সমাজের কোনো একটি বিশেষ দুর্ঘটনা কখনো কখনো কোনো কোনো মানুষের মনের খুব গহীনে স্থায়ীভাবে গভীর ক্ষত তৈরি করে দিয়ে চলে যায়, যা ইচ্ছে করলেই মুছে ফেলা যায় না। আর সে দুর্বৃত্তের লালসার সেই বিষের ছোবল তছনছ করে দিয়ে যায় সভ্য মানুষের সমাজ, সভ্যতা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ আর বিবেক। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো স্ফুলিঙ্গ থেকে লাভা বের হয়ে পুড়ে যায় একটি দেশের মানবতা আর মূল্যবোধ। কালবৈশাখির তাণ্ডবে যেন দুমরে মুচড়ে যায় একটি পরিবারের স্বজনেরা। সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, গুণীজন আর মানবাধিকার কর্মীরা আন্দোলনে আস্ফালন করে একদিন থেমেও যান অবশেষে। অপেক্ষার প্রহর গুণে গুণে কালো কেশ ধূসর হয়ে একদিন ন্যায় বিচারও হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু ঘরে ফেরে না শাজনীন, ইয়াসমিন, তানিয়া, সীমা, রুমি, রাজন, রাকিব- জানা অজানা আরও অনেকে। অজানারা পরে থাকে শুধু অন্ধকার কালো গহীন মৃত্যু উপত্যকায়। এক একটি পরিবারের ক্ষত মুছতে না মুছতেই আবার ভিন্ন আঙ্গিকে নতুন রুপে চূর্ণ করে দিয়ে যায় ভিন্ন অন্য একটি সাজানো বাগান। আর বিবেক আর ভালোবাসা হত্যা করে ভেতরের পশু গুলো যেন বিজয়ীর বেশে সন্ত্রাস করে যায় যুগ যুগান্তর। আর তা দ্বারা যখন একটি দেশের নারী ও শিশুরা নিষ্ঠুরভাবে ও পাশবিকভাবে আক্রমণের শিকার হতে থাকে তখন সেই সমাজের মানুষেরা খুব সহজেই আয়নায় তার স্বরূপটি জেনে নেয়। আর তখন সে ঘটনা সমাজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে তার অবস্থান বলে দিয়ে যায় ,যে সে কোন পথে হাঁটছে ।মানুষের জীবনে আর পাঁচটি প্রবৃত্তির মতোই শারীরিক চাহিদারও একটি স্বাভাবিক ভূমিকা রয়েছে, যা বয়ঃসন্ধিকাল থেকে মানুষ মুখোমুখি হয়। আর এ বিষয়টি আলোচনায় আনা বা সে বিষয়টি পাঠের অন্তর্ভুক্ত হওয়াকে এখনো অনেক রক্ষণশীল সমাজ আড়চোখে দেখে তা ঢেকে রাখাটিই যথার্থ মনে করে। শুধু তাই নয়, বিষয়টিকে গোপনীয়, শিষ্টাচার বহির্ভূত এবং রুচিবিরুদ্ধ মনে করা হয় এবং অতি সন্তর্পণে স্পর্শকাতর ও লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে এড়িয়ে চলা হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে যে স্পর্শকাতর বিষয়টিতে প্রথম মানুষ মুখোমুখি হয়, তখন শারীরিক শিক্ষা ও তার যথার্থ ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো বুঝে ওঠার আগেই তারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে যায়। শিকার হয় এক একটি শিশু, কিশোরী এমন কি বালকও। ভাবতে অবাক লাগে, রক্ষণশীল সমাজে যে বিষয়টি লজ্জা, অশ্লীল এবং গোপনীয় মনে করা হয়, সেই বিষয়টির অজ্ঞতার কারণে ও সচেতনতার অভাবে নারী শিশু আর বালকের উপর ঘটে যেতে পারে ধর্ষণ, গণধর্ষণ অথবা হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ। শিশু জানে না তার শরীরে কী ঘটছে, তা জানার আগেই মাদ্রাসার কতিপয় হুজুরের কাছে , দাদা কাকা আর ফুপাদের কাছে ধর্ষিত হয়ে লোকলজ্জা আর প্রাণের ভয়ে নিশ্চুপ আর নির্বাক হয়ে যায় সারাজীবনের জন্য। এমনকি কোনো কোনো শিশু মৃত্যু বরণও করে। আর এই অঘটন ঘটন পটিয়সীরা হল এক একজন দুর্বৃত্ত পরায়ণ পশুপ্রবণ পুরুষ, আর তারই কৃতকর্মে সৃষ্ট কলঙ্ক মাথায় নিয়ে আজীবন বহন করে এক একজন কলুর বলদ নারী। আসলে পুরুষের দ্বারা ঘটিত এই ঘটনার দায় ‘কলংক’ শব্দটিকে নারীর ঘাড়ে চাপানো পুরুষের এক বিরাট পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কূটকৌশল আর মারণাস্ত্র। যেন নারী তাদের কলঙ্কের দায় মাথায় নিয়ে একেবারে নির্বাক আর নিশ্চুপ হয়ে আর বিচার না চায়। ভারতের অনেক রাজ্যেই ভিক্টিম নারী বিচার চাইলে মীমাংসার জন্য চাপ আসে। অনেক সময় সমাজের চাপে, পরিবারের চাপে ধর্ষকের গলায় মালাও দিতে হয়। আবার কেউ কেউ ধর্ষকের সন্তান পরম যত্নে লালন করে মানুষ করে গড়ে তোলে এমন ঘটনাও ঘটেছে প্রতিবেশি দেশ ভারতে। হায়! কি নিষ্ঠুর পরিণাম ছুঁড়ে দেয় নিস্পাপ নারীর জীবনে মানুষ নামের অমানুষ এই পুরুষের পাল! আমরা গণমাধ্যমে চেয়ে চেয়ে দেখি পরিমলেরা হেঁটে যায় মাথা উঁচু করে। মুখের কোণায় নিষিদ্ধ অপ্রতিরোধ্য গোপন স্মিত গৌরবের হাসি নিয়ে। যার শারীরিক ভাষা আর অভিব্যক্তির মধ্যে ছিলোনা কোনো লজ্জা, ভয় অথবা শঙ্কা আর অপরাধবোধ। হাত দু’টি বাঁধা না থাকলে হয়তো কাদের মোল্লার পরিবারের মতো ‘ভি’ সংকেতও দেখাতে পারতো, আর ঠিক তেমনটিই মনে হচ্ছিলো তার শারীরিক অভিব্যক্তিতে যা দেখে আরও মনে হচ্ছিলো ধর্ষক পরিমল যেন বলতে চায় ধর্ষক সে নিজে হলেও এর দায় লজ্জা আর কলঙ্ক যেন সকল নারীর। আর এসকল পরিমলের রক্ষক কিছু নারীরাও এই কলঙ্ক মাথায় নিয়ে সগর্বে পরিতৃপ্ত মনে রক্ষা করে যায় পরিমলদের । লেখক : আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স এর প্রশিক্ষকএইচআর/এমএস
Advertisement