ডেভিড ব্রুস্টার
Advertisement
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তামূলক ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। একটি দরিদ্র সাহায্যপ্রার্থী দেশ থেকে আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশ হওয়ার পথে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সময় বাংলাদেশ ছিল ‘আপাত সম্ভাবনাহীন’ পৃথিবীর দরিদ্রতম একটি দেশ, যাকে হেনরি কিসিঞ্জার ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
তবে আজকের বংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের আত্মবিশ্বাসী একটি জাতি, যাদের রয়েছে রফতানিনির্ভর উদীয়মান এক অর্থনীতি, যা গত দুই দশক ধরে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ এর কারণে প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এলেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ এবং ২০২২ সালে এটা দাঁড়াবে ৭ দশমিক ২ শতাংশে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২২২৭ মার্কিন ডলার, যা প্রতিবেশী ভারত (১৯৪৭ ডলার) এবং পাকিস্তানের (১৫৪৩ ডলার) চেয়ে ঢের বেশি।
স্বাস্থ্য, গড় আয়ু, জন্মহার এবং নারীর ক্ষ্মতায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষা নির্দেশকগুলোর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের প্রদত্ত তথ্য-উপাত্তের যথার্থতা নিয়ে কিছু দ্বিমত আছে, তাছাড়া রফতানিতে আতিমাত্রায় গার্মেন্টসনির্ভরতা তাদের অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম।
Advertisement
বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনৈতিক স্থিতি নিয়েও কিছু শঙ্কা বিদ্যমান, যদিও ২০০৮ সাল থেকে (প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা একটি তুলনামূলক স্থিতিশীল বেসামরিক সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। তার বিরুদ্ধে বিরোধীদের দমন বা গ্রেফতারের অভিযোগ থকলেও তিনি এখনো সমান জনপ্রিয়। কিন্তু সমস্যা হলো—নিশ্চিত রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের কোনো পরিকল্পনা এখনো উপস্থাপন করেননি তিনি, যা কার্যকর বিরোধীদলবিহীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত দশকের মত আরও একবার পরোক্ষ সেনাশাসনের দ্বার খুলে দেয়ার শঙ্কা জাগায়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য এই অঞ্চলে তার ভূমিকায় কেমন প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না হলেও অনেক ‘আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়’ ঢাকার দৃষ্টি আকর্ষণে লড়ে যাচ্ছে। এদিকে উদ্বৃত্ত সম্পদের মাধ্যমে বাংলাদেশও তার প্রতিবেশীদের প্রভাবিত করছে।
কিছু দীর্ঘমেয়াদী অস্বস্তি সত্ত্বেও হাসিনা সরকার রাজনৈতিকভাবে ভারতের দিকে ঝুঁকে আছে, যা দেশটির ভৌগোলিক অবস্থানের বিপরীতে একটি বাস্তবিক সিদ্ধান্ত। উৎপাদন এবং অবকাঠামোখাতে জাপান বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বিনিয়োগকারী দেশ। তারা চীন থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। আর আমেরিকা বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমা শক্তির সামরিক মনোযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ বা কোয়াড-এ বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। কোয়াড হলো আমেরিকা, জাপান, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি সামরিক জোট। লি জিমিং বলেন, ‘এ ধরনের সিদ্ধান্ত চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বড়সড় ফাটল ধরাবে’। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন চীনা দূতের মন্তব্যকে দুঃখজনক এবং আক্রমণাত্মক বলে সমালোচনা করেছেন।
Advertisement
কোয়াডে যোগদানের বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যদিও কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না, তবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া একটি দেশ বেইজিংয়ের ধমকিকেও পাত্তা দেবে বলে মনে হচ্ছে না, তা সে যত গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগীই হোক না কেন।
যত বেশি শক্তি ততটাই বেশি আকর্ষণ, তাই বাংলাদেশও ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের মত সংগঠনের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক-সামরিক প্রভাব বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। যেখানে (ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়শনে) আগামী বছর থেকে নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ।
শ্রীলঙ্কাকে প্রদত্ত ঋণটি হবে বাংলাদেশের পক্ষ থকে অন্য কোনো দেশকে দেয়া প্রথম অর্থনৈতিক সহায়তা। ২০০ মিলিয়ন ডলারের এই ঋণ যেমন বাংলাদেশের ৪৫ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থনৈতিক সুস্বাস্থ্যের নির্দেশ করে, তেমনি কোভিড-১৯ পরবর্তী শ্রীলঙ্কার বিপজ্জনক অর্থনীতিকেও প্রতিফলন করে; যা (লঙ্কান অর্থনীতি) অত্যধিক বৈদেশিক ঋণ বিশেষ করে চীনা ঋণের ভারে ন্যুব্জ, যে ঋণ হয়তো কখনো শোধই করা যাবে না।
২০২০ সালে ভারতের কাছেও একই ধরনের ঋণ চেয়েছিল শ্রীলংকা, তাতে প্রত্যাখ্যাত হলে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে আংশিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে। যদিও এই ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়, তবে ধরে নেয়া যায় মিয়ানমার-রোহিঙ্গা ইস্যুতে বৌদ্ধপ্রধান শ্রীলঙ্কার সমর্থন পেতে এই ঋণ দিয়ে থাকতে পারে ঢাকা।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন আভিযান চালালে নয় লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এই ঘটনার পর থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। জান্তা সরকার যদি বাকি রোহিঙ্গাদেরও মিয়ানমার থেকে উৎখাতের ঘোষণা দেয়, তবে এই তিক্ততা আরও বাড়বে। অন্যদিকে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার ফলে দেশটি এখন গৃহযুদ্ধের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, যা বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার সামরিক সক্ষমতাও বাড়াতে সাহায্য করছে। চীন-রাশিয়ার মত পুরনো উৎস বাদ দিয়ে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী কিছু বড়সড় কেনাকাটা করতে যাচ্ছে। তারা ইতোমধ্যে তুরস্ক থেকে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সামরিক যান কিনেছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আমেরিকান এফ-১৬ অথবা ইউরো ফাইটার টাইফুন কেনার চিন্তা করছে, যা তাদের মিয়ানমারের ওপর সামরিক প্রাধান্য বিস্তারে সাহায্য করবে। চাইনিজ সাবমেরিনের পাশাপাশি তদের নৌবহরে আর কী কী নতুন সক্ষমতা যোগ হতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে অবশ্য পরিষ্কার ধারণা এখনো পাওয়া যায়নি।
এখন প্রশ্ন হলো—এসব তথ্য অস্ট্রেলিয়ার জন্য কী গুরুত্ব বহন করে? অস্ট্রেলিয়া হলো অল্প কয়েকটি দেশের মধ্যে অন্যতম, যারা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। রোহিঙ্গাদের জন্য বর্ধিত সহযোগিতা এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ত্রাণ পাঠালেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে তেমন কিছুই করেনি অস্ট্রেলিয়া। ১৯৯৮ থেকে ২০১৯, ২০ বছরেরও বেশি সময় পর কোনো অস্ট্রেলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী (২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে) বাংলাদেশ সফর করেছেন। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া তাদের বর্তমান সম্পর্ক শুধু ত্রাণ সহায়তার মাঝে আবদ্ধ না রেখে সামনে এগিয়ে নিতে কাজ করছে, অজি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেরিস পেইনকে এই ব্যাপারে (সফরকালে) খুবই উৎসাহী বলেই মনে হয়েছে।
দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বিষয়ক একটি চুক্তি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। যার ফলে অস্ট্রেলিয়ান বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে খনিজ, জ্বালানি এবং কৃষিপণ্য রফতানি করতে পারবে। তাছাড়া উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগরে নিরাপত্তা বিষয়ে দু’দেশের সম্পূরক স্বার্থ, প্রতিরক্ষা সামগ্রী রফতানিতেও বাংলাদেশ নিজেদের একটি সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে বিবেচনার সুযোগ করে দিচ্ছে।
পুরনোদের পাশাপাশি নতুন অংশীদারদের নিয়ে কাজ করলে অস্ট্রেলিয়া ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান ‘মাধ্যমিক শক্তি’র সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত, যা শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ককে আরও বেশি পরিপূরক করে তুলবে।
লেখকডেভিড ব্রুস্টারসিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় কৌশলগত সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজ, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এএনইউ)
(ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজ কর্তৃক গৃহীত ভারত মহাসাগরকেন্দ্রিক দুই বছরের একটি প্রকল্পের আওতায় অস্ট্রেলিয়ান ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্সের সহায়তায় দ্য ইন্টারপ্রিটারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ)
ভাষান্তর : মিরকান মিশুক
এইচএ/এমএস