রাজশাহীর পবা উপজেলার দহপাড়া গ্রামের তেঁতুলতলার বাসিন্দা মো. রনি (৩৫)। সাত বছর বয়সে হারিয়েছেন মা। মায়ের মৃত্যুর পর বাবাও দ্বিতীয় বিয়ে করে হয়েছেন নিরুদ্দেশ। তখন থেকেই রনি ও তার বোনের ঠাঁই হয় নানির কাছে। নানা মারা যান অনেক আগে।
Advertisement
সংসার চালাতে শিশু বয়সেই তুলেছিলেন বাদামের ঝুড়ি। এরপর কিছুটা বড় হয়ে চালাতে শুরু করেন ভ্যান। বিয়ের পর বেড়ে যায় সংসার খরচ। গ্রামের পাশে তেঁতুলতলা বাজারে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দেন রনি।
পরিবার নিয়ে ভালোই চলছিল সংসার। হঠাৎ করেই গত বছরের এপ্রিলে শুরু হয় লকডাউন। করোনায় কঠোর লকডাউনে পুলিশের নির্দেশে বন্ধ করে দিতে হয় রনির চায়ের দোকান। এরপর বুদ্ধি করে দুই ফ্লাস্ক করে চা নিয়ে গ্রামের পথে-প্রান্তরে হেঁটে হেঁটে বিক্রি শুরু করেন।
যখন তিনি দেখলেন, হেঁটে হেঁটে খুব বেশি পরিমাণ চা বিক্রি হচ্ছে না। তখন পুরোনো একটি সাইকেল কেনেন, সেটি মেরামত করে আবারো ফ্লাস্ক নিয়ে বের হন। সাইকেলে ঝুলিয়ে দেন ফোন নম্বরসহ একটি বোর্ড। এতে ভালো সাড়া মিলতে থাকে। চায়ের সুনামও মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
Advertisement
চা বিক্রেতা রনি জানান, গত ডিসেম্বরে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। সেই সঙ্গে নিজের কিছু টাকা যোগ করে পুরোনো মোটরসাইকেল কিনেছেন। মোটরসাইকেলের দুই পাশে লোহার তৈরি দুটি বাক্স তৈরি করেছেন। সেখানে চাভর্তি চারটি বড় ফ্লাস্ক রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোটরসাইকেলের পেছনে সিটের ওপর একটি ঝুড়ির মতো বানিয়ে সেখানে রাখেন ওয়ানটাইম কাপ, পানিসহ অন্যান্য জিনিস।
রনির মোটরসাইকেলের নেমপ্লেটের ঠিক ওপরে একটি বোর্ডে সাদা কাগজে লেখা, ‘ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান। এখানে মসলাযুক্ত চা এবং দুধ চা পাওয়া যায়।’
বোর্ডের নিচের দিকে নাম ও দুটি মোবাইল নম্বর দেয়া আছে। সকাল ৯টা থেকেই চায়ের ভোক্তাদের ফোন আসতে থাকে ওই নম্বরে। ফোন পেয়েই বেরিয়ে পড়েন গন্তব্যে।
তিনি জানান, প্রথমদিকে মোটরসাইকেলে চা বিক্রি করতে দেখে আশপাশের অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন। সেসব নিয়ে মাথা ঘামাননি তিনি, করেছেন নিজের ব্যবসা। এখন সেই তাচ্ছিল্য করা সবাই রনির চায়ের কাস্টমার।
Advertisement
দিনে কত টাকা আয় হয় জানতে চাইলে রনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন লকডাউনেও সমস্যা নেই ইনকামের। প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪০০ কাপ মসলা ও দুধ চা বিক্রি হয়। তাতে আসে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার টাকা। প্রতিদিন তেল খরচ ও অন্যান্য খরচ বাদ দিলে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মতো থাকে। রনি মসলাযুক্ত চা ৫ টাকা আর দুধ চা ১০ টাকায় বিক্রি করেন। এই টাকায় চলছে সংসার, পরিশোধ হচ্ছে ঋণের টাকাও।’
বর্তমানে আশরাফের মোড়, মোসলেমের মোড়, হরিয়ান সুগারমিল মাঠ, তেঁতুলতলা বাজার, কাটাখালী বাজার, মোহনপুর ঢালান, চৌপায়া বিহাস থেকে আশপাশের এলাকায় আমার রেগুলার কাস্টমার। এছাড়া বেশকিছু ক্লাব ও গৃহস্থ বাড়ির মানুষ আমার রেগুলার কাস্টমার বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, চা বানানোর কাজে সহযোগিতা করেন আমার স্ত্রী রানু বেগম। সে প্রতিদিন সকালে বড় পাতিলে পানি গরম দেন। এরপর আমি এসে তাতে মসলাপাতি, চা-চিনি ও দুধের মিশ্রণ দেই। চা প্রস্তুত হতে না হতেই ফোন আসে বিভিন্ন জায়গা থেকে। অর্ডার নিয়ে মোটরসাইকেলে চা পৌঁছে দেয় গ্রাহকদের। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে ব্যবসা।
রনির চায়ের প্রতিদিনের ক্রেতা কাটাখালীর এলাকার সূর্য ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. পারভেজ মোশাররফ। প্রতিদিন তার চেম্বারে ১০-১৫ জন যুবকের আনাগোনা। তিনি বলেন, ‘রনি মসলা যেমন দারুণ, দুধ চা খেতেও অসাধারণ। তার চা খেয়ে এখন আর দোকানের চা খেতে ভালো লাগে না।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী রকি ইসলাম বলেন, ‘এটা খুব ভালো একটি উদ্যোগ। তাকে দেখে অনেকের আত্ম উদ্যোগী হওয়া উচিত। করোনাকালে মোটরসাইকেলে করে আমাদের শহরে এমন চা বিক্রি হয়- এটাও একটি ভালোলাগার বিষয়। আমার মনে হয় বাংলাদেশে কোথাও এমন সার্ভিস নেই, যেটা রাজশাহীর এই প্রত্যন্ত গ্রামে আছে।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আক্কাস আলী বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মোটরসাইকেলে করে চা বিক্রির ম্যাধ্যমে রনি সংসার চালাচ্ছেন। তার ঘরে দুই সন্তান-তামিম ইসলাম (১৩) ও জিম ইসলাম (৯)। তাদেরও পড়াচ্ছেন। বিষয়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রশংসনীয়।’
তিনি বলেন, আমাদের চা লাগলে রনিকে ফোন দেই। রনি ফোন পেলে দেরি করে না। দ্রুত চা পৌঁছে দেয়।
ভবিষ্যতে রনির পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, স্বপ্ন তো অনেক আছে কিন্তু টাকা নেই। টাকা থাকলে ইচ্ছে ছিল এই ভ্রাম্যমাণ ব্যবসাটি আরও বড় করব। দু-চারজন বেকার ছেলেকে মোটরসাইকেলে চা দিয়ে ছেড়ে দিতাম। আমি তাদের স্পেশাল চা বানিয়ে দিতাম।
ফয়সাল আহমেদ/এমআরএম/এমএস