেকে এই আবদার পূরণের নেপথ্যে থাকেন মূলত বাবা। যার ত্যাগ ও তিতিক্ষায় ছোট্ট শিশুটি বেড়ে উঠে ধীরে ধীরে। জানতে পারে বাইরের জগৎকে। যিনি কর্মব্যস্ত দিনশেষে বাড়ি এসে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে যান সারাদিনের ক্লান্তিকর মুহূর্তগুলো। সন্তানের প্রতি বাবার যেমন ভালোবাসা তেমনি বাবার প্রতিও সন্তানের হৃদয়ে পুঞ্জীভূত থাকুক গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ। আজ বিশ্ব বাবা দিবসে এটাই কাম্য।
লেখক : শিক্ষার্থী।
এইচআর/ফারুক/এমএস