বরিশালের আগৈলঝাড়ায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে অসুস্থ বৃদ্ধা দীপু বালাকে (৭০) সড়কের পাশে ফেলে যান স্বজনরা। গত বছরের ২৩ জুন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সড়কের পাশে পড়েছিলেন তিনি। সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করলেও করোনাভাইরাস আতঙ্কে কেউ কাছে যাননি। খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন আগৈলঝাড়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আফজাল হোসেন।
Advertisement
এর আগে ১৬ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এমন গুজব ছড়িয়ে ৯০ বছরের বৃদ্ধা জ্ঞানদা রানীকে রত্মপুর ইউনিয়নের বারপাইকা গ্রামের একটি মন্দিরের বারান্দায় ফেলে যান ছেলে জগদীশ সরকার ও পুত্রবধূ শিখা রানী। বিষয়টি জানতে পেরে খাবার ও ফলমূল নিয়ে বৃদ্ধা জ্ঞানদা রানীর সঙ্গে দেখা করেন ওসি মো. আফজাল হোসেন। তার কাছ থেকে ঘটনা শুনে অভিযুক্ত পুত্রবধূর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেন। পাশাপাশি বৃদ্ধা জ্ঞানদা রানীর চিকিৎসার সব খরচ বহন করেন তিনি।
গত বছরের ১০ এপ্রিল আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট ব্রিজ সংলগ্ন রাস্তার পাশে ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধার মরদেহ পড়েছিল। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে কেউ কাছে যাননি। পরে দুপুর ৩টার দিকে মরদেহ উদ্ধার করেন ওসি মো. আফজাল হোসেন।
বরিশালের আগৌলঝাড়া উপজেলার বাকাল ইউনিয়নের ফুল্লশ্রী গ্রামের দিনমজুর মিলন হালদারের ঘরে খাবার ছিল না। করোনাভাইরাসের কারণে ১০-১২ দিন ধরে মিলন হালদার কাজে বের হতে পারেন নি। প্রতিবন্ধী স্ত্রী গৌরী রানী হালদার ত্রাণের জন্য হাঁটুর ওপর ভর করে বাড়ির সামনের রাস্তায় অপেক্ষায় ছিলেন। ৫ এপ্রিল ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আগৈলঝাড়া থানার ওসি মো. আফজাল হোসেন। এ সময় গৌরী রানী হালদারের করুণ কথা শুনে ত্রাণ নিয়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হন আফজাল হোসেন।
Advertisement
বেতনের টাকা দিয়ে রাতের আধারের অর্ধশতাধিক কর্মহীন দরিদ্র মানুষের বাড়িতে গিয়ে ১০ কেজি চাল, দুই কেজি ডাল, দুই কেজি পেঁয়াজ ও পাঁচ কেজি করে আলু পৌঁছে দিয়েছেন ওসি মো. আফজাল হোসেন। এর আগে শীতবস্ত্র বিতরণ, এতিম শিশুদের খাবার বিতরণ ও তাদের সঙ্গে ঈদ উদযাপনসহ মানবিক নানা কর্মকাণ্ডের করণে ব্যাপক প্রশংসিত হন ওসি মো. আফজাল হোসেন।
গত অক্টোবরে ওসি মো. আফজাল হোসেনকে পাশের গৌরনদী থানায় বদলি করা হয়। বিদায়ের দিনে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন অনেকে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি কেউ কেউ।
এখানেও করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন ব্যবস্থাপনা ও জননিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অসহায় মানুষদের খাদ্য সাহায্যেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মো. আফজাল হোসেন। কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের নজরদারি, আক্রান্ত রোগীকে বাড়ি থেকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়া, মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফন বা সৎকারে সহায়তার কাজও করে যাচ্ছেন তিনি। সব মিলিয়ে করোনা দুর্যোগে মানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে ওসি আফজাল হোসেনের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে গোটা জেলায়।
গত তিন মাসের সার্বিক পারফরমেন্স মূল্যায়ন করে বরিশাল জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি হিসেবে ‘বেস্ট ওসি এ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন তিনি। সোমবার (৭ জুন) জেলা পুলিশের মাসিক অপরাধ দমন ও কল্যাণ সভায় জনহিতকর কাজ, ওয়ারেন্ট তামিল, মাদক উদ্ধার, বিভিন্ন অপরাধ দমন কর্মকাণ্ডে বিশেষ অবদান রাখায় স্বীকৃতি স্বরূপ ওসি মো. আফজাল হোসেনকে জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি নির্বাচিত করে তার হাতে ক্রেস্ট এবং সনদ তুলে দেন পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন।
Advertisement
এ বিষয়ে গৌরনদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আফজাল হোসেন বলেন, মানুষের কাছে প্রকৃত সেবক হিসেবে পরিণত হতে কাজ করে যাচ্ছি। আর সেবক হিসেবে বিবেকের তাগিদেই বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো চেষ্টা করি। শুধু নিজের স্বার্থে চাকরি করছি না। চাকরির শেষদিন পর্যন্ত মানুষের সেবায় যেন নিজেদের নিয়োজিত রাখতে পারি, সেটাই আমার প্রত্যাশা। সবাই দেয়া করবেন ।
গৌরনদী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সৈয়দা মনিরুন নাহার মেরী বলেন, আফজাল হোসেন নিজ দায়িত্ব বা কর্তব্যের বাইরে গিয়েও মানবিক নানা কাজ করে যাচ্ছেন। তাছাড়া কোথাও কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে বা আশঙ্কায় থাকলে তিনি নিজেই ছুটে যান। দ্রুত ব্যবস্থা নেন। গরিব অসহায় মানুষ বিপদে পড়লে তাদের পাশে দাঁড়ান। মানুষের মধ্যে তিনি আস্থার জায়গা তৈরি করেছেন।
গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুর রব হাওলাদার জানান, আফজাল হোসেন নিজ দায়িত্বের বাইরে মানবিক পুলিশ হিসেবে মানুষের পাশে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। গত দুই বছরে তাকে ছুটি নিতে দেখিনি। তার মতো কর্মকর্তা ও সদস্যদের কারণে করোনার এই দুর্যোগে পুলিশের এক নতুন মানবিক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে।
সাইফ আমীন/আরএইচ/এমএস