ডা. মোজাহার হোসেন
Advertisement
চারদিকে একটা গা ছমছমে অবস্থা। নগরীর অধিকাংশ মানুষ ঘরবন্দী। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ১৫০/২০০ থেকে কমে নেমে এসেছে ৪০/৫০ জনে। গত বছরের মার্চ, এপ্রিল, মে, জুনের সেই দুঃস্বপ্নের করোনাকালে দিনে তো বটেই, সারা রাতও তিনি কাটিয়েছেন হাসপাতালে। সেবা দিয়েছেন গর্ভবতী, প্রসূতি মায়েদের।
পিপিই, মাস্ক, ফেসসিল্ড, গাউন, ইত্যাকার নানান বেষ্টনিতে নিজেকে আচ্ছাদিত করে নভোচারীর পোষাকে রোগী দেখেছেন, চিকিৎসা দিয়েছেন নানান ধরনের স্ত্রীরোগের, অস্ত্রপচার করেছেন, ব্যথাহীন প্রসব করিয়েছেন, করেছেন সিজারিয়ান অপারেশনও। কর্মভারের ক্লান্তিতে কাহিল হলেও নিজের কষ্টের কথা বুঝতে দেননি কাউকে। কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে।
তার কাজের বিশেষত্ব হলো প্রসূতিদের মাতৃত্বলাভের স্বাভাবিক প্রসব (নরমাল ডেলিভারি)। বিষয়টি যেখানে প্রসূতি মায়েরা এড়িয়ে চলতে চায়, সেক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে তিনি এতটাই গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন যে, এখন প্রতিদিন কমপক্ষে ১০-১২ জনের ব্যথাহীন স্বাভাবিক প্রসব হচ্ছে তার হাতে।
Advertisement
আপনার ভয় ডর বলে কিছু নেই? জীবনের মায়া সবারই আছে, আপনার ক্ষেত্রে কি তাও তুচ্ছ! এই যে অবিরাম ছুটে চলা, এর কি বিরতি নেই? আপনি কি অবিরাম বাংলার মুখ। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি ঢাকা নগরীতে পেশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ৩টি স্থাপনায় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, কোনো দ্বিধা, সঙ্কোচ, শঙ্কা এড়িয়ে।
মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলছিলেন, গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে করোনার ঘোর অন্ধকার সময়ে ঘর থেকে যখন সবাই বের হতে ভয় পায়, তখন এই ভদ্র মহিলা যেভাবে প্রসূতি মায়েদের সেবা দিয়েছেন তা আমি জানি। মন্ত্রী তার একমাত্র ভাগনির চিকিৎসায় হাসপাতালে এসে গত বছরে নভেম্বরে এই মন্তব্য করেন ৫১৭ নম্বর কেবিনে।
আমি তখন সেখানে দাঁড়িয়ে। করোনাকালে এমন সাহসী রোগী-অন্তঃপ্রাণ চিকিৎসকের জন্য আমরা গর্বিত। একথা উল্লেখ করে মন্ত্রী আরও বলেন, কাজে ঝুঁকি আছে জেনেও যিনি পেশাদারিত্বের দায় মাথায় নিয়ে পেশার কাজ অব্যাহত রেখেছেন, তাকে তো আমাদের মনে রাখতেই হবে। মন্ত্রী যেমন তার কথা মনে রেখেছেন, তেমনি তাকে এই নগরী নয়, সারা দেশের মানুষ এখন মনে করছেন।
এবারের করোনার ছোবলেও ক্লান্ত হননি তিনি। গতবারের মতো নিজেকে পুরোপুরি নিরাপদ বেষ্টনিতে পেঁচিয়ে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মুখোমুখি বসে রোগী দেখছেন। কাজ করছেন অপারেশন থিয়েটারে। হরহামেশায় যাচ্ছেন লেবার রুমেও। নরমাল ডেলিভারির জন্য মাঝে মধ্যে রাত কাটান লেবার রুমের এক কোনায় শুয়ে। নিজের হাতেই করেন সব ডেলিভারি। সহযোগী জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে রাখেন। সিজার করার থেকে নরমাল ডেলিভারি অনেক কষ্ট সাধ্য। কষ্ট সাধ্য কেন? উত্তরে তিনি বলেন, প্রসব ব্যথা ওঠার পর থেকে প্রসব হওয়া পর্যন্ত যত সময় লেবাররুমে দিতে হয়, তার চার ভাগের এক ভাগ সময় দিয়ে সিজার সম্পন্ন করা যায়।
Advertisement
খাওয়া, বিশ্রাম এসব তার কাছে কোনো বিষয় নয়। বিষয় একটাই, তিনি কতজন গর্ভবতী নারীর নিরাপদ প্রসব করাতে পারলেন। রাত তিনটা-চারটায় রাউন্ড দিয়ে ভর্তি থাকা রোগী দেখেন। তার কথায়, তিনি সবসময় রাউন্ডের মধ্যেই আছেন। রোগী দেখা, অপারেশন করা, এনভিডি করা, ভি-বিএসি সব কিছুই করে যান একই তালে। এ যেন ছন্দায়িত এক কর্মযজ্ঞ। গভীর রাতে হাসপাতালের করিডোরে রাউন্ডে দেখে তাকে জিজ্ঞাস করে উত্তর পেয়েছি, ‘আমি তো রাতের পাখি’। চলেছি একলা পথে, আমার শ্রম আছে, নেই বিশ্রাম।
গত বছরের মার্চে করোনার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রাণ বাঁচিয়েছেন অনেক গর্ভবতী প্রসূতি মা ও নবজাতকের। একদিনের জন্যেও ক্ষান্ত হননি নিজ কর্মে। এমন শক্তি কোথা থেকে পান? প্রশ্নোত্তরে প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে বলেন, এটা আমার ‘অন্তরাত্মা’ থেকে উৎসারিত শক্তি।
করোনার ঘোর অন্ধকার ঘুচে গিয়ে আলো ফুটলে সেদিন এই সফল ব্যক্তিত্বের মূল্যায়নে আমরাও নিজেদের ধন্য মনে করতে পারব।
তার জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার কটিয়াদি গ্রামে। তিনি অবশ্য কটিয়াদি নয়, ‘কইট্টাদি’ বলতেই স্বাছন্দ্যবোধ করেন। কটিয়াদির এই কৃতি সন্তানের নাম ডা. সংযুক্তা সাহা। তার ঠিকানা সেন্ট্রাল হাসপাতাল, ল্যাবএইড এবং উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল।
ডা. সংযুক্তা সাহা চলতি বছরের এপ্রিল মাসে শুধু সেন্ট্রাল হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের পাশাপাশি ব্যথাহীন নরমাল ডেলিভারি করেছেন ৭৭ জনের, মে মাসে ৯০ জনের। এছাড়া পূর্বে সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে পরবর্তিতে নরমাল ডেলিভারি করেছেন, এপ্রিল মাসে ১৮ জন ও মে মাসে ২০ জনের।
৪০ বছর বয়সের শারমিন সুলতানার সিজার করে প্রথম সন্তান হয় ১৫ বছর আগে। পশ্চিম ধানমন্ডির এই নারীর নরমাল প্রসব করান ডা. সংযুক্তা সাহা গত ২৭ মে বিকাল ৩টায়। ফারজানা আক্তার নামের সাভার আমিন বাজার এলাকার এক নারীর সিজার অপারেশন হয় ৬ বছর আগে। গত ২২ মে এই ফারজানা আক্তারের নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ডা. সংযুক্তার হাতে। লাকী আক্তার নামের আরও একজন নারীর নরমাল প্রসব হয়েছে ১০ মে। মতিঝিল এজিবি কলোনির বাসিন্দা এই প্রসূতিরও সিজার হয়েছিল ৬ বছর আগে।
গাজীপুরের শেখ রওনক শারমিনের সিজার অপারেশন হয় ৫ বছর আগে। গত ৫ মে তার নরমাল প্রসব হয়েছে। ৯ বছর আগে সিজারে বাচ্চা হওয়া ডেমরার সুমাইয়া হোসেনের নরমাল ডেলিভারি হয় গত ১৩ মে। পূর্বে সিজার অপারেশন হয়েছে পরবর্তীতে নরমাল ডেলিভারির বিষয়টি ঝঁকিপূর্ণ জেনেও ডা. সংযুক্তা সাহা তার নিষ্ঠা, শ্রম ও লব্ধ বিশেষ কৌশলে একাগ্রচিত্তে এই ব্যতিক্রমী কাজ করে চলেছেন।
নরমাল ডেলিভারীর পাশাপাশি সিজার অপারেশন করে ডা. সংযুক্তা সাহা অজস্র টুইন প্রেগনেন্সি, দুইটি ট্রিপলেট (তিন নবজাতক), একটি কোয়ার্ট্রিপ্লেট অর্থাৎ চার নবজাতক একসাথে ভূমিষ্ট করিয়েছেন।
দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক সম্পাদক মাইনুল আলমের এক আত্মীয়ের অপারেশনের মাধ্যমে এই চার নবজাতকের প্রসব করান। মা ও চারজনেই সুস্থ। তারা কুমিল্লাতে অবস্থান করছেন। সেদিন কি আনন্দ! মাইনুল আলম হাসপাতালের কয়েকশ ষ্টাফকে মিষ্টিমুখ করিয়েছেন আর বলছিলেন, এমন ডাক্তার আমাদের দেশে থাকতে অন্য দেশ থেকে আমাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়া উচিৎ।
গত ১৫ মে’র ঘটনা। রোগী কামরুননেসা, বয়স ৩৫ বছর। সিজার করে প্রথম সন্তান হয়েছে ৪ বছর আগে। ৯০৯ নম্বর কেবিনে ভর্তি হয়েছেন অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে নরমাল ডেলিভারি করানোর জন্য। ১৭ তারিখ ভোর ৭টায় নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে পুত্র সন্তান প্রসব করেন কামরুননেসা। রোগী সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আপন ভাগনি।
মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর স্নেহে বেড়ে উঠেছেন কামরুননেসা। তার দ্বিতীয় সন্তানের স্বাভাবিক প্রসবে মন্ত্রীর স্ত্রী আনন্দে উল্লসিত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন ডা. সংযুক্তা সাহাকে। হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা হিসেবে আমি তখন ৯০৯ নম্বর কেবিনে সেখানে উপস্থিত। নবজাতক মন্ত্রীর স্ত্রী, ডাক্তার সংযুক্তা সাহা, প্রসূতি ও তার জামাই মিলে অনেকগুলো ছবি তুললেন। আমার দিকে চোখ পড়তেই সংযুক্তা সাহা বললেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খুশিতো!
আমি বললাম, আপনার সফল অভিযানের জন্য অভিবাদন।
লেখক : উপ-পরিচালক, সেন্ট্রাল হসপিটাল, ধানমন্ডি, ঢাকা।
এমএইচআর/এএসএম