এমনিতেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অনেক শরিক প্রেস বিজ্ঞপ্তি-বিবৃতি সর্বস্ব, তাদের নিজস্ব কর্মসূচি থাকে না বললেই চলে। তারওপর দীর্ঘদিন ধরে নেই জোটের কোনো কর্মসূচি। সেজন্য জোটের শরিকদের অধিকাংশেরই নেই কোনো কর্মকাণ্ড। ফলে দীর্ঘদিনের এ জোট কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। বিএনপির নেতৃত্ব এ নিয়ে সরাসরি কিছু না বললেও শরিক দলের নেতারা এক্ষেত্রে করোনা পরিস্থিতিকে দায় দিচ্ছেন।
Advertisement
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, বেশ কয়েকটি কারণে ২০ দলীয় জোটের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে ২০ দলকে সাইডলাইনে রেখে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে আরেকটি জোট গঠন এবং ওই প্লাটফর্মকে প্রাধান্য দেয়া। মূলত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে ২০ দলের সঙ্গে বিএনপির বাঁধন নড়বড়ে হতে শুরু করে। যা প্রকাশ্যে আসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জোটের আসন বণ্টন নিয়ে। তখন বিএনপি এই সমস্যা কৌশলে সামাল দিলেও নির্বাচনে ভরাডুবির পর দূরত্ব আরও বাড়তে থাকে। শরিক দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) জোটত্যাগের মধ্য দিয়ে এই প্লাটফর্মের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট প্রকাশ্যে রূপ নেয়।
২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপি যেমন জাতীয় রাজনীতিতে সমস্যায় রয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও তারা গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং নানা সহিংসতা-নাশকতায় অভিযুক্ত জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়ে বহির্শক্তির চাপ অনেক আগে থেকেই হজম করছে বিএনপি। এক্ষেত্রে দলের ভেতরের নানা চাপও সামলাতে হচ্ছে হাইকমান্ডকে। তারপরও ভোটের স্বার্থে জোটে নেয়া দলটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বিএনপি।
অবশ্য অনেক শীর্ষ নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে যাওয়ার পর জামায়াতই তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। নিবন্ধন বাতিলের পর তারা সরাসরি নির্বাচনী কার্যক্রমেও অংশ নিতে পারছে না। নানান সময়ে গোপন বৈঠক থেকে তাদের নেতাকর্মীদের আটক করার খবর মিলছে।
Advertisement
২০ দলীয় জোটকে পাশে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের অভিমানে কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ সমমনা কয়েকটি দলকে নিয়ে জাতীয় মুক্তিমঞ্চ গঠন করেন। এতে যোগ দেয় মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিও। ওই মঞ্চ গড়ে ওঠার পর ভাঙন ধরে অলির এলডিপিতে। শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে নতুন এলডিপি গঠিত হয়। অন্যদিকে কল্যাণ পার্টি না ভাঙলেও অনেকেই দলত্যাগ করেন।
অ্যাডভোকেট মাওলানা আবদুর রকিবের নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের কার্যত কোনো অস্তিত্ব আছে বলে ২০ দলের কেউ মনে করেন না। দলের চেয়ারম্যান সিলেটে থাকেন। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসেন, পাওয়া যায় দুই-একটি বিবৃতি।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল বর্জন এবং পরে সংসদে বিএনপির নির্বাচিত সদস্যদের (এমপি) শপথ গ্রহণ নিয়ে মতবিরোধে জোটের সকল কর্মসূচি ও সভা থেকে বিরত থাকছে মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে তাদের অনেক নেতাকে সক্রিয় দেখা যায়। ওই আন্দোলনে যে নাশকতা হয়েছে, সেসব ঘটনার মামলায় দলটির মহাসচিব ড. আহমেদ আবদুল কাদের কারাগারে রয়েছেন।
জোটের আরেক শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামও দুই ভাগে বিভক্ত। দুই ভাগের শীর্ষ নেতৃত্ব মাওলানা নূর হোসেন কাশেমী ও মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। ফলে দুই অংশই এখন নিজেদের দল গোছানো নিয়ে ব্যস্ত।
Advertisement
বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল সভাপতি এ.এইচএম কামরুজ্জামান খান মারা যাওয়ার পর এই দলও এখন প্রায় অস্তিত্বহীন। অবশ্য গত এক দশকেই দলটির উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মকাণ্ড কারও চোখে পড়েনি।
সাইফুদ্দিন আহমেদ মনির ডেমোক্রেটিক লীগ-ডিএলের ব্যাপারে কথিত আছে, এই দল চলে এক নেতার নেতৃত্বে। তার দলও অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে। রাজনৈতিক ময়দানে ডিএলকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রয়াত শফিউল আলম প্রধানের জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপাও এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে প্রধানের কন্যা ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান অন্যদিকে খন্দকার লুৎফর রহমান নেতৃত্ব দিচ্ছেন। উল্লেখযোগ্য কর্মসূচির দেখা মেলে না বললেই চলে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর মাঠে দেখা মেলেনি ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি-এনপিপি, অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামের ন্যাপ ভাসানী, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস্ লীগ, মাইনোরিটি জনতা পার্টি, মূল দল ভেঙে গড়ে ওঠা এনডিপি বা বাংলাদেশ ন্যাপকেও। প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদের জাতীয় পার্টির অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাঈদ আহমেদ দেশেই নেই। তার দলের অস্তিত্বও আছে বলে কেউ মনে করে না। রিটা রহমানের নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশও বিএনপিতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেকে মনে করেন।
ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ লেবার পার্টি যৎসামান্য কর্মসূচিতে রাজনীতিতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সরকারবিরোধী নানা কর্মসূচিতে তাদের মাঝেমধ্যে দেখা যায়।
অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় দলও নিজেদের মত করে কর্মসূচি পালন করছে। জোটের প্রধান দল বিএনপির নেতাদের নিয়ে নানান আলোচনা-সভা আয়োজন করতে দেখা যায় তাদের।
জোটের বর্তমান স্থবিরতা ও অস্তিত্ব সংকট নিয়ে শরিকদের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। চরম অনিশ্চয়তা ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
২০ দলীয় জোটের অধিকাংশ শরিক দলের নিষ্ক্রিয়তা প্রসঙ্গে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) একাংশের মহাসচিব শাহাদাৎ হোসেন সেলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনাকালে অনেকেই বাসায় অবস্থান করছেন, কেউ শারীরিকভাবে অসুস্থ কেউ ঢাকার বাইরে রয়েছেন, যে কারণে তাদের কর্মসূচিতে দেখা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘যাদের সাংগঠনিক কাঠামো নেই তারা কিছুই করতে পারছে না। আর আমাদের যাদের সাংগঠনিক সামর্থ্য রয়েছে তারা এই করোনাকালে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করছি। অতীতেও যাদের সাংগঠনিক কাঠামো এবং শক্তি ছিল না, তারা নিষ্ক্রিয় ছিল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা সরকার পতনের আন্দোলনে যাবো।’
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘জোটের অধিকাংশ নেতাই রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়, কথাটি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। করোনা মহামারির মধ্যে আমরা জোটের কয়েকজন নেতাকে হারিয়েছি। এছাড়া অনেকেই আছেন যারা এই সময়ে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করাটাকে সমীচীন মনে করছেন না। কিছু কিছু রাজনৈতিক দল তাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় আছে। এছাড়া কিছু দল জোটের বাইরে কোনো কর্মসূচি ছাড়া সক্রিয় ছিল না এবং বরাবরের মতো তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে।’
কী ভাবছে বিএনপিএদিকে বিএনপি সূত্র বলছে, শরিকদের দু-একটি ছাড়া নামসর্বস্ব দল নিয়ে জোটের বোঝা আর বহন করতে চায় না বিএনপির হাইকমান্ডও। এসব দল রাজপথের আন্দোলনেও কখনো বড় কোনো শক্তি দেখাতে পারেনি। ভোটের মাঠেও তেমন অবদান রাখতে পারেনি। উল্টো শরিকদের এই ভাঙন ও জোট ছাড়ার দায় কোনো না কোনোভাবে বিএনপিকে নিতে হয়েছে।
তবে জামায়াত ইস্যুতে বরাবরের মতোই বিএনপি এখনো কৌশলে অগ্রসর হতে চাচ্ছে। যদিও এই কৌশল তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়াচ্ছে বলেই মনে করেন অনেকে।
এ নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কেউ সরাসরি কথা বলতে চাননি। তবে জোটের কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়, জোট রাজনীতি থেকে বিএনপি সরে যাচ্ছে কি-না, জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সবাই যুগপৎ, যার যার জায়গা থেকে কাজ করছি। জোটের কিছু না, সবাই একই পথে চলছি। পথ একটাই। ওদিকে সবাই চলতে থাকবে; কেউ আগে, কেউ পিছে, কেউ ডানে, কেউ বামে চলতে চলতে যে প্রয়োজন হবে তখন দেখা যাবে।’
কেএইচ/এইচএ/জেআইএম