আজকাল খবরের জন্য পত্রিকা দেখা বা অনলাইন পোর্টাল খোলার আগেই সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজফিডে তা চলে আসে। কাল ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে একটা খবর দেখে হাসি আসলো। শিরোনাম- ‘এখলাসকে মনোনয়ন ফরম দেয়নি আওয়ামী লীগ, তা দেখে ফরমই চাননি ডিপজল’। রাজনীতির কতটা দৈন্যদশা হলে, রাজনীতির ‘নীতি’ কতটা নির্বাসনে গেলে এ দৃশ্যের অবতারণা হয়- ভাবা যায়!
Advertisement
দীর্ঘদিন একদল করেছেন, সে দল থেকে নির্বাচনও করেছেন কিন্তু নমিনেশন তুলতে গেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী দলের! কিছুটা ধন্যবাদ অন্তত এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ পেতেই পারে। দলছুট, হাইব্রিড, পিপলুরা পেছনের দরজা দিয়ে আওয়ামী লীগের নমিনেশন নিয়ে গেলেও, এই দুই বিএনপি নেতাকে আওয়ামী লীগ ফরমই তুলতে দেয়নি। পরীক্ষায় অটোপাসের আগে পরীক্ষায় বসারই সুযোগ পায়নি তারা।
এদের দোষ দেবেন কীভাবে! অতীতে এই ঢাকা শহরেই তো একই কায়দায় আওয়ামী লীগের নমিনেশন পেয়েছেন হাজী সেলিম। আমি তখন পলাশী-আজিমপুরের বাসিন্দা। হাজী সেলিম বিএনপির রাজনীতি করতেন, সিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিলেন। টাকা হয়েছে, এমপি নির্বাচন করবেন। বিএনপি থেকে নমিনেশন পাননি হেভিওয়েট এক প্রার্থীর কারণে। জাতীয় পার্টিতে যোগ দিলে নমিনেশন নিশ্চিত কিন্তু হঠাৎ ডাক পান আওয়ামী লীগের এবং যথারীতি টিকিট পেয়ে আমাদের ভোটে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যও হন।
যে খবর নিয়ে এখন কথা বলছি সেটা হচ্ছে ঢাকা–১৪ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ নিয়ে। এখলাস উদ্দিন মোল্লাহ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১১ আসনে বিএনপির মনোনয়নে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি ঢাকা মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতিও ছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে টানা তিনবার ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ হিসেবে যিনি নির্বাচিত সেই ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ তার ছোট ভাই।
Advertisement
অবশ্য বিএনপি নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও এখলাস মোল্লাহ দাবি করেন যে, ২০০৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখানে আদর্শ দেখার নেই, রীতিমতো ‘ভাই লীগ’। তিনি পার্শ্ববর্তী কামাল মজুমদারের আসন থেকেও নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন এর আগে। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের খলনায়ক মনোয়ার হোসেন ডিপজল গাবতলী এলাকায় বিএনপির সমর্থনে ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন। বিএনপির নেতা হিসেবে ওই এলাকায় তার নামই বেশি জানে জনতা।
খবরে বলা হয়, সাংসদ আসলামুল হক মারা যাওয়ার পর ঢাকা–১৪ আসন শূন্য হওয়ায় আগামী ২১ জুলাই এই আসনের উপনির্বাচন করার তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আওয়ামী লীগ ৪ জুন থেকে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের লক্ষ্যে ফরম বিক্রি শুরু করেছে। গত মঙ্গলবার দুপুরের পর এখলাস মোল্লাহ নেতাকর্মীসহ আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে যান। একই সময়ে মনোয়ার হোসেন ডিপজলও ফরম সংগ্রহের লক্ষ্যে বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। তার সঙ্গে চলচ্চিত্র অঙ্গনের আরও কয়েকজন অভিনেতা ছিলেন।
এখলাস মোল্লাহ মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে গেলে ধানমন্ডি কার্যালয়ের কর্মীরা সেখানে উপস্থিত নেতাদের তা জানান। এখলাস মোল্লাহকে আওয়ামী লীগ বা এর সহযোগী কোনো সংগঠনের প্রাথমিক সদস্যপদ কিংবা কোনো পদ আছে কি না, তার প্রমাণপত্র সংগ্রহের পরামর্শ দেন। সে মোতাবেক কর্মীরা এখলাস মোল্লাহর কাছে আওয়ামী লীগ করার প্রমাণপত্র চান। তবে তিনি তা দেখাতে পারেননি। তিনি বারবার বলার চেষ্টা করেন যে তিনি একসময় বিএনপি করলেও এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেন। কিন্তু তার কাছে ফরম বিক্রি করা হয়নি। এখলাস মোল্লাহর পরিণতি এবং ফরম ভাগ্য বুঝে ডিপজল ফরম সংগ্রহের জন্য চেষ্টা না চালিয়ে ফিরে যান।
আওয়ামী নেতারা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী যে কেউ আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু এখলাস মোল্লাহ ও মনোয়ার হোসেন ডিপজল বিএনপির চিহ্নিত এবং পদধারী নেতা ছিলেন। ফলে তাদের আওয়ামী লীগে যোগদান করে তারপর মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে হবে। আওয়ামী লীগে বা এর কোনো সহযোগী সংগঠনে যোগদান করেছেন, এমন প্রমাণপত্র দেখাতে বলা হয়। কিন্তু তারা তা পারেননি।
Advertisement
এখলাস-ডিপজলের এ ঘটনা শুধু দেশের রাজনীতির নীতিহীনতা প্রকাশ করছে না সেই সঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাও প্রকাশ করছে। বেগম খালেদা জিয়ার ভুল রাজনীতি, তারেকের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বিএনপির রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে স্থবিরতা চলছে। সংগঠনটি তার অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে পড়েছে। কেউ কেউ বলবেন হয়তো আদর্শের সংকটও চলছে। আমি তা দেখি না। গত সাড়ে তিন দশকের রাজনীতিতে চুল পরিমাণ জিয়ার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। সবাই জানে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ জিয়ার আদর্শ ছিল, বেগম জিয়ার আদর্শও তাই। ইসলামী মূল্যবোধের রাজনীতি জিয়া পছন্দ করতেন, বেগম জিয়ারও পছন্দ তাই।
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উত্থান চেয়েছিলেন জিয়া। সে কারণে তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করার ওপর থেকে আরোপিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করেছিলেন। বেগম জিয়ারও দহরম মহরম ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিয়ে। তিনি তাদের তার মন্ত্রিসভার সদস্যও করেছিলেন। কে মুক্তিযোদ্ধা, কে দালাল-রাজাকার সে ব্যাপারে জিয়া যেমন নির্বিকার ছিলেন বেগম জিয়াও তাই। এমনকি তার উত্থানের পথে যারা তার বাধা ছিলেন তাদের অপসারণের কাজে জিয়া যেমন নির্মম ছিলেন, বেগম জিয়াও তাই। জিয়ার সময়ে খন্দকার মোশতাকের ডেমোক্রেটিক লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ১৪ জন লোক মারা গিয়েছিল আর বেগম জিয়ার সময়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় তাদের ২৪ নেতাকর্মী মারা গেছেন। 'মারি-অরি-পারি যে কৌশলে'- এটি যেমন জিয়ার আদর্শ ছিল, বেগম জিয়ার আদর্শও তাই।
বহু দেশে বহুভাবে রাজনৈতিক দল সংকটে পড়েছে। আবার তার নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ঘটনার সুযোগ গ্রহণ করে তার থেকে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখন সংকট থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য বিএনপির প্রথম প্রয়োজন মামলার জট থেকে কর্মী বাহিনীকে ছাড়িয়ে আনা। মামলার কারণে অনেক কর্মী এখনো এলাকা ছাড়া বা নিষ্ক্রিয়। এখন জরুরি প্রয়োজন এসব কর্মীকে উদ্ধার করা। জামায়াত বর্তমান সময়ে সে কাজটি করে আসছে।
জিয়াউর রহমান তার প্রয়োজনে কিছু ভাসানী ন্যাপ থেকে, কিছু মুসলিম লীগ থেকে, কিছু মোশতাকের ডেমোক্রেটিক লীগ থেকে নেতাকর্মী এনে বিএনপি গঠন করেছিলেন। এ ছিল হরিছত্রের মেলা। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈষ্য, শূদ্র- সবাই একাকার হয়েছিল। মত-পথের কোনো মিল ছিল না। জাতপাতের কোনো বালাই ছিল না। অন্তর্কলহ লেগেই ছিল। জামালউদ্দিন আর ব্যারিস্টার সুলতানের কলহ মিটাতে চট্টগ্রাম গিয়ে বেচারা জিয়াউর রহমান বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। সুতরাং বিএনপি নেতা এখলাস আর ডিপজলের আওয়ামী লীগের নৌকা পাওয়ার চেষ্টায় বিএনপির হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
এখন প্রায় সাড়ে চার দশক বয়স হয়েছে বিএনপির। তার ঘরে জন্ম নেওয়া তার সন্তানরাই এখন এডাল্ট হয়েছে। আমানউল্লাহ আমান, খায়রুল কবীর খোকন, শামসুজ্জামান দুদু, আসাদুজ্জামান রিপন, সানাউল হক নিরু, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, হাবিবুন্নবী খান সোহেল, রিজভী আহমেদ, ব্যারিস্টার অসীম- এদের রক্তে অন্য কোনো উপাদান নেই। তারা সম্পূর্ণভাবে বিএনপির ঘরে জন্ম নিয়েছে, তারা বিএনপিরই সন্তান। বেগম জিয়া, তারেক রহমানের উচিত ধীরে ধীরে নেতৃত্বে তাদের প্রতিষ্ঠা করা। তৃণমূল থেকে শীর্ষস্থান পর্যন্ত একঘরে জন্ম নেওয়া সন্তানরা থাকলে দলের ভিত্তি মজবুত হবে। ভাড়াটিয়া দিয়ে জনসভা করা যায়, সংগঠন চালানো কঠিন।
এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বর্তমান সময়টা বেগম জিয়া ও বিএনপির জন্য কঠিন সময়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় আওয়ামী লীগ অফিসের ওপর দিয়ে কাক-চিল উড়ে যেত না। মিজান চৌধুরী বা আমেনা বেগম মোমবাতি জ্বালিয়ে দু-একজন অনুগামী নিয়ে বসে থাকতেন। কিন্তু সে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে বলে বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পেশাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের মোকাবিলা করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে এবং প্রাণ দিতে লাখ লাখ মানুষ ভ্রূক্ষেপ করেনি। নেতৃত্ব ও সংগঠনের পক্ষে মানুষের এমন বিশ্বাস অর্জন ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এটা ছিল গত শতাব্দীর সাত দশকে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় অর্জন। মানুষের আস্থা জয়ের এই অর্জনটাই আওয়ামী লীগের এখনো সবচেয়ে বড় পুঁজি। বিএনপিকেও হটকারী না হয়ে গঠনমূলক রাজনীতি দিয়ে সময়কে মোকাবিলা করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। anisalamgir@gmail.com
এইচআর/এমকেএইচ