সাহিত্য

ডটার অব আর্থ : অ্যাগনেস স্মেডলির প্রতিচ্ছবি

সুরাইয়া পারভীন

Advertisement

নারী জাগরণ যদি বলি, তবে তাই। খেটে খাওয়া মানুষের জীবনধারা খুঁজতে গেলে, এখানে সেটি পাই। প্রচণ্ড উদ্যমে অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছুটে চলা এক বেপরোয়া রমণী। ভাই-বোনদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, দায়িত্বনিষ্ঠা, সেই সাথে সময়ে প্রচণ্ড স্বার্থপরতা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বলছিলাম অ্যাগনেস স্মেডলির কথা। যাকে খুঁজে পাওয়া যাবে ‘ডটার অব আর্থ’ উপন্যাসে।

অ্যাগনেস স্মেডলি জন্মেছিলেন চরম দারিদ্রপীড়িত জীবনকে সঙ্গী করে উত্তর-পশ্চিম মিশৌরিতে, সময়টা ছিল ১৮৯২ সাল। শৈশবে তিনি নিজের পরিচিত মহলে ছিলেন সাধারণ চাষির মত। নিজের মাটি, নিজের ঘর, সারাবছর কষ্টেসৃষ্টে চলার মত কিছু মজুত খাদ্যশস্য নিয়ে। ঘি, পনির, সসেজ- এসবের সমাহার ছিল সেখানে। কষ্ট ছিল, পরিশ্রম ছিল। তবে জীবন ছিল নিশ্চয়তায় ঘেরা।

স্মেডলির বাবা শৌখিন মানুষ, মাঝে মাঝে নাচ, গান, পার্টি তাকে বড় বেশি টানে। শহুরে জীবনের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন। বেছে নিতে চাইলেন শহরের জীবন। ভিটেমাটি ছেড়ে শহরতলীতে এসে ওঠেন। শুরু হলো স্মেডলি পরিবারের অনিশ্চিত ভাসমান যাত্রা। আজ এখানে, কাল সেখানে। পরিবারের প্রায় সবাই হয়ে পরেন মজুর। স্কুলে পরিপাটি সাদা বাচ্চাদের পাশে অনুজ্জ্বল গায়ের রঙের একজন স্মেডলি। স্মেডলি পরিবার অরিজিন্যাল আমেরিকান। কী বলা যায় এদের, রেড ইন্ডিয়ান? রেল লাইনের ওপাশেই যাদের বাস। জীবন-জীবিকার তাগিদে আবার ভিন্ন কোথাও যাত্রা। আবার স্কুলে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যায়।

Advertisement

এমনই একটা অবস্থা থেকে ছিটকে বেরিয়ে স্মেডলি স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সব পার করতে থাকলেন। বাবা কখনো পরিবারে টাকা-পয়সা দিতেন। সৌখিন প্রজাতির মানুষ। বিনোদনের জন্য যেতেন মদ গিলতে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকল। জন্ম-নিয়ন্ত্রণে সে সময় আমেরিকায় বিধিনিষেধ ছিল। সেইসাথে স্মেডলি পরিবার ছিল অস্বচ্ছল। খনিতে মজুরের কাজ। এই খনি ঘিরেই তাদের তাবৎ দুনিয়া। অনাহার-অর্ধাহার আর প্রচণ্ড পরিশ্রমই ছিল স্মেডলির মায়ের সঙ্গী। স্মেডলির ষোলো বছর বয়সে মা মারা যান।

ছোট ভাই-বোনগুলো তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। কারো ভালোবাসায়ও জড়াতে চান না। কোনভাবেই তিনি নারী হয়ে থাকবেন না। একজন মানুষ হবেন তিনি, শুধুই একজন মানুষ। কোনভাবেই মেয়েমানুষ না। ভাই-বোনের জন্য করতে চান। তবে তার আগে নিজেকে তৈরি করে নেবেন। ভালোবাসায় জড়াবেন না। মায়ের করুণ জীবন তাকে বিয়ে সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করে রাখে। ভালোবাসার কথায় তার সামনে এসে দাঁড়ায়- নির্যাতিত স্বামীর অধীনে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে পুষ্টিহীন কষ্টের জীবন।

নিজেকে প্রবোধ দিতে থাকেন স্মেডলি। ভালোবাসা, কোমলতা আর কর্তব্যবোধ সাধারণত মেয়েদের আর দুর্বলদের জন্য; তার কোনটারই প্রয়োজন নেই। কাজ করে লেখাপড়ার খরচ জোগাতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে জড়িয়ে পরেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে। জেলে যেতে হয়েছিল তাকে। তার দেহভস্ম সমাধিস্থ করা হয়েছিল চীনের জাতীয় সমাধিক্ষেত্রে। যেখানে বেইজিংয়ের বিপ্লবী বীরেরা সমাহিত হয়েছেন।

তার লেখা ‘ডটার অব আর্থ’ এ তিনি জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহ লিখে গেছেন। পুরো বইটিতে আছে ঘাত-প্রতিঘাত উপড়ে ফেলে শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া। সেটা কোন কল্পকাহিনি নয়। কেউ রথ নিয়ে আসেনি সাথে করে। হোচট খেয়ে পড়েছেন আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন নিজেই। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি- কোথাও তেমন গুরুত্ব পাওয়ার মত কেউ ছিলেন না। দারিদ্রের কথা মাথায় রেখে পথ চলতে হয়েছে। দিনে কাজ করে রাতে লেখাপড়া করেছেন। কাছ থেকে শুনতেন সমবয়সীদের পার্টির হুল্লোড়। স্মেডলির মাথায় ভর করত কাজের বোঝা। কাজের চাপে বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে পড়াশোনা করে যাওয়া।

Advertisement

নিজের কাছাকাছি জগতের কারো থেকে উচ্চাভিলাষের বিষয়টি আসেনি। তার মা চাইতেন, ছেলেপেলেরা স্কুলে যাক- এ পর্যন্তই। মা মারা যাওয়ার পরে খালাকে নিজের অভিপ্রায়ের কথা জানিয়েছিলেন স্মেডলি। খালা প্রায় আৎকে উঠেছিলেন। কারণ পড়াশোনা করাটা তাদের কাছে বড়লোকি কাজ-কারবার। শুধু ধনীদের ছেলেপুলেরা, যাদের নিজেদের খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা নেই; শুধু তারাই লেখাপড়া করার মত বিলাসিতার বায়না ধরতে পারে। দুনিয়া জোড়া যাদের একটাই জগৎ সে কয়লাখনি। এরকম একটি অবস্থা থেকে নিজেকে ছিটকে বেরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন স্মেডলি।

স্মেডলি যখন জেলে, ছোটভাই বারবার এসেছে তার সাথে দেখা করতে। যদিও দেখা করার সুযোগ হয়নি। কারণ স্মেডলি অভিযুক্ত হয়েছিলেন খুব জঘন্যভাবে। দেশদ্রোহিতা, ভারতীয় প্রেমিকদের সহযোগিতা ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলাও করে এসব পত্রিকায় প্রচার হতো। বৃটিশ সাম্রাজের অধীন ভারতবর্ষ। সেক্ষেত্রে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে সহযোগিতা ভয়ানক অপরাধ। সাধারণ কয়েদীদের মত আচরণ তার সাথে করা হয়নি। তার কাছের মানুষ বিপদে পড়তে পারতো। সব তুচ্ছ করে তার অষ্টাদশবর্ষী ভাই ড্যান বারবার গিয়েছিল। গার্ডদের সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছে। ছেলেটি ছিল অনেকটা সদ্য গ্রাম থেকে আসা। বড় শহরের অলিগলিতে একেবারে নতুন।

একই ঘটনা ঘটেছিল স্মেডলির ছোট ভাইয়ের ক্ষেত্রে। ঘোড়া চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে। খুবই ছোট সে ভাইটি। বয়স বারো কি তেরো। স্মেডলি খুব শাসিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ছোট ভাই জর্জকে। খুব করে লুকিয়ে রেখেছিলেন চিঠিটা, সেই সাথে নিজেকে। যাদের সাথে বাস করছেন, তারা যেন কিছু বুঝে না ফেলে। তার মনে ভাইয়ের প্রতি আক্ষেপ, চুরি করেছে কি-না, সেটা স্পষ্ট করে বলেনি। যদিও কিছু টাকা সে ঠিকই পাঠিয়েছিল।

এ জায়গাতে আমার কাছে তিনি কেবলই একজন মেয়েমানুষ। দ্বিধা, জড়তা, আড়ষ্টতা যাকে পুরোপুরি গ্রাস করে রেখেছে। সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ পড়েছিলাম অনেক বছর আগে। ‘ডটার অব আর্থ’ পড়ার পর নিজের মনে হচ্ছে, সাতকাহনের দ্বীপাবলী চরিত্রটি অ্যাগনেস স্মেডলির ভারতীয় রূপ। দ্বীপাবলীর ঠাকুমা যখন তার বাসায় গেলেন- কেমন দ্বিধা, জড়তা কাজ করছিল দ্বীপাবলীর মাঝে। আশেপাশের অভিজাত ফ্লাটের বাসিন্দারা কেউ দেখে ফেলেনি তো! অথচ দ্বীপাবলী তখন সমাজে একজন স্বাধীন নারী।

লেখক: কলামিস্ট ও সাহিত্য সমালোচক।

এসইউ/এএসএম