বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ছোবল দেশের সার্বিক কর্মকাণ্ডে। করোনা রোধে ঘোষিত বিধিনিষেধ বা লকডাউনের কারণে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারিক কার্যক্রমও নিয়মিত চলছে না। সেজন্য সুপ্রিম কোর্টে আটকে আছে আলোচিত বহু মামলা, যেগুলোর শুনানি বা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। যদিও আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে অনলাইনে অর্থাৎ ভার্চুয়ালি অনেক মামলার শুনানি চলছে। কিন্তু অনেক চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি হচ্ছে না। সেজন্য মামলার বাদী, বিবাদী, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রশ্ন, লকডাউন এভাবে দীর্ঘায়িত হতে থাকলে আলোচিত মামলাগুলোর কী হবে?
Advertisement
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা হানা দিলে অন্য সব ক্ষেত্রের মতো উচ্চ আদালতের কার্যক্রমেও স্থবিরতা নেমে আসে। ওই সময় ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে ধীরে ধীরে কড়াকড়ি শিথিল হতে থাকলে সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে থাকা চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত মামলাগুলোও সচলের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ২০২১ সালের মার্চের শেষ দিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রকট আকারে আঘাত করলে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। ফলে এসব মামলার বিচার কার্যক্রম আটকে যায়। এখন পর্যন্ত সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এবং বিধিনিষেধও দীর্ঘায়িত হতে থাকায় বিলম্বিত হচ্ছে ওইসব মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তির কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংক্রমণ বাড়তে থাকার মধ্যে কোনো ঝুঁকি নেয়া উচিত হবে না। লকডাউন উঠে গেলেই এসব মামলার শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে।
আটকে আছে যেসব মামলাসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে এখন আটকে আছে অনেক আলোচিত মামলার চূড়ান্ত বিচারের কার্যক্রম।
Advertisement
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিলখানায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার পর গোটা দেশ শোকে বিমূঢ় হয়ে পড়ে
এর মধ্যে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিলখানায় বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা হত্যা মামলায় আসামি ও রাষ্ট্র— উভয় পক্ষের আবেদন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ কায়সারের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আসামিপক্ষের আপিল আবেদন, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের মামলায় দলটির পক্ষ থেকে আপিল, পুলিশ দম্পতি মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমান হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তাদের মেয়ে ঐশী রহমানের পক্ষে আবেদন, আওয়ামী লীগ নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
এছাড়া ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলা মামলায় আসামিপক্ষের জেল আপিল, ফেনীর সোনাগাজী ফাজিল মাদরাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন), আসামিদের করা আপিল পেপারবুক প্রস্তুতির পর শুনানির জন্য, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, রমনার বটমূলে বোমা হামলাসহ বেশকিছু মামলা হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানির অপেক্ষায়। পেপারবুক প্রস্তুতির পর্যায়ে রয়েছে বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলাও।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা, পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যা, সিলেটের শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলা, খুলনায় শিশু রাকিব হত্যা মামলার চূড়ান্ত বিচার প্রক্রিয়াও আটকে আছে সর্বোচ্চ আদালতে।
Advertisement
যা বলছেন আইনজীবীরাকরোনার কারণে আটকে থাকা এসব মামলায় শুনানি বা নিষ্পত্তির ব্যাপারে রাষ্ট্র এবং আসামিপক্ষ থেকে এখনই কোনো উদ্যোগ নেয়া যাচ্ছে না। সংক্রমণ পরিস্থিতির ইতিবাচক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বিধায় কবে নাগাদ শুনানি বা নিষ্পত্তি কার্যক্রম শুরু হবে তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। সেজন্য একদিকে যেমন অনেক বিচারপ্রার্থী পুড়ছেন স্বজন হারানোর বেদনায়, অন্যদিকে কারাগারে অনিশ্চয়তায় ধুঁকছেন ন্যায়বিচারপ্রার্থী আসামিরাও।
২০১৬ সালের ১ জুলাই জঙ্গিরা হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় আক্রমণ করে ২২ জনকে হত্যা করলে তাদের দমনে কমান্ডো বাহিনী অভিযান চালায়, সেই অভিযানে জঙ্গিদের ছয়জন নিহত হয় এবং একজন ধরা পড়ে
আইনজীবীরা বলছেন, উচ্চ আদালতে উল্লেখযোগ্য হারে মামলা নিষ্পত্তি হলেও জট কমছে না। এর অন্যতম কারণ, পুরোনো ও চাঞ্চল্যকর মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া। সার্বিক পরিস্থিতিতে মামলাজট কমানো ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে এসব মামলার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেয়া উচিত।
যদিও রাষ্ট্রপক্ষ ও অন্য আইনজীবীদের প্রত্যাশা, শিগগিরই এসব ঝুলে থাকা মামলার আপিলসহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেয়া হবে।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন জাগো নিউজকে জানান, করোনার প্রভাব কমলে সরকার ঘোষিত লকডাউন উঠে গেলে গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর সব মামলা শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে।
তিনি বলেন, মহামারি করোনাসহ নানা কারণে চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি আটকে আছে। লকডাউন শেষ হলে গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর তালিকা ধরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে শুনানি করা হবে। অগ্রাধিকার পাবে পিলখানা বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা হত্যা মামলা, হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলা মামলা, ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলা, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই আসামি জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও হবিগঞ্জের সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের রিভিউ আবেদন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন কোর্ট খোলা না থাকলে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হয় এটা ঠিক। গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর বহু মামলার শুনানিও করা যাচ্ছে না, আইনজীবীরা সংকটে আছেন। কিন্তু ২০২০ সালে করোনায় আমাদের অনেক আইনজীবী মারা গেছেন। যদি কোর্ট খুলে দেয়া হয়, আর যে পরিমাণ মানুষ কোর্টে আসেন, তাতে যদি আইনজীবী ও কোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের কেউ আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাহলে প্রধান বিচারপতিকেই জবাবদিহির মুখে পড়তে হবে, কেন কোর্ট খোলা হলো।
সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলা দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তোলে
এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, করোনার আগেই আমাদের বিচার বিভাগে মামলার সংখ্যা নিয়ে একটা সংকটপূর্ণ অবস্থা ছিল। করোনার পরে দীর্ঘদিন নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে সেই সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বর্তমানে গণপরিবহনসহ সব কিছু খুলে দেয়া হয়েছে। অথচ বিচার বিভাগ এমন একটা অবস্থায় রয়েছে যে, মানুষ বিচার না পেয়ে হতাশার মধ্যে রয়েছে। আমি মনে করি দীর্ঘদিন যদি এ অবস্থা চলে আর বর্তমানে মামলার যে জট আছে, তা দ্রুত যদি নিষ্পত্তি না করা হয়, তাহলে মানুষের বিচারের প্রতি অনীহা হবে। বিচারের প্রতি আস্থা না থাকার ফলে একটা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এ অবস্থায়ও মোটামুটি সুরক্ষা নিয়ে চলার ব্যবস্থা করতে হবে। পেশাগত কাজে যে আইনজীবীরা আদালতে যান তাদের করোনা ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে অনেক মামলা আছে। এমনকি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরাও দীর্ঘদিন ধরে কনডেম সেলে রয়েছে। এসব মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একটা কমিশন করা উচিত। তারা সুচিন্তিত মতামত দেবেন কীভাবে মামলা নিষ্পত্তি করা যায়। কোর্ট ম্যানেজমেন্ট যদি ঠিক করা হয়, তাহলে মানুষের ভিড় অনেকাংশে কমে যাবে। নিম্ন আদালতে এতো মানুষের ভিড়, এটার তো প্রয়োজন নেই। আইনজীবীর মাধ্যমে যারা কেবল মামলার আসামি, তারাই হাজিরা দেবেন।
বিচারক সংকট নিয়ে তিনি বলেন, আপিল বিভাগে তিনটা বেঞ্চ হতে পারে, বর্তমানে সেখানে দুটি বেঞ্চ আছে। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। সেই অনুপাতে বিচারক সংখ্যা অনেক কম।
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, করোনায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। লকডাউন উঠে গেলে এসব মামলার শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির আশা করছি।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচএমপিবি) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এ বিষয়ে বলেন, মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে বলবো লকডাউন শেষ না হলে বা করোনার প্রাদুর্ভাব না কমলে এখনই ঝুঁকি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট খুলে দেয়া ঠিক হবে না। গুরুত্বপূর্ণ মামলা হয়তো ওভাবে শুনানি হচ্ছে না। তবে আমার মনে হয় আপিল বিভাগের অনেক হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির আবেদনেরও শুনানি হচ্ছে। বড় বড় অনেক মামলায় ভার্চুয়ালি শুনানি সম্ভব। করোনার প্রাদুর্ভাব না কমলে কোর্ট নিয়মিত খোলা ঠিক হবে না। তবে, অনলাইনে (ভার্চুয়াল) কোর্টের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
দেশে এখন ভার্চুয়াল আদালতে অনেক মামলার কার্যক্রম চলছে
করোনার কারণে গত বছরের মার্চ থেকেই বন্ধ ঘোষণা করা হয় দেশের সব আদালত। এরপর গত বছরের মে মাস থেকে সীমিত পরিসরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল আদালত চালু করা হয়। করোনা সংক্রমণের হার কমে এলে আদালত পর্যায়ক্রমে খুলতে থাকে। এরপর চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে আবারও আদালত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে সীমিত পরিসরে ভার্চুয়ালি আদালত পরিচালিত হয়ে আসছে।
এ অবস্থায় আদালত খোলার দাবিতে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানিয়ে আসছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টর রুহুল কুদ্দুস কাজল ও সাবেক সম্পাদক ড. মো. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী। আইনজীবীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি বুঝে আদালত খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এফএইচ/এইচএ/এমকেএইচ