ধর্ম

হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা থেকে মুক্তির উপায় কী?

আল্লাহ সবচেয়ে বেশি নারাজ হন মানুষের ক্ষতি করলে। আর তা যদি হয় জীবনহানি, গলাকেটে কিংবা নির্যাতনে হত্যা; তা কতই না জঘন্য! সম্প্রতি একটি বিষয় বেশি লক্ষণীয় যে, নিজ সন্তানকে হত্যা করছে মা-বাবা; কোথাও বাবা তার স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যা করছে। আবার কোথাও নিঃষ্পাপ সন্তানসহ মা কিংবা বাবার গলাকাটা লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এর চেয়ে মারাত্মক ও দুঃখজনক হত্যাকাণ্ড আর কী হতে পারে? চিন্তা করা যায়! পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিকারের উপায়ই বা কী?

Advertisement

কুরআনের বিধানের বাস্তবায়নেই সম্ভব অবৈধ হত্যাকাণ্ড রুখে দেওয়া। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে কুরআনে শিক্ষার প্রতিফলন ঘটানো। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে অবৈধ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত অপরাধ, শাস্তির পাশাপাশি দুনিয়াতে এ অপরাধের প্রতিকারও তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى الْحُرُّ بِالْحُرِّ وَالْعَبْدُ بِالْعَبْدِ وَالأُنثَى بِالأُنثَى فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاء إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ ذَلِكَ تَخْفِيفٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَرَحْمَةٌ فَمَنِ اعْتَدَى بَعْدَ ذَلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌহে ঈমানদারগন! তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কেসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তির বদলায়, দাসের বদলায় দাস আর নারীর বদলায় নারী। অতঃপর তার ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কাউকে কিছুটা মাফ করে দেওয়া হয়, তবে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং ভালভাবে তাকে তা (ক্ষতিপূরণ) প্রদান করতে হবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে সহজ এবং বিশেষ অনুগ্রহ। এরপরও যে ব্যাক্তি বাড়াবাড়ি করে, তার জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আজাব।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৭৮)

অবৈধ হত্যাকাণ্ড মানবতা হত্যার শামিল। কুরআন ও হাদিসে অবৈধ হত্যাকাণ্ডকে পৃথিবী ধ্বংসের চেয়েও মারাত্মক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়; সেখানেই মহান আল্লাহর অভিশাপ নাজিল হয়। হত্যাকাণ্ডের পরিণাম সম্পর্কে মহান আল্লাহ কুরআনুল কারিমে তুলে ধরেছেন-وَمَن يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম। তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ভীষণ শাস্তি।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৯৩)

ইসলামে অবৈধ হত্যাকাণ্ড দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় কবিরাহ গোনাহ। শিরকের পরেই যার স্থান। ইমাম শামসুদ্দিন আয-যাহাবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর কবিরাহ গোনাহ বই-তে হত্যাকাণ্ডকে দ্বিতীয় স্থানে উল্লেখ করেছেন। অথচ মানুষ জঘন্য এ কাজ তথা হত্যাকাণ্ড কত সহজেই না ঘটিয়ে ফেলছে!

Advertisement

যারা দুনিয়াতে অবৈধ হত্যাকাণ্ড ঘটাবে কেয়ামতের দিন তাদের দ্বিগুণ শাস্তি হবে। আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে কুরআনুল কারিমের অন্য স্থানে ঘোষণা করেন-وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَن يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا - يُضَاعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيهِ مُهَانًا‘আর যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য উপাস্যের ইবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতিত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না; যারা এ (৩)কাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুন হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে।’ (সুরা ফুরকান : আয়াত ৬৮-৬৯)

মানুষের রক্তের মর্যাদামানুষ ও মানুষের রক্তের দাম আল্লাহর কাছে অনেক বেশি ও মর্যাদার। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছোট্ট একটি হাদিসে তা সুস্পষ্ট। তিনি বলেছেন-‘একজন মুমিনের রক্তের মূল্য কাবা ঘরের চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদার।’

নিরাপরাধ ব্যক্তির রক্তের মর্যাদার কথা তুলে ধরে বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ‘৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানের সময়, মাস ও স্থান যতবেশি মূল্যবান; আল্লাহর কাছে নিরাপরাধ মুমিন ব্যক্তির রক্ত আরও বেশি মূল্যবান।’

কি নির্মমতা!দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের কারণে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলছে মানুষ। এমনকি এ নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পায় না শিশু-কিশোর কিংবা নিজ স্বামী/স্ত্রী এবং অবুজ সন্তান।

Advertisement

বিনা কারণে হত্যাকাণ্ড ইসলামে হারাম। হত্যাকারীরা আল্লাহর রহমতের ছায়া থেকেও বঞ্চিত হয়। তবে ইসলাম ৩ শ্রেণির মানুষকে হত্যার নির্দেশ দেয়। হাদিসে এসেছে-প্রিয় নবি মুহাম্মাদুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি এ সাক্ষ্য দেয় যে- আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ (সত্য উপাস্য) নেই; আমি (মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসুল। এ ব্যক্তিকে ৩ টি কারণ ব্যতিত হত্যা করা যাবে না। তাহলো-১. যদি সে অন্যায়ভাবে অন্য কাউকে হত্যা করে;২. বিবাহিত হয়েও ব্যভিচার করে;৩. ইসলাম গ্রহণ করার পর তা পুনরায় পরিত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়।’ (বুখারি ও মুসলিম, মিশকাত)

নিরাপরাধ মানুষ হত্যার পরিণামনিরাপরাধ মানুষকে হত্যা বা রক্তপাতে ৫টি শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হত্যার শাস্তি যে কত জঘন্য তা প্রমাণেই আল্লাহ তাআলা আয়াত নাজিল করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-وَمَن يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম। তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ভীষণ শাস্তি।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৯৩)

আয়াতের ব্যাখায় তা সুস্পষ্ট-১. হত্যার প্রতিদান হচ্ছে জাহান্নাম।২. হত্যাকারী জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে।৩. আল্লাহ হত্যাকারীর ওপর রাগান্বিত হবে।৪. আল্লাহ হত্যাকারীর প্রতি লানত তথা অভিশাপ দেবেন।৫. হত্যাকারীর জন্য থাকবে কঠিন শাস্তি।

মনে রাখতে হবেপ্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষণা অনুযায়ী, কেয়ামতের দিন হত্যার বিচার দিয়ে আল্লাহর আদালতের কার্যক্রম শুরু হবে। হাদিসে এসেছে-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন মানুষের মাঝে সর্বপ্রথমে যে বিষয়ে ফয়সালা হবে; তাহলো রক্তপাত বা হত্যা।’ (বুখারি-মুসলিম ও মিশকাত)

আবার দুনিয়াতেও হত্যাকাণ্ডের বিধান দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। এ হত্যাকাণ্ড যেমন হৃদয়বিদারক তেমনি এর বিধানও অনেক কঠিন। আল্লাহ তাআলার বিধানে নিরাপরাধ হত্যাকাণ্ডের বিচার এমন- ‘স্বাধীন ব্যক্তি হত্যার বদলায় স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা কর; দাসের বদলায় দাস, নারীর বদলায় নারীকে হত্যা করা।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৭৮)যাতে মানুষ মানবতা হত্যার মতো মহা অন্যায় কাজ হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত থাকে সে জন্যই কেসাসের এ বিধান দেওয়া হয়েছে।

হজরত ওসমানের কণ্ঠে হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা!হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে যখন বিদ্রোহীরা ঘিরে ফেলে, তখন হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর কাছে গিয়ে বলেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন! আমি আপনার পক্ষ হয়ে আপনার বিরুদ্ধাচরণকারীদের বিরুদ্ধে লড়তে এসেছি।আপনি লক্ষ্য করুন যে, পানি এখন আপনার মাথার ওপরে ওঠে গেছে। সুতরাং এখন তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।`এ কথা শুনে হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তুমি কি সব লোককে হত্যা করার প্রতি উত্তেজিত হয়েছ! যাদের মধ্যে আমিও একজন?হজরত আবু হুরায়রা উত্তরে বললেন ‌‘না, না।’তখন খলিফা বললেন, ‘জেনে রেখ! ‘তুমি যদি একজন লোককেই হত্যা কর; তবে যেন তুমি সব লোককেই হত্যা করলে। যাও, ফিরে যাও। আমি চাই যে, আল্লাহ তোমাকে পুরস্কৃত করুন, পাপকার্যে লিপ্ত না করুন।` এ কথা শুনে হজরত আবু হুরায়রা ফিরে গেলেন, যুদ্ধ করলেন না। এর ভাবার্থ হচ্ছে এই যে, হত্যা হচ্ছে পৃথিবী ধ্বংসের কারণ।’

সুতরাং অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা নয়, বরং এ জঘন্য অপরাধ তথা কবিরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকাই মানুষের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সম্প্রতি সময়ের এসব অবৈধ জঘন্য ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড থেকে জাতিকে বাঁচাতে প্রয়োজন কার্যকরী পদক্ষেপ। আর কুরআনের হত্যার বিধান বাস্তবায়নেই তা পুরোপুরো রোধ করা সম্ভব। বন্ধ হবে অবৈধ সব হত্যাকাণ্ড।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হত্যার মতো জঘন্য কবিরাহ গোনাহ থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। অবৈধ সব হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন থেকে জাতিকে নিরাপদ রাখতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কুরআনের বিধান বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/এএসএম