কয়েক বছর আগে দুবাই যাওয়ার পথে বিমানে আমার পাশের সিটে যে নারী বসেছিলেন, তিনি একজন অভিবাসী শ্রমিক। ওনার নাম পেয়ারা বেগম। উনি গন্তব্য ঠিকমতো জানেন না এবং প্লেনে চড়ার পর থেকে শুধু কেঁদেই চলেছেন। দেখে এত মায়া হলো যে কথা শুরু করলাম। কথা বলে বুঝলাম উনি কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন এটা তার কাছে স্পষ্ট নয়। বাড়িতে মায়ের কাছে দুই শিশুসন্তানকে রেখে এসেছেন বলে মন খুব খারাপ।
Advertisement
টিকিট দেখে বুঝলাম উনি দুবাই যাবেন, এরপর রিয়াদ। ভদ্রমহিলা রোজা রেখেছেন এবং ইফতারির জন্য যে রুটি আর কলা নিয়েছেন, সেটাও লাগেজে দিয়ে দিয়েছেন। সাথে আছে বাংলাদেশী ৫০০ টাকা। আমি প্লেনে দেয়া খাবারটা ওনাকে দিয়ে বলেছিলাম, রেখে দেন, এটা দিয়ে পরে ইফতারি করবেন। লাগেজের রুটি কলা আপনি পাবেন না।
দুবাইতে নেমে অন্য বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকরা, বিশেষ করে আপনার সাথে আসা আরও তিন নারী যেদিকে যাবেন, আপনিও সেদিকে যাবেন। পারলে ওদের সাথে কথা বলবেন। জানি না দুবাইয়ের ওই বিশাল বিমানবন্দরে নামার পর পেয়ারা বেগম কীভাবে রিয়াদে পৌঁছেছিলেন। যদি পৌঁছেই থাকেন, তাহলে এরকম মানসিক স্ট্যাটাস ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে উনি কতটা নিরাপদে সেখানে কাজ করতে পেরেছিলেন। দুবাইতে ওনাকে কেউ এসে নিয়ে যাবে, এরকম একটা আশ্বাসেই তাদের চারজনকে এই প্লেনে তুলে দেয়া হয়েছিল।
গত সপ্তাহে যখন খবরে দেখলাম সৌদি আরব থেকে আসা একজন নারী অভিবাসী শ্রমিক বিমানবন্দরে নেমে কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, আমি কোথায় যাব এখন এই ফুটফুটে বাচ্চাটাকে নিয়ে? যখন দেখলাম সৌদি আরব থেকে ফেরা আরেক নারী নিজের আট মাসের শিশুসন্তানকে বিমানবন্দরে ফেলেই চলে গেছেন, এর আগে চার মাসের মেয়ে সন্তান নিয়ে ওমান থেকে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন আরেক নারী গৃহকর্মী এবং মার্চে সৌদি আরব থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সন্তান কোলে নিয়ে দেশে ফিরেছেন অন্য আরেক তরুণী- তখন কেন যেন আমার বারবার মনে হতে থাকে সেই পেয়ারা বেগমের কথা।
Advertisement
এরাও নিশ্চয়ই কোনো কিছু না জেনে, কোনো অসাধু এজেন্সির খপ্পরে পড়ে, চোখে স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। এই নারী অভিবাসী শ্রমিকদের অনেকেই গৃহকর্তা বা বাসার অন্য সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ছেন এবং সহায় সম্বল সব হারিয়ে সন্তান কোলে নিয়ে দেশে ফিরে আসছেন।
কিন্তু কেন এমনটা হবে? কেন এসব নারী কর্মীকে নিপীড়িত-নির্যাাতিত হয়ে, মানসম্মান, টাকা-পয়সা সব হারিয়ে সন্তান কোলে নিয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে? এসব সহায় সম্বলহীন, নিরক্ষর বা কম পড়াশোনা জানা মেয়েরা যখন রেমিট্যান্সযোদ্ধা হিসেবে বিদেশে যান তখন তাদের বাংলাদেশ দূতাবাসের আওতাধীন বা মনিটরিংয়ে থাকার কথা। বাংলাদেশের দূতাবাসের উচিত ছিল নারী অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগকর্তার নাম-পরিচয় খুঁজে বের করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং নির্যাতিত নারীদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করা।
কিন্তু দেখা যায় যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লেবার এটাচি মামলা করার উদ্যোগ নেয় না , মামলা হলেও অভিবাসী নারীকর্মী দেশে চলে আসায় মামলাটি চলমান থাকে না। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের উচিত বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটর করা, যাতে লেবার এটাচি মামলা করে নির্যাতনের শিকার নারীর জন্য ন্যায়বিচার করাতে পারেন এবং নিয়োগকর্তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করেন।
অভিবাসী আইনের ১১.৫ ধারায় সনদে স্বাক্ষরকারী সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে নারী কর্মীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে। বাংলাদেশ এ ধারায় স্বাক্ষরকারী একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশী অনেক অভিবাসী নারীকর্মী বিদেশে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
Advertisement
এখন প্রশ্ন আসতে পারে বাংলাদেশী দূতাবাস যে ব্যবস্থা নেবে, আদতে তারা কতটা জানে এ অসহায় নির্যাতিত মেয়েদের কথা। বেশ কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, অভিবাসী নারী শ্রমিকদের ৬৫ শতাংশেরও বেশি নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের একটি বড় অংশ কখনো দূতাবাসে যান না।
যদিও সে সময় জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো এ অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। তারা মনে করেন ফিরে আসা কর্মীদের অধিকাংশই আবারও বিদেশে কাজ করতে যেতে চান। এত নারী নির্যাতনের শিকার হলে, তারা আবারও বিদেশে কাজের জন্য যেতে চাইতেন না। ব্যুরোর পক্ষ থেকে তখন আশা প্রকাশ করা হয়েছিল যে নির্যাতনের এ হার ক্রমে কমে আসবে। কিন্তু ব্র্যাকের একটি হিসাব অনুযায়ী খুব সম্প্রতি এ ধরনের ১২টি ঘটনা ঘটেছে এবং গত পাঁচ বছরে অন্তত ১০ হাজার নারী নিপীড়িত হয়ে এবং আশা ভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে।
এমনকি আমরা তো এও দেখেছি নির্যাতিত নারী শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে এসেছেন। শ্রমিকরা শারীরিক নির্যাতনসহ নানা অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন বলেই বারবার শ্রমিকদের সুরক্ষায় কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। অন্যান্য দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। উৎসব আয়োজনে তারা নিজ দেশের লোকজনকে আমন্ত্রণ জানান। বাংলাদেশ দূতাবাসও চাইলে শ্রমিকদের সাথে বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের সাথে এ আস্থার সম্পর্কটা তৈরি করতে পারে।
সৌদিতে উপর্যুপরি নারী নিগ্রহের ঘটনার পর বিভিন্ন ফোরাম থেকে প্রশ্ন উঠেছে কেন আমরা এরপরও সেই সব দেশে নারী শ্রমিক পাঠাচ্ছি, যেসব দেশে নারী সুরক্ষার কোনো আইন নেই? ঘরের ভেতর এই গৃহকর্মীদের অনেকেই নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তারা এতোটাই বিপর্যস্ত ও অনভিজ্ঞ যে কারও কাছে সাহায্যও চাইতে পারেন না। এছাড়া ভাষাগত জটিলতা তো আছেই। এদের নির্যাতনের কাহিনিগুলো সব এক। ঘরে মালিকের দ্বারা যৌন হয়রানি বা মালিক পত্নীর রোষানলের শিকার হয়ে স্থান পান জেলখানায় বা শেল্টার হোমে। সেখানে সন্তান জন্ম দেন এবং এরপর প্লেনে চাপিয়ে সহায় সম্বলহীনভাবে এনাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এখনো অভিবাসী নারী শ্রমিকদের একটা অংশ প্রশিক্ষণ ছাড়া বিদেশে যাচ্ছেন। এনাদের প্রায় অনেকেই যাওয়ার জন্য টাকা ধার করেন এবং অনেকেই সেই ধার শোধ করতে পারেন না। অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তৎপর। তারা দালাল নিয়োগ করে একং সেই দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রচুর টাকা খুইয়ে বিদেশে যাচ্ছেন নারী শ্রমিকরা। পরে খালি হাতে ফিরে এসে সেই টাকা শোধ করা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
দেশের অর্থনীতিতে নারী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স এর কথা চিন্তা করে সরকারের উচিত তাদের জীবন, জীবিকা, সম্মান আর নিরাপত্তার দিকটি অগ্রাধিকার দেয়া। একজন নারী শ্রমিক যখন অভিবাসী হিসেবে বিদেশে যান, তখন তার যাওয়ার খরচ শুধু টাকার অঙ্কে হিসাব করলেই চলবে না। এর একটা সামাজিক ব্যয়ও আছে। এরা জীবনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে, সামাজিক ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে, নিজের সম্মানকে হাতে নিয়ে, পরিবার-পরিজন ছেড়ে এবং অনেক টাকা বিনিয়োগ করে বিদেশের মাটিতে পা রাখেন। চোখে স্বপ্ন একটাই পরিবার-পরিজন যেন ভালো থাকে। দেশ যেন কিছু টাকা পায়।
আমরা বারবার বলছি সৌদিদে নারী শ্রমিক পাঠানোর সময় সরকার যেন নিরাপত্তার দিকটি অগ্রাধিকার দেয়। শুধু রেমিট্যান্সের কথা ভেবে নারী গৃহশ্রমিকদের সেখানে পাঠানো উচিত হবে না। সেই সাথে এমন ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন নারী শ্রমিকরা সপ্তাহে একদিন ছুটি পান এবং ওইসব দেশের নাগরিকদের মতো স্বাস্থ্য বীমার সুযোগও ভোগ করতে পারেন। এই দিকটা উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকার সে দেশের সরকারের সাথে চুক্তি করতে পারেন। দূতাবাসের আইনি সহায়তা কেন্দ্রে অভিবাসী শ্রমিকরা বিশেষ করে নারী গৃহকর্মীরা সহজে যেতে পারছেন কি না এবং কীভাবে এ সেলগুলো আরও বেশি কার্যকর করা যায়, সেসব নিয়েও ভাবা দরকার।
নারী অভিবাসন চলতে পারে সিঙ্গাপুর, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও হংকংকের মতো আরও কয়েকটি দেশে। এসব দেশের সাথে কাজের নতুন রুট চালু করতে হবে। সরকার উদ্যোগ নিলে অনেক নারী টেকনিক্যাল ও পেশাভিত্তিক কাজে যেতে পারবেন। অভিবাসনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ফলে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ সুগম হয়েছে সত্যি, কিন্তু অন্যদিকে নারীর মানবাধিকার এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির দিকটিও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। ১২ জুন, ২০২১
লেখক : সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
এইচআর/এমকেএইচ