ড. মোহা. হাছানাত আলী
Advertisement
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেই মহান জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন। নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেট দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন যে, জাতীয় জীবনে করোনাভাইরাসের ব্যাপক প্রভাবের কারণে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু টাকার অংকে তা একেবারেই নগণ্য।
‘জীবন ও জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে’ অর্থমন্ত্রী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য মোট ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১কোটি টাকার যে বাজেট সংসদে তুলে ধরেছেন তার মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৫.৪ শতাংশ। যা মহামারি করোনার বাস্তবতায় একেবারেই অপ্রতুল। প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। তাছাড়া ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের জন্যও বাজেটে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট বরাদ্দের পরিমাণ ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। গতবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিলো ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। পরবর্তীতে তা বেড়ে ৩১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা দাঁড়ায়। জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য গত বাজেটেও ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছিলো। করোনাকালের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে গত বছরের ন্যায় এবারও থোক ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা মহামারি বিবেচনায় মোটেই যথেষ্ট নয়।
মোট বরাদ্দের বিচারে এবারের স্বাস্থ্য বাজেটে টাকার অংকে বরাদ্দ বেড়েছে ১ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। বিগত অর্থবছরের স্বাস্থ্য বরাদ্দের আকার ছিল মূল বাজেটের ৫ দশমিক ১ শতাংশ, এবার তা বৃদ্ধি করে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের মতে স্বাস্থ্যখাতের বর্তমান কাঠামো অনেক বেশি পুরোনো যা ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। স্বাস্থ্যখাতের মেরামত প্রয়োজন। কোভিড-১৯ এর ডেল্টা ভেরিয়েশনের মধ্যদিয়ে আমরা চলছি। যা দ্রুত অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে। মৃত্যুহারও অনেক বেশি। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে।
Advertisement
জেলা শহরের হাসপাতালগুলো করোনা রুগির চিকিৎসা প্রদানে হিমশিম খাচ্ছে। পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও আইসিইউ এর অভাবে ঝুঁকিতে দেশের চিকিৎসা সেবা। গতবছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হবার পর দীর্ঘ ১৫ মাসেরও অধিককাল সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে কিন্ত আমরা সেই অর্থে দেশের স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজাতে পারিনি। এমন কি গতবছরের বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দকৃত উন্নয়ন বাজেটের ২৪ শতাংশ অব্যবহৃত ছিল। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের মাত্র ২৫.৪৬ শতাংশ অর্থ ব্যবহার করতে পেরেছে। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে থোক বরাদ্দের ১০ হাজার কোটি টাকার বেশিরভাগই অব্যবহৃত থেকে গেছে।
এছাড়া স্বাস্থ্যবিভাগের সমন্বয়হীনতা ও কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তিকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা অনুসারে পর্যায়ক্রমে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হলে এবং জীবন ও জীবিকা সচল রাখতে চাইলে নিরবচ্ছিন্ন টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। অথচ এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে টিকা প্রদান করতে হলে বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন তা অনুপস্থিত। তাছাড়া বিদেশ থেকে টিকা আমদানি করে টিকা কার্যক্রম চালানো ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। পরনির্ভরশীলতা তো রয়েই গেছে। তাই দেশেই টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। কলে- কারখানায় উৎপাদন শতভাগ সচল রাখতে চাইলে, শিক্ষাঙ্গনকে স্বাভাবিক করতে হলে, অর্থনীতির গতিকে বেগবান করতে হলে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে চাইলে মানুষের মনে আস্থা ফেরানোটা জরুরি।
এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম গতিশীল করা। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনের স্বল্পতার কারণে টিকাপ্রদানের গতি অনেকটা স্থবির হয়ে গেছে। সরকার যে চেষ্টা করছে না কিন্তু নয়। তবে আমরা অনেকগুলো সুযোগ হাতছাড়া করেছি। চায়না ও রাশিয়া তাদের উদ্ভাবিত টিকার ট্রায়েল বাংলাদেশে করতে আগ্রহ দেখালেও আমরা তাতে সাড়া দেইনি। যদি সময়মত সাড়া দিতাম তাহলে আজ টিকা প্রাপ্তি সহজ হতো। শুধু একটি উৎস থেকে টিকা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিলো না তা তো আজ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
Advertisement
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের জন্য ২৫ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা ব্যয় হবে বেতনভাতা ও অন্যান্য খাতে। ১৩ হাজার কোটি রাখা হয়েছে উন্নয়ন খাতে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত ৬ হাজার ৮১৭ কোটি টাকার মধ্যে বেতনভাতা ও অন্যান্য খাতে ৪ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। ২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা রাখা হয়েছে উন্নয়ন খাতের জন্য। টিকার জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ না রাখলেও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নতুন অর্থবছরে টিকা কেনার জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৯৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়ার লক্ষ্যে ঋণচুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এবং এআইআইবি থেকে টিকা কেনার জন্য সহায়তা পাওয়া যেতে পারে।
কোভিভ-১৯ আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলো। কিন্তু আমরা তা কাজে লাগাতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছি। করোনাকালে জাতির কাছে দেশের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যবিভাগের চিত্র উম্মোচিত হয়েছে। প্রয়োজন ছিলো এক এক করে সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করা। কিন্তু বাজেটে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। কিন্তু কাজটা শুরু করতে হতো। শুধু কোভিড ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিলে হবে না সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের বহুমাত্রিক দিকগুলো পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধ করা গেলে সামগ্রিক কোভিড ব্যবস্থাপনায় গতি আসবে। যা খুবই জরুরি। এছাড়া বাজেট বাস্তবায়নে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি করাটা খুবই জরুরি।
এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বেশকিছু বিষয়ে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। মহিলাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর প্রযোজ্য সব ধরনের ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে। স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপার উৎপাদনের জন্য কিছু কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা আরো ২ বছরের জন্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। করোনা টেস্ট কিট, পিপিই এবং ভ্যাকসিন আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। এসব উদ্যোগ স্থাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ইতোমধ্যেই আমাদেরকে বেশখানিকটা কাবু করে ফেলেছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলা সমূহে এচিত্র অনেকায় ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
আল্লাহ না করুক করোনার তৃতীয় ঢেউ যদি আসে তবে সেটা হবে আমাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কালবিলম্ব না করে দেশেই টিকা উৎপাদন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদান করে বাজেট অনুমোদন করার সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। জেলা হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সেবা নিশ্চিত করাব উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি জেলা হাসপাতালে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট আইসিইউ ইউনিট চালু করাটা আজ আর বিলাসিতা নয় সময়ের দাবি। এছাড়া স্থাস্থ্য সেক্টরে দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। সময় অনেকটাই চলে গেছে তবে শেষ হয়ে যায়নি। তাই স্বাস্থ্যবিভাগের স্বাস্থ্য ভালো করার কার্যকরী পদক্ষেপ এখনই শুরু করতে হবে।
লেখক : প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। drhasnat77@gmail.com
এইচআর/জেআইএম