মতামত

টিকটক লাইকি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে

ঢাকা শহরে ছেলেবেলায় প্রথম প্রথম যখন বেড়াতে আসতাম তখন টেলিভিশন বা সিনেমা জগতের তারকাদের দেখার একটা বাসনা ছিল। আর কিছু না হোক অন্তত গ্রামের বন্ধুদের গিয়ে গল্পতো করা যাবে। সে কারণে মাঝে মাঝে এফডিসির সামনে গিয়েও দেখতাম। এরপর কতো চন্দ্রভূক অমাবশ্যা কেটে গেছে। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কতো কতো তারকার সাথে আড্ডা, বন্ধুত্ব হয়েছে। কিন্তু সময় এখন বদলেছে। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, সংগীত, ক্রীড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে সফল হয়ে তারকা হওয়ার জায়গাটায় পরিবর্তন এসেছে এবং এটাই বাস্তবতা।

Advertisement

‘ইউটিউবার’, ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’, ‘সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার’, ‘টিকটকার’, ‘লাইকি’ ‘ভ্লগার’—এই অভিধাগুলো ডিজিটাল যুগে নতুন এবং বেশ শক্তিশালী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মৌসুমী, ওমর সানী, পূর্ণিমা থেকে শুরু করে বিদ্যা সিনহা মিম, সাফা কবির, টয়া, তানজিন তিশা, মেহ্জাবীন, ইমরান মাহমুদুল, কোনালসহ অনেকেই এই ভিডিও নির্মাতাদের তালিকায় আছেন। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবের পর নতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন শ্রেণির দর্শকের কাছে পৌঁছার জন্যই এই প্রচেষ্টা।

এটা পর্যন্ত ঠিক ছিল। আবার একদম সাধারণ কেউ কন্টেন্ট দিয়ে পরিচিত পাওয়াটাও দোষের কিছু নেই। কিন্তু মুশকিলটা হলো কিশোর কিশোরীদের যে কোনো উপায়ে তারকা হওয়ার নেশা, পরিচিতি পাওয়ার নেশা এবং সে থেকে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই তারকা হওয়ার হাতছানি তাদের নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে। ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ডের ভিডিও। ভিউ লাখ লাখ। মান বা বক্তব্য নয়, এখানে মূখ্য প্রচার। হিসেবটা এখানে লাইক, কমেন্ট আর ফলোয়ারের। টিকটককে ঘিরে আয়োজন করা হয় সুইমিং পার্টি। যার আড়ালে চলে দেহ ব্যবসা। অ্যাপকেন্দ্রিক এই নৈতিক অবক্ষয়ের পরিণতি হচ্ছে ভয়াবহ।

সম্প্রতি ২২ বছরের এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে গত ২৭ মে ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে টিকটক হৃদয়সহ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর থেকেই মূলত টিকটক বা লাইকি নিয়ে বেশি আলোচনা হতে থাকে বাংলাদেশে। টিকটকার অপু গ্রেফতার হওয়ার পর একবার আলোচনাটা উঠছিল। রাজধানীর হাতিরঝিল, উত্তরা, চন্দ্রিমা উদ্যানসহ বিভিন্ন জায়গায় এখন টিকটকার বা লাইকির ভিডিও বানাতে কিশোর কিশোরীরা ব্যস্ত সময় পার করে।

Advertisement

সাধারণ মানুষের কাছে যা রীতিমত উপদ্রবে পরিণত হয়েছে। প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে এরা তারা হারিয়ে ফেলছে জীবনের নৈতিকতাও। টিকটকের পুল পার্টিতে পরিচয় হওয়ার পর বাসায় ডেকে নিয়ে ৫ কিশোরী ধর্ষণের মামলার প্রধান আসামি দেওয়ান রসূল হৃদয় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। রাজশাহী মহানগরীতে ‘আপত্তিকর’ টিকটক ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে ছেড়ে তরুণদের বিপথগামী করার অভিযোগে নয় জনকে আটক করা হয়। একটি আন্তর্জাতিক নারীপাচার চক্র গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক তরুণীকে ভারতে পাচার করেছে এবং তাদের জোরপূর্বক যৌনকর্মে বাধ্য করেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। চক্রের অন্যতম ‘মূল হোতা’ ঝিনাইদহের আশরাফুল মণ্ডল ওরফে ‘বস রাফি’। যে একজন টিকটকার।

যুব সমাজ ও তরুণদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার লক্ষ্যে বিগো লাইভ, টিকটক, লাইকির মতো মোবাইল ফোন অ্যাপ বন্ধ বা নিষিদ্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব বা অনেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকলেও টিকটক বা লাইকির মতো এতো বিতর্ক অন্যগুলো নিয়ে উঠেনি। সময়ের সাথে সাথে তারা নিজেদের সুরক্ষিত করেছে। সামাজিক অনেক আইনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু টিকটক বা লাইকির ব্যবহারের শুরুতে ডিজিটাল মাধ্যমে উপস্থিতির কন্টেন্ট কী হবে তা মানা হয়নি। অর্থাৎ টিকটকের অবাধ ব্যবহারের যে সুযোগ দেয়া হয়েছে সেটি ঠিক নয়। কারণ এখনো আমাদের মধ্যে দায়িত্ববোধের জায়গা তৈরি হয়নি। ফলে টিকটককে বিকৃত একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা চরম সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ।

টিকটক বা লাইকিতে যেসকল ভিডিও পোস্ট করা হচ্ছে তার অধিকাংশই নৈতিকতা বর্জিত এবং মার্জিত আচরণের বিপরীত। টিক টক–লাইকির মাধ্যমে কিশোর গ্যাং সংগঠিত হচ্ছে। তারা জড়িয়ে পড়ছে ভয়ানক অপরাধে। নতুন প্রজন্মের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে আচরণগত অসুস্থতা। সম্প্রতি র‌্যাব মহাপরিচালক এক অনুষ্ঠানে টিকটক ও লাইকি নিষিদ্ধের সময় এসেছে বলে জানিয়েছেন। পৃথিবীর কয়েকটি দেশে ইতোমধ্যে তা নিষিদ্ধও হয়েছে। তবে মুশকিল হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কারী বাহিনীও অ্যাপস ব্যবহার করে মানবপাচারের বিষয়ে এতোদিন অন্ধকারেই ছিল।

নজরদারি ছিল অ্যাপস ব্যবহারকারীদের ওপর কিন্তু মানবপাচারের বিষয়টা তারা জানতে পারেন আরো পরে, যা সাংবাদিকদের কাছে স্বীকারও করেছেন। এছাড়া ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরাতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মেয়েদের গোপনে নিয়ে সেফহোমে রাখার নামে নির্যাতন, কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে ওইপাড়ে বিশেষ করে ব্যাঙ্গালুরু থেকে কলকাতা হয়ে আসা টিকটকারদের হাতে তুলে দেয়া, তাদের হাত ঘুরে অনেক মেয়েকে দুবাই পাচার করার ঘটনাও নজরে এসেছে। কিন্তু শত শত নারী মিসিং হলেও থানায় ডায়রি বা মামলা পাওয়া যাবে হাতে গোনা। এর কারণ যাদের পাচার করা হয়েছে তারা মূলত নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত। যাদের পরিবার এসব বিষয়ে মোটেও সচেতন নয়।

Advertisement

একসময় ২০০৩/২০০৪ সালের দিকে উটের জকি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হতো শিশুরা। সাংবাদিক, এনজিও ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এসবের বিরুদ্ধে ব্যাপক সোচ্চার হলে তা বন্ধ হয়। তখন ইন্টারনেট সুবিধা তেমন ছিল না। এখন ঘরে ঘরে স্মার্টফোন আর স্মার্ট অ্যাপস। এক ফোনেই পুরো পৃথিবী। কিন্তু এতো বড় পৃথিবীতে ঘুরতে গিয়েই অনেকে খেই হারিয়ে ফেলছেন। হয়ে পড়ছেন গন্তব্যহীন। এখন সময় এসেছে সচেতন হওয়ার।

একথা ঠিক যে আমাদের সমাজটা যেভাবে চলছে বা বৈশ্বিক পরিস্থিতি যেদিকে এগুছ্ছে তাতে একটা সুস্থ সমাজ বা পরিবার বা সুন্দর শৈশব দিতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। তাই নানা কারণে সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। তাই বলেতো বসে তাকলে চলবে না। কারণ এই শিশু-কিশোরদের হাতেই আগামীর দেশ। এমনিতে দুর্নীতি, বাকপটু আমলা আর ধর্মান্ধদের জ্বালায় দেশ নিমজ্জিত। অর্জনগুলোও ম্লান হয়ে আছে। তাই অন্তত কঠোর হতে হবে নতুন প্রজন্মের প্রতি। তারা না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না। একটা টিকটক বা লাইকি প্রজন্মের হাতে আগামীর বাংলাদেশ হলে তারা দেশকে নিয়েও রসিকতা করে ভিডিও বানাতে ছাড়বে না। লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

এইচআর/এমকেএইচ