চিকিৎসাক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের মানুষের বড় ভরসার জায়গা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল। প্রতিদিনই প্রায় অর্ধশত রোগী করোনার উপসর্গ ও সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন। প্রাণহানি হচ্ছে প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ জনের। এসব রোগীর সঙ্গে হাসপাতালে আসছেন স্বজনেরা।
Advertisement
রামেক এলাকায় করোনা রোগীর স্বজনদের অবাধ বিচরণের কারণে হাসপাতালসহ পুরো রাজশাহীজুড়ে ছড়াচ্ছে সংক্রমণ, এমনটাই মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও নগরীর সচেতন মহলের ভাষ্য, করোনা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা থেকে শুরু করে যাবতীয় তত্ত্বাবধায়নে থাকছেন স্বজনরা। রোগীর খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে করে ওষুধপত্র এবং চিকিৎসার বিভিন্ন বিষয়ও দেখাশোনা করছেন। ফলে তাদেরকে রামেক করোনা ইউনিটে চলাফেরা করতে হচ্ছে হরহামেশাই। এই পরিচর্যাকারী আবার বাইরেও ঘুরে বেড়াচ্ছে নিঃসঙ্কোচে। ফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র।
শুধু তাই নয়, এই অব্যবস্থাপনার কারণে রামেকের চিকিৎসক, নার্সসহ, ওয়ার্ডবয়সহ কর্তব্যরত সবাই রয়েছেন মারাত্মক ঝুঁকিতে। আশপাশের ওষুধের দোকানদার ও খাবার হোটেলের কর্মচারীরাও এই ঝুঁকির বাইরে নন।
Advertisement
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে ঘরে ঘরে। মূলত অসচেতনতা ও অব্যবস্থাপনাই এই ঝুঁকির কারণ। সম্প্রতি র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে যার প্রমাণ মিলেছে। সরেজমিনে রামেকে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকেই দীর্ঘ লাইনে গাদাগাদি করে করোনা পরীক্ষার নমুনা দিতে আসছেন। তাদের অনেকের মাঝেই রয়েছে উপসর্গ। করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনদের অনেকে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকছেন, বের হচ্ছেন। কেউবা ওষুধসহ জরুরি প্রয়োজনে রাজশাহী শহরেও যাচ্ছেন, মিশে যাচ্ছেন শহরের লোকজনের ভিড়ে। এদের আবার কেউ কেউ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের ফুটপাত থেকে কিনছেন খাবার, কেউ বা দোকানেই বসে খাচ্ছেন। ফলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে। খোদ রামেক হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ও কর্মকর্তারাই স্বীকার করেছেন এই ঝুঁকির কথা।
রামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আগে রামেকে মোট শয্যা ছিল ২৩২টি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭১টি-তে। করোনার কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে এই শয্যা সংখ্যা। তারপরও গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তিসহ রোগীর সংখ্যা ছিল ২৯০ টি, যা মোট শয্যা সংখ্যার চাইতে ১৯ বেশি। ফলে বেড না পেয়ে অনেকেই করোনা ইউনিটের ফ্লোরে, বারান্দায় কিংবা বাইরের করিডোরে আশ্রয় নিচ্ছেন। আবার অনেকেই ভর্তির সুযোগ না পেয়েই ফিরে যাচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ৪৬৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, তাতে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১৬৯ জনের শরীরে। ২১৬টি নমুনা পরীক্ষা করে রাজশাহীতে সংক্রমণ ধরা পড়ে ১০০ জনের শরীরে। রামেকের ৩, ২২, ২৫, ২৯ ও ৩৯ নাম্বার ওয়ার্ড মিলে করোনা ইউনিট করা হয়েছে। এছাড়াও আইসিইউ ও ভিআইপিতে রয়েছে করোনার চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা। কিন্তু করোনা ওয়ার্ডে প্রয়োজনে চিকিৎসক-নার্স পাচ্ছেন না রোগীরা। তাই ভরসা কেবল সঙ্গে থাকা স্বজনরাই।
রামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, দিনে অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ জন রোগী ভর্তি হন হাসপাতালে। তাদের সঙ্গে স্বজন আসেন আরও ৫ শতাধিক। হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন আরও কয়েকশ মানুষ। সব মিলিয়ে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার লোকের আনাগোনা হয় এখানে।
Advertisement
হাসপাতাল চত্বর ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালে আসা লোকজনদের অধিকাংশই এসেছেন এই অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। তারা কর্তৃপক্ষের টাঙানো কোনো নির্দেশনার ধার ধারছেন না। নিরাপত্তাকর্মীদের মাইকিংয়ে কান দিচ্ছেন না অনেকেই।
এই পরিস্থিতিতে সংক্রমণ ঝুঁকির শঙ্কার কথা জানিয়েছেন রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস। তিনি জানান, তারা রোগী ও তাদের স্বজনদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাসপাতালে প্রবেশের নির্দেশনা দিচ্ছেন। সবার সুরক্ষায় হাসপাতালে আগমন ও বহির্গমন পথ আলাদা করে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন নির্দেশনা টাঙানো হয়েছে। মাইকিং করে লোকজনকে সচেতন করছেন হাসপাতালের কর্মীরা। কিন্তু কিছুতেই লোকজনকে এই নির্দেশনা মানানো যাচ্ছে না।
হাসপাতালের বাইরের ফুটপাতে দোকানপাট সংক্রমণ শঙ্কা আরও বাড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন হাসপাতালের উপপরিচালক। তিনি বলেন, আমরা এসব দোকানপাট উচ্ছেদে জেলা প্রশাসন ও নগরীর রাজপাড়া থানা পুলিশকে চিঠি পাঠিয়েছি। তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
চিঠি পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে নগরীর রাজপাড়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজাহারুল ইসলাম বলেন, কর্তৃপক্ষের চিঠি পেয়ে হাসপাতালের সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন ফুটপাত দখলমুক্ত হয়েছে।
অসচেতনতায় প্রতিদিনই বিভাগজুড়ে করোনা সংক্রমণ লাফিয়ে বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল বলে জানিয়েছেন রামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম ইয়াজদানী। সংক্রমণ ঠেকাতে জনসমাগম এগিয়ে চলার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
রামেক পরিচালকের ভাষ্য, ‘রামেকে রোগী ও তাদের অসচেতনতার জন্য আমরাও বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন যাপন করছি। প্রয়োজনের তুলনায় শয্যা না থাকায় রোগী ও স্বজনেরাও মানছে না নির্দেশনা। এই মুহূর্তে প্রয়োজন রামেকের বাইরে বিশেষায়িত হাসপাতাল। এছাড়াও দ্রুত কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন প্রয়োজন, অন্যথায় ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।’
ফয়সাল আহমেদ/এসএস/জিকেএস