প্রায় ছাব্বিশ বছর ময়মনসিংহ শহরে অতিবাহিত করার পর হঠাৎ একদিন জগলু মিয়া তার জীবনের স্বপ্ন-সাধ-আকাক্সক্ষা ও উন্নতির আশাবাদ দিয়ে ফুসফুস উজাড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। জগলু মিয়ার স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন পাশেই ছিল। সে জিজ্ঞেস করে,: কী হইল!-ত্যাগ করলাম।: কী ত্যাগ করলা! ধূমপানের বদঅভ্যাস?-না।: তাইলে কি কিপটামির কুঅভ্যাস?- না। আম্বিয়া খাতুন কপালে ভাঁজ ফেলে সরু চোখে তাকায়। তারপর কপট রাগের ভঙ্গিতে দুই ঠোঁটের ফাঁকে প্রশ্রয়ের হাসি মেখে বলে,: আগেরবারের মতন কাপড় নষ্ট কইরা ফেল নাই তো!-আরে ধুর! অইসব কিছু না। : তাইলে তোমার ত্যাগের বিষয়টা কী?-বিষয় আয়-উন্নতি। নিজের ভবিষ্যৎ লইয়া মনের মধ্যে যে স্বপ্নসাধ ছিল, আইজ থেইকা তারে ঝাইড়া-পুইছ্যা ত্যাগ করলাম। : কুনু জ্যোতিষীর কাছে গেছিলা?-না। সেলফ সার্ভিস।আম্বিয়া খাতুন হা-হা করে হাসে। তারপর বলে,: এইটা বুঝতে তোমার জীবনের বেশিরভাগ টাইম পার করন লাগল? আমি তো বিবাহের পরের সপ্তাহেই বুইঝা ফেলছি।-কী বুইঝা ফেলছ?: তোমার জীবনে উন্নতির কোন সম্ভবনা নাই। লোকাল ট্রেনের মতন মমিসিং টু মোহনগঞ্জ আপডাউন করতে করতেই তোমার জিনেন্দি পয়মাল হইয়া যাব। আম্বিয়া খাতুনের কথা নিমের পাতার মতো তেঁতো হলেও মিথ্যা নয়Ñ মনে মনে তা স্বীকার করে নেয় জগলু মিয়া। আড়াই বগির লোকাল ট্রেনের মতো শুরু আর শেষের স্টপেজের মাঝখানে যাওয়া-আসা করতে করতে জীবনের চারভাগের তিনভাগ সময় এর মধ্যে খরচের খাতায় উঠে গেছে। এখন আর কিছু হবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে শরীরের নানা জায়গা থেকে সিগন্যাল আসা শুরু হয়েছে।
Advertisement
আজ বাতের ব্যথা, কাল হাইপ্রেসার, পরশু বুকে চিনচিন। অথচ সম্ভাবনার লাল সূর্যটা হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়েই পথচলা শুরু হয়েছিল জগলু মিয়ার। একটা সরকারি অফিসে চাকরি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সে বুঝতে পারল, এই অফিস হচ্ছে ঘুষের স্বর্গরাজ্য। জগলু মিয়া পণ করেছিল, কোন অবস্থাতেই সে ঘুষের টাকা হাতে নেবে না। জগলু মিয়ার হাবভাব লক্ষ্য করে তার এক সহকর্মী একদিন তাকে প্রশ্ন করে,: ভাই কী পীরবংশ?-না।: তাহলে সমস্যা কোথায়?- কিসের সমস্যা?: পুরা অফিস চলে এক ভাঁজে আর আপনি একাই সাইড মাইরা অন্য ভাঁজে থাকেন। বিষয় কী?- ঘুষের কারবারে আমি নাই।: বিবাহ করেছেন?- করছি। : বউ কিছু বলে না?- তারে এই ব্যাপারে নাক গলাইতে নিষেধ করছি।: আপনি অফিসের কলংক; ঘরেরও কলংক। এই কন্ডিশনে চলাফেরা করলে তো চাকরির টাকায় চাল কিইন্যা বেশিদিন ভাত খাইতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত সহকর্মীর কথাই সত্য হল। সততার পুরস্কার হিসেবে ছত্রিশ ঘাটের পানি পান করতে করতে জগলু মিয়ার পেট ফুলে ঢোল হওয়ার উপক্রম হওয়ায় জীবনের মায়ায় চাকরির মায়া ত্যাগ করল সে। কিছুদিন বেকার হয়ে বসে থাকার পর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় গলির মোড়ে একটা দোকান ভাড়া নিয়ে হ্যান্ডিক্রাফটের ব্যবসা শুরুর পরদিনই পাড়ার উদীয়মান এক মাস্তান এসে জগলু মিয়ার সামনে পিস্তল রেখে হাত কচলাতে কচলাতে বলে,: দাওয়াত পাইলাম না!- কিসের দাওয়াত?: মিলাদের।-দাওয়াত দিয়া তো মিলাদ পড়ান হয় নাই। জুম্মার নামাজের পরে যে কয়জনরে পাইছি, তাদের লইয়াই সূরা-কালাম পাঠ করা হইছে। : ভালো করছেন। নতুন কিছু শুরু করার আগে আল্লাহ-রসুলের নাম লওয়া অতি উত্তম। আমি আপনের সামনে যে মালটা রাখছি, এইটাও নতুন। আজই আমার হাতে আসছে। এ উপলক্ষে আমিও একটা মিলাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিছি। বেশি না, এই ধরেন হাজার দশেক...-দুঃখিত, আমি দশ টাকাও দিব না।দুঃখিত হওয়ার পরিণাম শুভ হল না। প্রথমে দোকানের গ্লাস ভাঙল। এরপর জিনিসপত্র ও ক্যাশবাক্স লুট করা হল। তৃতীয় দফায় যখন জগলু মিয়ার জানের ওপর চোট পড়ল, তখন বাধ্য হয়ে তাকে নিজ এলাকা ছেড়ে অনেক দূরে হিজরত করতে হল। জগলু মিয়া দেখল, এই দেশে সৎ থাকা অতিশয় কঠিন। এই কঠিনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার চেয়ে বরং সংসারত্যাগী হয়ে জঙ্গলে গিয়ে বসবাস করাই ভালো। তবে শেষ পর্যন্ত জগলু মিয়ার জঙ্গলবাসী হওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ লাভ করল না। বিষয়টি আম্বিয়া খাতুন জেনে ফেলায় শ্বশুরবাড়ির লোকেরা একটা ছাপাখানায় তার চাকরির ব্যবস্থা করে দিল। এখানেই একদিন স্কুলজীবনের বন্ধু দুলাল মৃধাকে দেখে জগলু মিয়া ভীষণ অবাক হল। বলল,: আরে তুমি! কী ব্যাপার?-ইলেকশনের পোস্টার ছাপাইতে আসছি।: কার পোস্টার?- আমার নিজের।: তুমি পোস্টার ছাপাইয়া কী কর?- এলাকার জনগণের স্বার্থে উপনির্বাচনে ফাইট দিতেছি।: তুমি এখন কী করতেছ?-কী বললা?: বললাম, তোমার পেশা কী?- পেশা মহান।: মানে?- মানে হইল, আমি মহান পেশার সঙ্গে যুক্ত আছি। : বুঝলাম না।- রাজনীতি বোঝ? আমার পেশা হইল রাজনীতি। : আর কিছু কর না?- অন্যকিছু করার টাইম কোথায়?: তোমার সংসার চলে ক্যামনে?-সংসার পরিচালনার ভার জনগণের হাতে ছাইড়া দিছি। তারা খুশি হইয়া নিয়মিত যা দেয়, মাশালাহ সংসার মেইনটেন করার পরও ব্যাংকে কিছু জমা থাকে। এছাড়া টুকটাক সাইড বিজনেস তো আছেই।: কী রকম?-এই ধর, থানা-পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা, সালিশ-দরবার ইত্যাদি ব্যাপারে জনগণরে যে সার্ভিস দেই, সেইখান থেইকাও পার্সেন্টেজ আসে।: তার মানে তুমি ভালোই আছ?-তা আছি একপ্রকার। কিন্তু তোমার জিয়োগ্রাফি দেইখ্যা তো মনে হইতেছে তুমি ফিনিস। অথচ আমাদের ক্লাসে তুমি ছিলা সেরা ছাত্রদের একজন। আর আমি? আমি ছিলাম ডাব্বামারা ছাত্র। আইজ আমি জনগণের দোয়ার বরকতে নিজের ছবিসহ যে পোস্টার ছাপাইতে আসছি, সেই পোস্টারের ডেলিভারি দিবা তুমি। দোস্ত! বিষয়টা মাইন্যা নিতে আমার খুবই কষ্ট হইতেছে।দুলাল মৃধার কথার কোন উত্তর না দিয়ে জগলু মিয়া কাজের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলে,: পোস্টারের মাল-মেটারিয়ালস কী আনছÑ দেখাও।দুলাল মৃধা হাতে লেখা একটা কাগজ আর নিজের একটা ছবি বের করে জগলু মিয়ার সামনে রাখে। জগলু মিয়া লেখাগুলো পড়ার পর ছবি হাতে নিয়ে একবার দুলাল মৃধার দিকে, একবার ছবির দিকে তাকায়। কয়েকবার এরকম করতেই দুলাল মৃধা বলে,: ছবিতে কোন সমস্যা হইছে?-ছবিতে তোমার কপালে কালো একটা দাগ দেখতেছি। কিন্তু বাস্তবে তো এরকম কিছু দেখা যাইতেছে না?জগলু মিয়ার কথায় দুলাল মৃধা রহস্যময় ভঙ্গিতে তাকায়। তারপর হাসতে হাসতে বলে, : ছবি তোলার আগে কপালে হালকা কালির একটা পোছ দিছিÑ যাতে পাবলিক আমারে পরহেজগার মনে করে। - মানে কী?: মানে বুঝলা না? জনগণ চায়, জনপ্রতিনিধি হিসেবে তারা যাদের নির্বাচিত করবে, তারা যেন সৎ হয়, স্বভাব-চরিত্র ভালো হয়, ধার্মিক হয়। এই জন্যই আমিও সামান্য চালাকির আশ্রয় নিছি।- মানুষ যদি তোমার চালাকি বুইঝা ফেলে?: বুঝতে বুঝতে অটোমেটিক্যালি আমার কপালে কালো দাগ পইড়া যাবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে থেইক্যাই পাঁচওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়া শুরু কইরা দিছি। -কিন্তু এইটা তো অভিনয়?জগলু মিয়ার কথা শুনে দুলাল মৃধা হেঁচকি তোলে হাসে। তারপর চেহারায় একটা দার্শনিক ভাব ফুটিয়ে তুলে বলে,: দোস্ত! এই দেশের রাজনীতি হইল একটা অভিনয়ের জগত। এই জগতে সফল হইতে হইলে ভালো অভিনেতা হওয়ার কোন বিকল্প নাই।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস
Advertisement