করোনা মহামারিতে বিশ্ব থমকে গেছে। ঘরে থাকতে থাকতে হাপিত্তেস অবস্থা! বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষ ঘরবন্দি প্রায় ১৫ মাস। উপায় নেই। পরিস্থিতি অন্যরকম থমথমে। তাই তো! কতদিন ঘরবন্দি থাকা যায়? বাইরের প্রকৃতির ছোঁয়া না পেলে কাহাতক ভালো লাগে? ভাবুন তো! এমন অবস্থায় যদি আপনার বসবাসের ছোট্ট ঘরটা গাছের ওই আগার ওপর হতো? ওখান থেকে যতদূর দুচোখ যায়, যেমন খুশি দেখাও যেত। আবার নিশ্বাসের অক্সিজেনের আকালের এই করোনাকালে বোনাস হিসেবে পাওয়া যেত অক্সিজেন। নিসর্গের চনমনে নিশ্বাসে ভরে উঠতো ফুসফুস? আর যদি ঘরটায় আপনি খেলতে পারতেন, যেমন খুশি, যখন যা খুশি করতে পারতেন। অন্যদের উৎপাত থেকে বাঁচতে পারতেন। তাহলে সত্যি দারুণ মজার হতো!
Advertisement
বাবুই পাখির ঝুলন্ত বাড়ি?ঝুলন্ত বাড়ি এখন আর পরীর রাজ্যের গল্প কিংবা স্বপ্নের কোন কল্পনা নয়। গাছের ওপর শুয়ে-বসে, ঘুমিয়ে উঠে পাহাড়-সাগর, বন-জঙ্গল, প্রাণি দেখার অপরূপ ব্যবস্থা এখন অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ অনেক দেশেই দেখা যায়। গাছের ঝুলন্ত বাড়িতে থেকে উপভোগ করা যায় সবুজ মাঠ-প্রান্তর, মুক্ত আকাশ, দিগন্তজুড়ে পাখিদের উড়ে চলা! বৃষ্টি-বর্ষাকে উপভোগ করার বিলাসবহুল হোটেল-রেস্তোরাঁয় যা যা থাকে, এখন সবই রয়েছে ঝুলন্ত গাছবাড়িতে। রয়েছে সোলার বিদ্যুৎ, আধুনিক ডিজিটাল দুনিয়ার ওয়াইফাই, স্মার্টটিভির আনন্দ-বিনোদনের সব সুবিধার বন্দোবস্ত। অবকাশ বিনোদনে, প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সান্নিধ্যে থাকার উপায় এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে? সাধারণ পথের ধারে আবাসিক হোটেলে না থেকে দুনিয়ায় এখন জঙ্গলের গাছের ওপর ঝুলন্ত বাড়িতে রাত্রি যাপন অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ ধরনের বাড়ি তৈরির জন্য ৬০০ একর অরণ্য ভূমি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়েছে ‘অস্ট্রেলিয়া মাউন্ট প্রাইভেট’ নামের এক কোম্পানি। ইন্দোনেশিয়ায় নারকেল বাগানে নারকেল গাছের ওপর রয়েছে এমন ঝুলন্ত গাছবাড়ি। এসব বাড়িতে থাকাও যায় আবার অতিথিরা ইচ্ছে করলে তাজা ডাব, নারকেল পেড়ে খেতে পারেন। ঝুলন্ত বাড়িতে অতিথি হয়ে যারা থাকেন; তারা সত্যিই ভাগ্যবান। আজকাল শুধু অবকাশ যাপন বা হানিমুন যাপনের জন্য ঝুলন্ত বাড়ি তৈরি হয় তা কিন্তু নয়। গাছের ওপর ঝুলন্ত বাড়ির ধারণা এতোটাই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে, আজীবনের বসবাসের জন্যও তৈরি করা হচ্ছে গাছের ডগায় ঝুলন্ত বাড়ি।
ঝুলন্ত বাড়ি কেন?পৃথিবীতে বাড়ছে মানুষ। প্রকট হচ্ছে আবাসন সমস্যা। উন্নত দেশগুলোয় আবাসন সমস্যা আরও মারাত্মক। শহর, বন্দর, গ্রাম সব এক সমান। সবখানেই ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থা। মুক্তভাবে প্রাণভরে নিশ্বাস গ্রহণের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ কোথাও নেই। প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের স্পর্শ পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার। সবখানেই নগর জীবন। এই নগর জীবনে হাঁপিয়ে উঠেও একটু জিরিয়ে নেওয়ার স্থান নেই। এজন্য ঝুলন্ত গাছবাড়ি নির্মাণে উৎসাহ দিতে ইংল্যান্ডে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। ইংল্যান্ডে আবাসন সমস্যা নিরসন কল্পে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে গাছ না কেটে, গাছ অবিকল রেখে, গাছের ওপর কাঠের ঝুলন্ত ঘর-বাড়ি বানানো সরকারিভাবে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই আপনার বাড়ির উঠোনেও যদি বড় কোন গাছ থাকে, তার ওপর আপনি ঝুলন্ত বাড়ি বানাতে পারেন। কেউ আপনাকে পাগল ভাবলে ভাবুক। সেটি মুখ্য বিষয় নয়। নিজের বাড়িতে একটা ঝুলন্ত গাছবাড়ি থাকলে সবচেয়ে ভালো। এজন্য আপনার অর্থ ও বুদ্ধি যা খরচ হবে, তা বৃথা যাবে না। তবে ঝুলন্ত গাছবাড়ি বানাতে গাছটি পুরোনো হতে হয় এবং সুন্দর দৃশ্যের নিসর্গ রয়েছে কি-না, তা আগেভাগে দেখে নেওয়া দরকার।
ঝুলন্ত বাড়ি কিভাবে বানানো হয়?আবাসন সমস্যার পড়িমরি অবস্থায় বিকল্প আবাসন তৈরি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন লন্ডনের ওয়েমাউথের টম ব্যারন। গাছ-গাছালির ওপর বাবুই পাখির মতো ঝুলন্ত বাসা বানিয়েছেন। গাছের সঙ্গে বিশেষ কায়দায় কাঠের তক্তা, বাঁকানো স্টিলের পাত দিয়ে মজবুত করে বেঁধে দ্বিতল বাড়িতে তৈরি করে নিয়েছেন বাথরুম, কিচেনসহ সব। ভবনের মেঝেও শক্ত। সেজন্য মোটা শক্ত কাঠের তক্তা ব্যবহার করা হয়েছে। রয়েছে ঠেস দিয়ে বসার ব্যবস্থা। রয়েছে পরিবেশ উপযোগী আচ্ছাদন। ভেতরে মনোমুগ্ধকর ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা। ভেতরে হাঁটা-চলার জন্যও রয়েছে প্রচুর ফাঁকা প্যাসেজ। উপর তলায় বেডরুম। নিচতলায় রয়েছে ডাইনিং, কিচেন রুম। প্রতিটি কক্ষের আয়তন দশ বাই আট ফুট। বেডরুমে বিছানা রাখা হয়েছে মাঝ বরাবর। ক্যাপসুলের মতো দেখতে বেডরুমের কেবিন খুবই রোমান্টিক করে সাজানো হয়েছে। বেডরুমের সঙ্গে বিশাল কাঁচের জানালা রয়েছে। এতে প্রকৃতি উপভোগের আনন্দ মেলে। দ্বি-কক্ষের বাড়ির ভেতরটা এমন করে বানানো যে, আপনি আসল বাড়িতে যেভাবে বসবাস করেন; সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে সবকিছু।
Advertisement
বাড়ির ভেতরে কী আছে? ঝুলন্ত বাড়িতে রয়েছে অরণ্যের নিরিবিলি পরিবেশ। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের আনন্দ। গাছের পাতায় পাতায় ঢাকা চারপাশ। অদূরেই রয়েছে সাগরের উত্তাল জলরাশি। সঙ্গে বিনা পয়সায় পাওয়া যায় মুক্ত বাতাস, মুক্ত অক্সিজেন। বাড়ির ভেতরে অনেক কিছু রয়েছে। সোলার, জেনারেটর লাগিয়ে ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাথরুম, টয়লেটে মোটরে পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও রয়েছে। রয়েছে কার্পেট, ভ্যাকিউম ক্লিনার সবকিছু। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক? কোন সমস্যা নেই। বিশ্বের খবর, বিনোদন এখানে বসেই পাওয়া যায়। এজন্য ওয়াইফাই, মিডিয়া, টেলিভিশন, স্যাটেলাইট সব রয়েছে। এখানে বসে উপন্যাস, কবিতা পড়তে চান? সেই ব্যবস্থাও রয়েছে। রয়েছে নানান ধরনের বই, পত্র-পত্রিকা। পড়তে পড়তে বাইরে তাকালেই দেখা যায় সবুজ পাতা, তাজা ফোটা ফুল, পাখির বাসা। কানে আসে পাখির শিস দেওয়া গান, জীব-জন্তু আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। অনেক দূরের সুন্দর পাখি, সাগর উপত্যকা, পাহাড় ভালো করে দেখার জন্য রয়েছে বাইনোকুলার যন্ত্র। এ যেন বাসা-বাড়ি নয়। রীতিমতো দ্বিতল স্বর্গীয় ভবন। দেখাদেখি এখন অনেকেই ঝুলন্ত বাড়ি তৈরি করেছেন। বছরের পর বছর ধরে এসব ঝুলন্ত গাছবাড়িতে বিবাহিত সুখী দম্পতিরা অবকাশ যাপন করতে হানিমুনে আসছেন। এসব বাড়িতে নেই ছিচকে চোরের উপদ্রব। চুরি প্রতিরোধের জন্য রয়েছে বিশেষ ইলেক্ট্রিক সিস্টেম। চোর ঢুকলেই সতর্ক ঘণ্টা বেজে ওঠে। আর নেই জমির মালিক, কর আদায়কারীর হম্বিতম্বি অত্যাচার।
শূন্যে ওড়ার আনন্দমুক্ত আকাশের দ্বিতল ঝুলন্ত বাড়ির বৈশিষ্ট্যই আলাদা। বাড়িতে ওঠার পথ বা সিঁড়ি প্রশস্ত ও চমৎকার। নিচু থেকে ধীরে ধীরে ছোট ছোট পদক্ষেপের সিঁড়ি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে। যাতে অনায়াসে ছোট শিশু বা বয়স্ক মানুষ সহজ পদক্ষেপে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে পারে। কোন ক্লান্তি না হয়। এসব বাড়িতে ওঠার সময় শূন্যে ওড়ার আনন্দ মেলে। এমন এক দ্বিতল ঝুলন্ত বাড়ির নাম- মুক্তচারণ। বাড়ির মালিক ব্যারন বলেন, ‘একজন অতিথি হিসেবে আপনি যদি এ ঘরে কয়েকদিন থাকেন, তাহলে আপনার মনটা অরণ্যের মাঝে চলে আসবে। ঘরের ভেতরেও রয়েছে বাইরের অরণ্যের উপলব্ধি। আনন্দে-আনন্দে প্রকৃতির সঙ্গে কেটে যাবে সপ্তাহ। এক সপ্তাহ থাকার পর বুঝবেন, কত আরামদায় জায়গা এটি। যা কখনো ভুলতে পারবেন না। আপন মনে নিজের ভাগ্যকে নিজেই ধন্যবাদ দেবেন। গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য এমন আদর্শ বাড়ি আর কোথাও হয় না।’
ইংল্যান্ডে ঝুলন্ত বাড়ি!বাড়ির মালিক মিস্টার ব্যারন আশৈশব জীবন সংগ্রামী মানুষ। একসময় ছিলেন পরিবাহী ট্রাক ড্রাইভার। এখন তার বয়স ত্রিশ। বাবুই পাখির মতো বাসা কেন বানিয়েছেন? উত্তরে জানান, ইংল্যান্ডের মাটিতে জন্ম নিলেও কবুতরের পা রাখার মতো ছিটেফোঁটা জমি নেই তার। শহরের কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। বেঁচে থাকার জন্য তিনি বাধ্য হয়ে বানিয়েছেন এই অভিনব বাড়ি। তিনি আশা করছেন, সাপ্তাহিক অবকাশ যাপনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবে তার বানানো দ্বিতল ভবন। দ্বিতল ভবনটি বানাতে সময় লেগেছে তিন মাস। খরচ পড়েছে প্রায় একশ পাউন্ড। তিনি বলেন, ‘ওয়েমাউথ তীরবর্তী আমার এই ভবনের ভাড়া ধরেছি সপ্তাহে বিশ পাউন্ড মাত্র। ভবিষ্যতে এগুলো আরও উচ্চমূল্যে ভাড়া দেওয়া যাবে।’ ভাড়ার ব্যাপারে ইতোমধ্যেই দরকষাকষি চলছে। ব্যারন আরও জানান, ‘আমি প্রথম যখন এই সাগর পাড়ে আসি; তখন শক্ত সাইজের গাছগুলো দেখে মাথায় আইডিয়াটা আসে। সবাই বাড়ি বানানোর জমি নাও পেতে পারেন। আমার এই বাড়িগুলো সপ্তাহিক অবকাশকালীন স্বাস্থ্যপ্রদ স্থান। নিরিবিলি এবং বায়ূ চলাচলের উন্মুক্ত ব্যবস্থাও রয়েছে।’
ভাড়া হবে ঝুলন্ত বাড়িএ ঝুলন্ত বাড়ি বানানোর পর ভাড়াটে খুঁজতে ব্যারন টু-লেট বিজ্ঞাপন টানিয়েছেন বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে। এছাড়াও তিনি ফেসবুক, টুইটারসহ সবখানে ফোন নাম্বার, লোকেশন দিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। বিভিন্ন মার্কেটে ‘ভাড়া হবে ঝুলন্ত বাড়ি, সাপ্তাহিক ভাড়া মাত্র বিশ পাউন্ড’ ইত্যাদি লেখা বিজ্ঞাপন শোভা পায়। মার্কেটে যেসব টুলেট বিজ্ঞাপন টানিয়েছেন, তার ভাষাটা এরকম- ‘শান্তিপূর্ণ সময় কাঁটাতে চান? কোনো চিন্তা নেই। এখানেই আসুন। কারণ আমার বাড়িতে প্রতিবেশীর জ্বালাতন নেই। নেই কারও খবরদারী।’
Advertisement
ঝুলন্ত বাড়িতে থাকতে চান?ঝুলন্ত বাড়ি মানেই আপনার ছোটবেলার স্বপ্নের বাড়ি। আপনি কি একটু পরীদের রাজ্য, অন্যরকম ফ্যান্টাসি কল্পনা জগতে থাকতে ও ভাবতে পছন্দ করেন? আপনার কি কখনো হঠাৎ করে সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে উধাও হতে মন চায়? নাগরিক জীবনে একঘেয়ে জীবনে বিষিয়ে উঠেছেন? ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে সমাজ থেকে কোথাও পালাতে চান? তাহলে আপনার জন্যই দরকার ঝুলন্ত ফ্যান্টাসি গাছবাড়ি। ব্যারনের ভাষায়, ‘সবাই ঝুলন্ত বাড়ি ভাড়া নেওয়ার যোগ্য নন। যাদের মন নড়বড়ে; তারা এখানে ভাড়া নিতে আসবেন না। ভাড়া নেবেন তারাই, যাদের মন খুব দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ ঝুলন্ত বাড়ি পৃথিবীর মাটি থেকে প্রায় ২৬ ফুট উঁচুতে। এসব স্থানে সাপের কোন ভয় নেই। ঝুলন্ত বাড়ি এমন এক রোমান্টিক অবসর যাপনের স্থান, যেখানে বাড়তি হিসেবে রয়েছে প্রকৃতি। ঝুলন্ত বাড়িতে থাকা জীবনের জন্য নিসন্দেহে দুর্দান্ত এক অভিজ্ঞতা। চলমান করোনা মহামারীর মধ্যে আপনি যদি ঝুলন্ত বাড়িতে অতিথি হতে চান, তবে নিরাপদে থাকার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে আগেভাগে নিশ্চিত করতে হবে।
এসইউ/এমএস