মা-বাবা, ছোট ভাই-বোনের সঙ্গে বসবাস সুমাইয়ার। বয়স সবেমাত্র নয় বছর। এ বয়সেই সুমাইয়াকে ধরতে হয়েছে পরিবারের হাল। বাবা উপার্জনক্ষম হলেও প্রায়ই কাজ থাকে না। অসুস্থ মায়ের জন্য প্রতিদিন কয়েকশ’ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। বাড়িতে আছে আরও এক ছোট বোন। বড় পরিবারের দায়িত্বের বোঝা ছোট্ট সুমাইয়ার কাঁধে।
Advertisement
প্রতিদিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সুমাইয়া রওনা দেয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। হাতে কাগজের বক্সে মাস্ক। সঙ্গে টাকা রাখার ছোট্ট ব্যাগ। মাস্ক নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দিন পার করে সুমাইয়া। কেউ তার কাছ থেকে মাস্ক কিনুক আর না কিনুক, ছোট্ট সুমাইয়ার মুখে সবসময় লেগে থাকে মায়াবী হাসি।
বুধবার (১৫ জুন) বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দেখা সুমাইয়ার সঙ্গে। মাস্ক কিনবো কি-না সে কথা না জিজ্ঞেস করেই সে বলল, ‘ভাইয়া, কেমন আছেন।’ এরপর বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। শৈশবের দুরন্তপনায় যার মেতে থাকার কথা ছিল, তার এমন বোঝা বয়ে বেড়ানোর কাহিনী শোনার প্রচেষ্টা।
সুমাইয়া জানাল, পরিবারে বাবা নেই। মায়ের সঙ্গে ভাই-বোনদের নিয়ে থাকতে হয়। মাঝে অসুস্থ মায়ের অপারেশন করা লেগেছিল। তবে ঠিক কী ধরনের অপারেশন, সেটা বোঝেও না সে। প্রতিদিন যে রোজগার তা গিয়ে মায়ের হাতে তুলে দেয় সুমাইয়া। এর থেকেই পরিবারের দু’বেলা খাবারের পাশাপাশি মায়ের জন্য ওষুধের ব্যবস্থা হয়।
Advertisement
সুমাইয়ার মতো ছিন্নমূল শিশুদের অনেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা চা, বাদাম, চকলেট, সিগারেট ইত্যাদি বিক্রি করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকাতেই থাকে। কারো বাবা নেই, কারো মা নেই। কেউ থাকে নানা-নানির সঙ্গে।
তেমনি আরেক শিশু মাকাদুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী আমবাগান এলাকায় মায়ের সঙ্গে নানা-নানির বাড়িতে থাকে সে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর মায়ের সঙ্গে এখানে আসে সে। মা বাসা-বাড়িতে কাজ করে বেড়ায়। আর মাকাদুল প্রতিদিন চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে আসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসের এদিক-সেদিক শিক্ষার্থী থেকে দর্শনার্থী সবার চায়ের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে ব্যস্ত থাকে সে।
মাকাদুল বলছিল, এই সময়ে তো খেলতে, পড়তে খুব ইচ্ছে হয়। উপায় তো নেই। তাই চা বিক্রি করি। পড়াশোনা এখন একদমই বন্ধ। যখন ক্যাম্পাস খোলা ছিল, তখন ক্যাম্পাসের বড় ভাইয়ের আমাদের ফ্রিতে পড়াতেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ছিন্নমূল ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে এক যুগ ধরে কাজ করছে ‘তরী’ নামের একটি সংগঠন। সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র, অসহায়, ছিন্নমূল ও পথশিশুদের পাঠদানের মাধ্যমে শুরু হলেও বর্তমানে তরী শিশুদের খাতা-কলম, ব্যাগ, স্কুলের পোশাক, শীতের পোশাক ও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবার ওপর পরিচালিত এ সংগঠনের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
Advertisement
তরীর সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী জাকিরুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের পাঠদান আপাতত বন্ধ রয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতিতে যেসব শিশু-কিশোরদের পরিবার খুবই অসহায় দিনযাপন করছে, তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া বন্ধের মধ্যে তাদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ক্যাম্পাস খুললে আমাদের সব কার্যক্রম পুরোদমে আবারো শুরু হবে।
ফারুক হোসাইন/এএএইচ/জিকেএস