অর্থনীতি

আবারও ‘বিশ্বসেরা’ বাংলাদেশের পুঁজিবাজার

করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপের মধ্যেও অভাবনীয় ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে দেশের পুঁজিবাজার। এর মধ্যেই এসেছে আরও একটি সুসংবাদ। পারফরমেন্সের বিবেচনায় গত মাসে (মে) বিশ্বে শীর্ষ অবস্থান অর্জন করেছে দেশের পুঁজিবাজার। এর আগে গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়েও দেশের পুঁজিবাজার ‘বিশ্বসেরা’ পারফরমেন্স করেছিল।

Advertisement

সম্প্রতি ব্লুমবার্গের তথ্যের ভিত্তিতে এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ক্যাপিটালের (এএফসি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মে মাসে এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় উত্থান হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি উত্থান হয়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে। মাসটিতে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক বেড়েছে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।

মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মে মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে উত্থান হয়েছে ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

Advertisement

প্রতিবেদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তান। মে মাসে দেশটির পুঁজিবাজারে উত্থান হয়েছে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। ৭ দশমিক ২০ শতাংশ উত্থানের মাধ্যমে পরের অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম।

এছাড়া, চীনের ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, ফিলিপাইন ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, কাজাখিস্তান ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ২ দশমিক ৫০ শতাংশ, থাইল্যান্ড শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ।

এ বিষয়ে দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বিনিয়োগবান্ধব পুঁজিবাজার গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এএফসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মে মাসে আমাদের পুঁজিবাজার সব থেকে ভালো পারফরমেন্স করেছে। এটা আমাদের জন্য ভালো সংবাদ।’

এর আগে, গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরেও এশিয়ার শেয়ারবাজারে বড় উত্থান হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সবচেয়ে বেশি ২৪ দশমিক ৪০ শতাংশ উত্থান হয়। মূলত ওই সময় থেকেই বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে।

Advertisement

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। আতংকে ওইদিন ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ৯৭ পয়েন্ট নেমে যায়। পরদিন (৯ মার্চ) আরও বড় ধস নামে। একদিনে ২৭৯ পয়েন্ট কমে যায় ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক। এ সময় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে অনেকে শেয়ারবাজার ছাড়েন।

পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় টানা ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয় শেয়ারবাজারের লেনদেন। এরমধ্যেই বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন আরও তিনজন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর শেয়ারবাজারে লেনদেন পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেন। টানা ৬৬ দিন বন্ধের পর গত বছরের ৩১ মে থেকে শেয়ারবাজারে আবার লেনদেন চালু হয়।

নতুন কমিশনের অধীনে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু হলেও অব্যাহত থাকে লেনদেন খরা। তবে গত বছরের জুলাইয়ে এসে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেয় নতুন কমিশন। অনিয়মে জড়িত থাকায় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অংকের জরিমানা করা হয়। সতর্ক করা হয় সরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি)।

একই সঙ্গে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসকে জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়। পরবর্তীতে আইসিবিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বাতিল করা হয় এক ডজনেরও বেশি দুর্বল কোম্পানির আইপিও। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের একের পর এক পদক্ষেপে ঘুরে দাঁড়ায় শেয়ারবাজার। এরই মধ্যে দেশে করোনার প্রকোপও কমতে শুরু করে।

তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। দেশে ফের উদ্বেগজনক হারে করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেলে মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ফের ধস নামে শেয়ারবাজারে। অবশ্য করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ‘লকডাউন’ দিলে শেয়ারবাজার বেশ তেজী হয়ে উঠে।

আতঙ্ক কাটিয়ে লকডাউনের মধ্যে হু-হু করে বাড়ে লেনদেন, সূচক ও বাজার মূলধন। এতে বিনিয়োগকারীদের মুখেও হাসি ফুটেছে। ৫০ কোটি টাকার নিচে নেমে যাওয়া লেনদেন এখন দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে হওয়া অনেকটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে।

শেষ ২৮ কার্যদিবসে টানা হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে ডিএসইতে। এর মধ্যে শেষ সাত কার্যদিবস দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে। এমনকি ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর সর্বোচ্চ লেনদেনের রেকর্ডও হয়েছে।

গত বছরের ৮ মার্চ ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ছিল ৪ হাজার ২৮৭ পয়েন্টে। চলতি বছরের ১০ জুন লেনদেন শেষে তা বেড়ে ৬ হাজার ৬৬ পয়েন্টে উঠে এসেছে। অর্থাৎ করোনার মধ্যে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক বেড়েছে ১ হাজার ৭৭৯ পয়েন্ট।

সূচকের পাশাপাশি বড় উত্থান হয়েছে বাজার মূলধনে। করোনার মধ্যে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। বাজার মূলধন বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম ওই পরিমাণ বেড়েছে। এ হিসেবে করোনার প্রকোপের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দামবৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের মূলধন প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা বেড়ে গেছে।

শেয়ারবাজারের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্প্রতি ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর প্রথম যখন বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়, সবার মধ্যে বড় ধরনের আতংকের সৃষ্টি হয়। সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, এমন আতংকও ছড়িয়ে পড়ে। যার পরিপ্রেক্ষিতে শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়। তবে সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনীতিতে খুব একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। যে কারণে শেয়ারবাজারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনীতি তুলনামূলক ভালো থাকার পাশাপাশি ব্যাংকের সুদের হারও গত এক বছরে বেশ কম রয়েছে। এর সঙ্গে কমিশনের নতুন নেতৃত্ব বাজার ভালো করতে বেশকিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। অনিয়ম করায় বিএসইসি অনেককে জরিমানা করেছে। পাশাপাশি কিছু দুর্বল কোম্পানির আইপিও বাতিল করেছে। আবার আইপিওতে আবেদন করার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এসব সবকিছু মিলে করোনার মধ্যে শেয়ারবাজার ভালো করেছে।’

ডিএসইর আরেক পরিচালক মো. রকিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১০ সালের পর গত এক বছর শেয়ারবাজার সব থেকে ভালো সময় পার করেছে। এর অন্যতম একটি কারণ সুদের হার কম থাকা। ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন খুব একটা মুনাফা পাওয়া যায় না। বরং শেয়ারবাজারে ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ব্যাংকের থেকে অনেক বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়। আবার ঘরে বসেই মোবাইলে, ই-মেইলে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন। এসবের ইতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে দেখা যাচ্ছে।’

এমএএস/এসএস/এএসএম