রাজশাহীর তালাইমারিতে রয়েছে রাজশাহী নগরের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার ‘পদ্মা সাধারণ গ্রন্থাগার’। প্রতিষ্ঠাকালে এ গ্রন্থাগারটি ছিল দুটি টিনের চালা দিয়ে তৈরি একটি দোকান। সে দোকানই এখন পাঁচতলার বিশাল ভবনে পরিণত হয়েছে।
Advertisement
জানা যায়, ১৯৭৭ সালের ১৫ অক্টোবর নগরীর তালাইমারি এলাকায় শহর রক্ষাকারী বাঁধের পাশেই সাড়ে ছয় কাটা জায়গার ওপর গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রতিষ্ঠা করেন সেই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থী।
রাজশাহী নগরের তালাইমারি শহীদ মিনার এলাকায় ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের পাশেই এই গ্রন্থাগারের অবস্থান। এর কাছেই রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)।
এছাড়াও তালাইমারি এলাকায় রয়েছে অসংখ্য ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস। তাই এখানে পাঠকের ভিড় লেগেই থাকে। তবে করোনাকালে বন্ধ রয়েছে সরকারি-বেসরকারি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে মেসগুলোতে নেই শিক্ষার্থীরা। আর তাই বর্তমানে গ্রন্থাগারেও পাঠক রয়েছে কম।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থী তালাইমারীতে গ্রন্থাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তারা হলেন, মো. মোস্তাকিম আহমেদ, মো. আবু সাঈদ, মো. হাফিজুল হক, মো. আজিজুল ইসলাম, মো. আব্দুর রহমান, মো. মজিবুর রহমান, মো. আব্দুল কাদেরসহ প্রমুখ। এলাকায় চাঁদা তুলে গ্রন্থাগারের জন্য নদীর ধারের সাড়ে ছয় কাঠার ওই নায্যমূল্যের টিনের চালাসহ জমিটি কেনা হয়।
গ্রন্থাগারের প্রথম সভাপতি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সমাজকর্ম বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মোস্তাকিম আহমেদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তালাইমারির এ এলাকায় ক্যাম্প তৈরি করে। এলাকাবাসী যুদ্ধের সময় সেখান থেকে চলে যান। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এ ক্যাম্প এলাকা ঘিরে কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হাতে নেয়া হয়। এর একপর্যায়ে আমরা গ্রন্থাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেই। এলাকায় চাঁদা তুলে ও শিক্ষার্থীদের জমানো টাকা দিয়ে গ্রন্থাগারের জমিটি কেনা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাবির শিক্ষার্থী আফিজুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতাহার হোসেন, আজিজুল ইসলাম, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষার্থী আবু সাইদ, শাহ মখদুম কলেজের শিক্ষার্থী এমদাদুল হকসহ বেশ কয়েকজন গ্রন্থাগার নির্মাণে ভূমিকা রাখেন। পরামর্শ দেন তৎকালীন রাজশাহীর ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান প্রয়াত মোসলেম উদ্দিন।’
বর্তমানে গ্রন্থাগারের সভাপতি আলহাজ মো. হাসেন আলী ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন মো. সাইদুর রহমান।
Advertisement
মূলত গ্রন্থাগারের সার্বিক বিষয়াদি দেখভাল ও পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অনেকটায় ঝিমিয়ে গিয়েছিল গ্রন্থাগারের কার্যক্রম। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালের দিকে ডাবলু হাসান, হাসনাত কবির রিপন, খসরুল আলমসহ অনেকে এটিকে সচল করতে উদ্যোগী হই। পরে ১৯৯২ সালে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রথম ১ লাখ ২০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান গ্রন্থাগারের জন্য নিয়ে আসতে সক্ষম হই। সে অনুদানের টাকায় গ্রন্থাগারের পাশেই একটি অফিস করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১০ সালের দিকে তৎকালীন মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও আমাদের সহায়তা করেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি হয়। চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ২০০ কোটি টাকার অনুদান পায়। আটটি সিটি করপোরেশনকে ২৫ কোটি করে দেয়ার কথা বলা হয় ওই চুক্তিতে। এ খবর পেয়ে আমরা কয়েকজন রাজশাহীতে নিযুক্ত ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার সন্দীপ মিত্রের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাদের এ বিষয়ে সাহায্য ও পরামর্শ দেন।’
সন্দীপ মিত্রের পরামর্শে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র মোসাদ্দেক হোসেনের কাছে সাড়ে চার কোটি টাকার তহবিল চেয়ে পরিকল্পনা জমা দেয়া হয়। বরাদ্দ হয় তিন কোটির বেশি টাকা। এ টাকায় প্রায় ছয় কাঠা জমির ওপর পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানান সাইদুর রহমান।
জানা যায়, এ গ্রন্থাগারে রয়েছে প্রায় ৯ হাজারের মতো বই। এছাড়া প্রতিদিন এখানে একটি ইংরেজি, চারটি স্থানীয় বাংলা পত্রিকা ও ৯টি জাতীয় পত্রিকাসহ মোট ১৪টি পত্রিকা পাঠকদের জন্য রাখা হয়। বর্তমানে এখানে ২০-২৫ জন পাঠক নিয়মিত আসেন। আগে গ্রন্থাগারে ৬০টি আসন থাকলেও পাঠক আসত তার প্রায় দ্বিগুণ। তবে করোনাকালে কমেছে পাঠকসংখ্যা।
গ্রন্থাগারটি দেখাশোনার জন্য রয়েছে একজন গ্রন্থাগারিক, একজন ক্লিনার ও একজান গার্ড। এদের গ্রন্থাগারের ফান্ড থেকেই সামান্য সম্মানি দেয়া হয়। তবে গ্রন্থাগারটি চলেই মূলত সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অনুদানে। রাস্তা পুনর্নির্মাণ করায় বর্তমান গ্রন্থাগারটি সাড়ে পাঁচ কাঠা জায়গায় অবস্থিত।
বর্তমানে করোনাকালে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে গ্রন্থাগার। স্বাভাবিক সময়ে এটি বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকতো পাঠকদের জন্য।
গ্রন্থাগারের ভেতর গিয়ে দেখা যায়, ভবনের ভেতরে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। কারও হাতে বই, কারও হাতে পত্রিকা আর কেউবা লিখছেন।
এখানে থাকা কয়েকজন পাঠকের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের প্রতিবেদকের। এসময় রাবি শিক্ষার্থী সোহরাব হোসেন বলেন, ‘এ গ্রন্থাগারে পরিবেশ খুব ভালো। মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারি। তাই এখানে আসি।’
রাবির মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী অনিন্দ সরকার প্রতিদিন গ্রন্থাগারে সময় দেন ৩-৪ ঘণ্টা। তিনি বলেন, ‘পড়ার পরিবেশ ভালো থাকায় এখানে সময় কাটাতে ভালো লাগে।’
রাবির হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব বলেন, ‘সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। তাই এখানে আসি নিরিবিলিতে পড়ার জন্য। এখানে চাকরি বিভিন্ন বই ও প্রতিদিনের পেপার সহজেই পাওয়া যায়। তাই জায়গাটি আমার খুব পছন্দের।’
রাবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষার্থী আশিফা আশরাফি আশা বলেন, ‘এ লাইব্রেরির পরিবেশ ভালো। মেয়েদের জন্য আলাদা বসার জায়গা রয়েছে। আছে আলাদা শৌচাগার। নতুন-পুরানো বই মিলে এখানে অনেক বই রয়েছে। এছাড়া এখানকার পরিচালনাকারীদের ব্যবহারও অনেক সুন্দর। তাই এখানে সময় কাটাতে ভালো লাগে।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনাকালে অন্যদের উচিত বাড়িতে বসে না থেকে লাইব্রেরিতে এসে বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করা। এতে একঘেয়ামি কাটবে। বর্তমানে অনেক কিশোর-কিশোরী ইয়াবা-এলএসডির মতো মারাত্মক নেশায় আসক্ত। এমন পরিবেশে জ্ঞার্নাজন করলে তারা এসব থেকে মুক্তি পাবে বলে মনে করি।’
গ্রন্থাগারটি নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার সম্পর্কে মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘এটি শুধু গ্রন্থাগারই নয়, এখানে ভবিষ্যতে শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিষয়ক বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। গ্রন্থাগারে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ইংলিশ ও কম্পিউটার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়াও শিশুদের চিত্রাঙ্কন ও মেয়েদের বিভিন্ন শৌখিন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। শুধুমাত্র করোনাকালীন সময়ের জন্য থমকে গেছে এর কার্যক্রম।’
এসএমএম/এমএস