মতামত

ট্রিপস, টিকা মজুতদারি এবং মানবাধিকার

পুরো বিশ্ব করোনা সংকট কাটাতে এখন তাকিয়ে আছে উন্নত দেশগুলোর দিকে। কারণ উৎপাদিত টিকা তারা সংগ্রহ করে মজুত করে রেখেছে তাদের জনসংখ্যার চেয়েও। একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হয়ে যাবে বিষয়টা। সম্প্রতি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় দেশে টিকার সংকট কাটিয়ে উঠতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন যে অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ২৫ মিলিয়ন। অর্থাৎ আড়াই কোটি। অথচ তারা টিকা সংগ্রহ করেছে ৯৩.৮ মিলিয়ন। মানে প্রায় সাড়ে নয় কোটি। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা একই কাজ করেছে। মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি করে টিকা মজুদ করে রেখেছে। আর আমরা সেখানে টিকা পাচ্ছি না!

Advertisement

প্রশ্ন হচ্ছে উন্নত দেশগুলো বৈশ্বিক মহামারির এমন সময়েও মজুতদারির কাজটা কেন ও কিভাবে করছে? তারা তো নিজেদেরকে বিশ্ব মোড়ল হিসেবে হাজির করে। দেশে দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসনের ছবক দিয়ে বেড়ায়। কিন্তু বিশ্ব মানবাধিকারের প্রতি তাদের ন্যূনতম দায়িত্ববোধটুকুও আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি না। মুনাফাবাদী ও মজুতদারী মানসিকতা নিয়ে তারা নিজেদের দেশের মানুষকেই শুধু বাঁচাতে সক্রিয় হয়েছে। হাবভাব দেখে মনে হয় আমরা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ তাদের কাছে মানুষই নই।

রয়টার্স পরিবেশিত ভ্যাকসিনেশনের তথ্য বলছে, যারা ভ্যাকসিন পাওয়ার যোগ্য এমন মানুষের প্রায় ৫২% কে উন্নত দেশগুলো প্রথম ডোজের টিকাদান সম্পন্ন করেছে। আর ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় তা ৪৮%। অন্যদিকে টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো।তারপরেই এশিয়ার দেশসমূহ। অথচ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭৬ শতাংশ মানুষ বাস করে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে। এককভাবে শুধু এশিয়াতেই বাস করে ৬০ ভাগের কিছুটা বেশি।আর পুরো ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা মিলে বাস করে মাত্র ১৭ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ। অথচ টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে তারাই এগিয়ে আছে। রয়টার্স বলছে, এশিয়ার মাত্র ৯ টি দেশ এবং আফ্রিকার মাত্র ৩ টি দেশ এ অবধি ২০ শতাংশের বেশি লোককে অন্ততপক্ষে ১ ডোজ টিকা দিতে পেরেছে।এ হিসেবের ভেতরে অবশ্য চিন অন্তর্ভুক্ত নয়। সম্ভবত চিন থেকে তথ্য প্রাপ্তির অপ্রতুলতাহেতু রয়টার্স তাদের হিসেবে চিনকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে নি। রাশিয়া এবং জাপানে এ অবধি ১২% লোক প্রথম ডোজের টিকা পেয়েছেন।

আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ভুটান ও মালদ্বীপ। তারা প্রায় ৬০% এর অধিক মানুষকে ১ম ডোজের টিকা দিতে পেরেছে।এ হার নেপালে ৭%, শ্রীলংকায় ৯% এবং ভারতে ১৩%। বাংলাদেশ, পাকিস্তান সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। তারা মাত্র ৩% লোককে ১ম ডোজের টিকা দিতে পেরেছে। এদিকে সামনে টিকা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা দেখে মনে হচ্ছে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলো টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে আরো পিছিয়ে পড়বে। ধনীদেশগুলোর মজুতদারি মানসিকতা ও অন্যদেশগুলোর প্রতি তাদের উদাসীনতাই মূলত এর জন্য দায়ী।

Advertisement

শুধু এসব পরিসংখ্যান বললেও পুরোটা বলা হবে না। কারণ কি জানেন? কারণ হচ্ছে-উন্নয়নশীল দেশগুলো যারা নিজেরা টিকা উৎপাদনে সক্ষম তাদেরকেও টিকা তৈরির প্রযুক্তি তারা দিতে ইচ্ছুক নয়। এ বছরের মার্চ মাসে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্বে প্রায় ১০০ টি দেশ টিকা তৈরির এ প্রযুক্তি উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার কাছে বাণিজ্য সংক্রান্ত মেধাস্বত্ব চুক্তি সংক্ষেপে যাকে বলা হয় ট্রিপস (Trade-Related Aspects of Intellectual Property (TRIPS) তা সেটা তুলে নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলো।আইনগত এ বাঁধা উঠিয়ে নিলে আমাদের মতো বেশি কিছু দেশ তাহলে উৎপাদনে যেতে পারতো। তাতে করে বৈশ্বিক এ মহামারির সময়ে টিকা নিয়ে ধনী দেশগুলো এবং তাদের সাথে যুক্ত এক একটা কোম্পানির যে একচেটিয়া বেনিয়া ব্যবসা তা বন্ধ হয়ে যেতো। কিন্তু তারা তা করতে রাজি নয়। তার মানে হচ্ছে-নিজের দেশের মানুষকে নিরাপদ করতে পারলেই তাদের দায়িত্ব শেষ। এরপরে তারা বেনিয়া হয়ে ব্যবসা করতে নেমে পড়বে।

অথচ খেয়াল করলে দেখবেন, অক্সফোর্ড যখন তাদের করোনা টিকা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলো তখন তারা বলেছিলো যে টিকা উৎপাদনে সফল হলে তারা তখন এ প্রযুক্তি বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করে দিবে। অথচ তারা এখন সেটা ভুলে গেছে। কারণ অ্যাস্ট্রাজেনেকার তাহলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। একইভাবে ফাইজার, মডার্ণা, জনসন, চিনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক এবং রাশিয়ার স্পুটনিক কেউই তাদের মেধাসত্ত্ব তুলে নিয়ে তা পুরো বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করেনি।

আবার তাদের নিজেদেরও বিক্রির উদ্দেশ্যে উৎপাদন করে বিশ্বের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতাও নেই। তার মানে হচ্ছে-তারা নিজেরা তৈরি করে চাহিদাও মেটাতে পারবে না। আবার অন্য দেশের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলে তাদের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর করে উৎপাদনের সুযোগ করে দিবে না। তাতে কোন দেশে মানুষ বাঁচলো আর মরলো তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। এই হচ্ছে নিদারুণ বাস্তবতা।

বর্তমানে তাই করোনা টিকা উৎপাদনের প্রধান যে আইনগত বাঁধা সেই ট্রিপস (TRIPS) চুক্তি তুলে নিয়ে টিকা উৎপাদনে সক্ষম এমন অন্য দেশসমূহের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তরই হতে পারে বৈশ্বিক এ মহামারি নিয়ন্ত্রণের একমাত্র সমাধান। সে লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশসমূহকে একযোগে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এই চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বব্যাপী ব্যক্তি ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। কারণ তাদের এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর সময় নয়। বরং বিশ্ব মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।

Advertisement

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলোজ, সাভার।

এইচআর/জিকেএস