দেশজুড়ে

রাজশাহীতে চলছে লকডাউন, আম বাজারে কমছে ক্রেতা

বর্তমানে রাজশাহীতে আমের ভরা মৌসুম। এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে গোপালভোগ, হিমসাগর (খিরসাপাত), ল্যাংড়া ও গুটিজাতের আম। তবে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে শুক্রবার (১১ জুন) বিকেল ৫টা থেকে সাত দিনের লকডাউন ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন।

Advertisement

এছাড়া জেলায় থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে ক্রেতা সঙ্কটে ভুগছেন রাজশাহীর আম ব্যবসায়ীরা। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।

চলমান লকডাউনে রাজশাহীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আমারে বাজারগুলোতে শুধু ক্রেতা সঙ্কটই নয়, কমেছে আমের মূল্যও। প্রতি মণে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কমেছে। উত্তরের দ্বিতীয় বৃহৎ আমের হাট বানেশ্বর, রাজশাহীর সাহেব বাজার, শালবাগান, রাজশাহী বাসস্ট্যান্ড আমের বাজারেও এমন অবস্থা চলছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বিক্রেতারা ভাষ্য- হাটে প্রচুর আম আমদানি হচ্ছে। সেই তুলনায় ক্রেতা কম। তাই আম বিক্রি করতে হচ্ছে অল্প দামে। এতে চাষি ও বাগান ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

Advertisement

পুঠিয়া ঝলমলিয়ার আম বাগান ব্যবসায়ী মিনহাজ সাকিল। গাছের পাতা ও মুকুল দেখে কিনেছিলেন ১০ বিঘা আমের বাগান। আমের ফলনও হয়েছে ভালো। তবে ক্রেতা সঙ্কটে পাচ্ছেন না আমের দাম।

সাকিল বলেন, ‘লকডাউন ঘোষণার আগে টুকটাক ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু লকডাউন ঘোষণায় বানেশ্বর হাটে একেবারেই ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে। গত তিনদিন আগে ল্যাংড়া আম বিক্রি হয়েছে ১৪০০ থেকে ১৭০০ টাকা মণ দরে। এছাড়া খিরসাপাত ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা মণ ও গোপালভোগ ১৫০০ থেকে ২২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। বর্তমান তা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কম দামে। কারণ, এখন আমের ভরা মৌসুম। তাই হাটে এখন প্রচুর আম আমদানি হচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় ক্রেতা তেমন নেই।’

এদিকে, বানেশ্বরে ক্রেতা সঙ্কট থাকলেও রাজশাহীর অন্যসব আমের বাজারগুলো তুলনামূলক বেচাকেনা ভালো ছিল। কিন্তু লকডাউনের কারণে নগরীর আম বাজারগুলোতে বিক্রি নেই বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

আমের দাম কমার বিষয়ে মো. রহমত আলী নামের বিক্রেতা বলেন, ‘আগে ৩০ থেকে ৫০ মণ আম আমরা নিয়ে আসতাম। বর্তমানে ১০ থেকে ২০ মণ আম বিক্রির জন্য হাটে নিয়ে আসা হয়। কারণ, ক্রেতা কম থাকায় সব আম বিক্রি সম্ভব হয় না। তখন আবার মণ প্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা লসে বিক্রি করতে হয়।’

Advertisement

রাজশাহীর অন্যতম আমের বাজার নগরীর শিরোইল বাসস্ট্যান্ডে। প্রতিবছরই এখানে নগরীর আশপাশ থেকে আশা আমের ব্যবসায়ীরা আসেন তাদের বাগানের রসালো আম নিয়ে। পাশেই রেলস্টেশন ও বাসটার্মিনাল হওয়ায় বেচাকেনাও বেশ ভালো হয়। তবে হুট করে লকডাউন জারি হওয়ায় ব্যবসায়িক ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন তারা।

এই চত্বরের আম ব্যবসায়ী আফসার আলী বলেন, ‘রাজশাহীর সবচেয়ে জমজমাট জায়গা এই বাসস্ট্যান্ড আম বাজার। প্রতিবছরই আমি এখানে আমার বাগানের আম এনে বিক্রি করি। বাস টার্মিনাল ও রেল স্টেশনের পাশে হওয়ায় অনেক যাত্রীরা এখান থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে আম কেনেন। এতে ব্যবসাও বেশ ভালো হয়। তবে গতকালের লকডাউনের পর থেকে ক্রেতা নাই। এখন আম নিয়ে বিপদে আছি।’

হরিয়াণের আম ব্যবসায়ী সাজ্জাত হোসেন। রাজশাহীতে ভ্যানে করে ঘুরে আম বেচেন তিনি। এবারের আম ব্যবসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বানেশ্বর বাজার থেকে আম কিনে রাজশাহীর বিভিন্ন বাজার ও এলাকা ঘুরে আম বিক্রি করি। লকডাউনের কারণে খুব সমস্যা হয়ে গেছে। বাজারে মানুষ কম আবার করোনার কারণে মানুষ বাড়ি থেকে বেরও হচ্ছে না। তাই ব্যবসাও খুব খারাপ যাচ্ছে।’

রাজশাহীর চারঘাটের আম বাগান চাষি সোমেন মন্ডল। গত কয়েক বছর ধরে ‘অনিমা আম বাজার’ নামে অনলাইনেই বিক্রি করছেন তার বাগানের আম। অনলাইনে আম বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ধরা বাধা কয়েকটা কাস্টমার আছে আমার। তারা এক চালানে দু একশ মণ আম কুরিয়ারে অর্ডার নেয়। বাইরের জেলা ছাড়াও রাজশাহীতেই আমার অনেক খুচরা ক্রেতা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে অর্ডার পাচ্ছি কম। কোনো কোনো দিন ফাঁকাও যাচ্ছে।’

কম অর্ডারের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘রাজশাহীর বাজারে প্রচুর আম উঠেছে। কিন্তু ক্রেতা নেই। আর বাইরের জেলার আম ব্যাপারীরা না আসায় ফড়িয়া বা মধ্যস্বত্বভোগীরা আম কমদামে কিনে বাইরের জেলায় বেশী দামে বিক্রি করছেন। এতে ক্রেতা কমে গেছে। আবার রাজশাহীর বাজারে ক্রেতা না থাকায় গ্রামের অনেক আম ব্যবসায়ীই এখন ভ্যানে করে শহরে কম দামে আম বিক্রি করছেন। এতে করে অনলাইনে অর্ডার নেই।’

আমের ট্রিপ নিয়ে যাওয়া ট্রাক চালক মোস্তাক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমের ট্রিপ চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেটে নিয়ে যাই। করোনার আগে সপ্তাহে ৪-৫ টা করে ট্রিপ হতো। এ বছর সপ্তায় একটি করে ট্রিপ হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা আম কম পাঠাচ্ছেন।’

বানেশ্বর হাটের ইজারাদার ওসমান আলী বলেন, ‘করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের। এবার হাটে আমের ক্রেতা অনেক কম, কিন্তু উৎপাদন অনেক বেশি। সেই তুলনায় খরচ অনুযায়ী পোষাচ্ছে না তাদের।’

তিনি আরও বলেন, ‘দাম কমে যাওয়ায় চাষিরা এবার বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। তবে রাজশাহীতে যদি আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেত তবে আম ব্যবসায় পুষিয়ে নিতে পারতেন ব্যবসায়ীরা।’

এদিকে কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাগানে আমের পর্যাপ্ত উৎপাদন হয়েছে। মূলত, করোনার কারণে আমের ক্রেতা বাজারে নেই। আবার কুরিয়ার সার্ভিস খোলা থাকলেও জেলা প্রশাসন ঘোষিত লকডাউনের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থার ঘাটতি এবং লকডাউনের কঠোরতায় দূরবর্তী স্থানে আম পাঠানোতেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের।

অন্যদিকে, আমের তৈরি জ্যাম, জেলি, আচার কিংবা বড় বড় কোম্পানি কর্তৃক ফ্রুট জুস সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও আস্ত আম সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। যার কারণে এবার আমের দাম ও ক্রেতা উভয়ের সঙ্কট রয়েছে বাজারগুলোতে। বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার ও কৃষি মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে তবেই কৃষিতে স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে।

মৌসুমি ফল আমের সংরক্ষণের কোনো উপায় আছে কি-না বা ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায় কি-না এ বিষয়ে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জি এম মোরশেদুল বারি ডলার বলেন, ‘আপাতত কুল হাউস সিস্টেম বা ফ্রিজআপ করার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে বারোমাসি জাতের আম চাষ করলে বছরের বিভিন্ন সময়ে আমের সরবরাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। এ ধরনের ভ্যারাইটি এরইমধ্যে ফল গবেষণা কেন্দ্রে আছে। আরও দু-একটি উচ্চ ফলনশীল আমের বারোমাসি জাত অবমুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এতে কৃষকরা আম সংরক্ষণের অভাবের সাময়িক ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবেন ও আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।’

ফয়সাল আহমেদ/এসজে/এমকেএইচ