প্রতিটি জেলা-উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব পরিকল্পনায় এই প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ৫০টি মসজিদ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। বৃহস্পতিবার যার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
Advertisement
বিশ্বমানের এই মসজিদের ইতিবৃত্ত নিম্নে তুলে ধরা হলো
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী, হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর-দালালরা ইসলামের অপব্যাখ্যা করে মহান মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা, পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড, জুলুম নির্যাতন অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি নির্মমতাকে ইসলামের নামে সমর্থন ও সহযোগিতা করে পবিত্র ইসলামকে তারা বিতর্কিত করে তোলে।
শান্তির ধর্ম ইসলামের শাশ্বত রূপ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যথাযথভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরা একান্ত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় ইসলামের প্রকৃত রূপ জনগণের মাঝে তুলে ধরতে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেন।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনুধাবন করেছিলেন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, ইসলামের শাশ্বত শিক্ষা, ভ্রাতৃত্ববোধ, পরমতসহিষ্ণুতা ও ন্যায়বোধের মত মৌলিক গুণাবলী ও এর বাণী প্রচার-প্রসার দরকার। তেমনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ইসলামি মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বাস্তবায়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়নও প্রয়োজন। আর এজন্য প্রয়োজন একটি অভিন্ন প্লাটফর্ম। যার মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস, দর্শন, আইন, সংস্কৃতি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এ সকল মৌলিক উদ্দেশেই বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৫-এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর সুদূর প্রসারী চিন্তার প্রতিফলন রয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় একটি করে মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপন (১ম সংশোধিত) প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। যার ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা।
মডেল মসজিদ প্রকল্পের উদ্দেশ
১. বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৫-এর বাস্তবায়ন। দেশব্যাপী মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সারাদেশে শক্তিশালী ইসলামি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা।২. প্রধানমন্ত্রীর উদ্ভাবিত মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নির্মাণ করে সারাদেশে ইসলামি ভ্রাতৃত্ব ও প্রকৃত মূল্যবোধের প্রচার ও দীক্ষাদান।৩. সন্ত্রাস ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ এবং সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ও এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।৪. পুরুষ-নারী মুসল্লিদের জন্য নামাজ, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দীনি দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভৌত সুবিধাদি সৃষ্টি করা।৫. সর্বোপরি ইসলামিক জ্ঞান ও সংস্কৃতি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইসলামি মূল্যবোধের পরিচর্যা ও প্রসার করা এবং সততা ও ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের আনুগত্য সমর্থন সৃষ্টি করা।
Advertisement
প্রকল্প কার্যক্রম
অনুমোদিত প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী ৪০ শতাংশ জায়গার উপর জেলা পর্যায়ে চারতলা ও উপজেলার জন্য তিনতলা এবং উপকূলীয় এলাকায় চারতলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এসব মসজিদ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে।
তিন ক্যাটাগরিতে মসজিদগুলো নির্মিত হচ্ছে। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে ৬৯টি চারতলা বিশিষ্ট মডেল মসজিদ নির্মিত হচ্ছে। এগুলো নির্মাণাধীন রয়েছে ৬৪টি জেলা শহরে এবং সিটি করপোরেশন এলাকায়। এগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ২৩৬০ দশমিক ০৯ বর্গমিটার।
১৬৮০ দশমিক ১৪ বর্গমিটার আয়তনের ‘বি’ ক্যাটারির মসজিদ হবে ৪৭৫টি। এগুলো নির্মিত হচ্ছে সকল উপজেলায়। আর ২০৫২ দশমিক ১২ বর্গমিটার আয়তনের ‘সি’ ক্যাটাগরির মসজিদ হবে ১৬টি উপকূলীয় এলাকায়।
জেলা সদর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় নির্মাণাধীন মসজিদগুলোতে একসঙ্গে এক হাজার ২০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। অপরদিকে উপজেলা ও উপকূলীয় এলাকার মডেল মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ৯০০ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে।
এসব মসজিদে সারাদেশে প্রতিদিন চার লাখ ৯৪ হাজার ২০০ জন পুরুষ ও ৩১ হাজার ৪০০ জন নারী একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন।
লাইব্রেরি সুবিধার আওতায় প্রতিদিন ৩৪ হাজার পাঠক এক সঙ্গে কোরআন ও ইসলামিক বই পড়তে পারবেন। ইসলামিক বিষয়ে গবেষণার সুযোগ থাকবে ৬ হাজার ৮০০ জনের। ৫৬ হাজার মুসল্লি সব সময় দোয়া, মোনাজাতসহ তসবিহ পড়তে পারবেন।
মসজিদগুলো থেকে প্রতি বছর ১৪ হাজার হাফেজ তৈরির ব্যবস্থা থাকবে। আরও থাকবে ইসলামি নানা বিষয়সহ প্রতিবছর এক লাখ ৬৮ হাজার শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা। দুই হাজার ২৪০ জন দেশি-বিদেশি অতিথির আবাসন ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হবে প্রকল্পের আওতায়। কেন্দ্রগুলোতে পবিত্র হজ পালনের জন্য ডিজিটাল নিবন্ধনের ব্যবস্থা থাকবে। উপকূলীয় এলাকার মসজিদগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নিচতলা ফাঁকা থাকবে।
যে সুবিধা রয়েছে
১. নারী-পুরুষের পৃথক ওজু ও নামাজ আদায়ের সুবিধা২. প্রতিবন্ধী মুসল্লিদের টয়লেটসহ নামাজের পৃথক ব্যবস্থা৩. ইসলামিক বই বিক্রয় কেন্দ্র৪. ইসলামিক লাইব্রেরি৫. অটিজম কর্নার৬. ইমাম ট্রেনিং সেন্টার৭. ইসলামিক গবেষণা ও দীনি দাওয়া কার্যক্রম৮. হেফজখানা৯. শিশু ও গণশিক্ষার ব্যবস্থা১০. দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আবাসন ও অতিথিশালা১১. মরদেহ গোসল ও কফিন বহনের ব্যবস্থা১২. হজ্জ যাত্রীদের নিবন্ধনসহ প্রশিক্ষণ১৩. ইমামদের প্রশিক্ষণ ও গাড়ি পার্কিং১৪. ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসনসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অফিসের ব্যবস্থা।
প্রতিটি মসজিদ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে
১. জেলা শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৫ কোটি ৬১ লাখ ৮১ হাজার টাকা।২. উপজেলা পর্যায়ে ১৩ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ৩. উপকূলীয় এলাকায় ১৩ কোটি ৬০ লাখ ৮২ হাজার টাকা।
সারাদেশে নির্মাণাধীন এ সকল মসজিদের ভৌত অবকাঠামো গণপূর্ত অধিদফতরের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
উদ্বোধন হওয়া ৫০টি মসজিদ হলো
ঢাকার সাভার, ফরিদপুরের মধুখালী, সালতা, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া, কুলিয়ারচর, মানিকগঞ্জের শিবালয়, রাজবাড়ির সদর উপজেলা, শরিয়পুরের সদর উপজেলা, গোসাইরহাট, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, শেরপুর, কাহালু, নওগাঁর সাপাহার, পোরশা, পাবনার চাটমোহর, সিরাজগঞ্জের জেলা সদর, সদর উপজেলা, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, পবা, দিনাজপুরের খানসামা, বিরল, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, সদর উপজেলা, রংপুরের জেলা সদর, মিঠাপুকুর, সদর উপজেলা, পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর, জামালপুরের সদর উপজেলা, ইসলামপুর, ময়মনসিংহের গফরগাঁও, তারাকান্দা, ভোলার সদর উপজেলা, ঝালকাঠির রাজাপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর, নবিনগর, চাঁদপুরের কচুয়া, চট্টগ্রামের জেলা সদর, লোহাগড়া, মিরসরাই, সন্দীপ, কুমিল্লার দাউদকান্দি, খাগড়াছড়ির পানছড়ি, নোয়াখালীর সুবর্ণচর, চুয়াডাঙ্গার জেলা সদর, খুলনার জেলা সদর, কুষ্টিয়ার সদর উপজেলা, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা।
এসইউজে/জেডএইচ/এমকেএইচ