মতামত

৬ দফা ও ভিশন-২০২১: স্বাধীনতা থেকে স্বনির্ভরতা

একটি আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলের আন্দোলন বা দেশ গঠন প্রতি ক্ষেত্রেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকা অপরিহার্য। তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নয়ন দর্শন ছিল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তি, যা বিনির্মাণে মূল ভূমিকায় থাকবে জনগণ। এ কারণেই তিনি প্রস্তাব রাখেন ছয় দফার, যা ছিল বাঙালির মুক্তিসনদ, স্বাধীনতার বীজ। ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন, 'ছয় দফার মাধ্যমে আমি একটি সাঁকো দিলাম। এ সাঁকো পেরিয়েই আমরা স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়েছি। '

Advertisement

১৯৬৬ সালে ছয় দফা প্রণয়নের পর বঙ্গবন্ধু এটি গ্রহণ করার জন্য আতাউর রহমান খানসহ তৎকালীন পূর্ব ও পাকিস্তানের বিরোধী দলের সব নেতার কাছেই গিয়েছিলেন। কিন্তু ছয় দফা নিয়ে অগ্রসর হলে 'ফাঁসিতে ঝোলানো হবে' এমন ভয় থেকে কোনো নেতাই এগিয়ে আসেননি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে মিথ্যা প্রচারণা শুরু করেন। এমনকি ডানপন্থি দলগুলো ছয় দফাকে পাকিস্তান ধ্বংস করার ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলেও আখ্যায়িত করেন। কিছু বামপন্থি ছয় দফার ভেতরে সিআইএর সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ছয় দফার সমালোচনা হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতা ও পূর্ব পাকিস্তানের আব্দুস সালাম খানের মতো অনেকেই দল থেকে বেরিয়ে ১৯৬৭ সালের নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) গঠন করেন। আর পূর্ব বাংলার সভাপতি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ তার অনুসারীদের নিয়ে দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

বঙ্গবন্ধু নিজেই তার 'কারাগারের রোজনামচা'য় বারংবার বলেছেন, ১৯৪০ সালে সর্বদলীয় দলীয় সভায় অল ইন্ডিয়ান মুসলিম পার্টি শেরে বাংলার রচিত যে লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন, সেখানে পাকিস্তান মুসলিম লীগ স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিলো। এরপরেও ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকার কেবিনেট কমিশন যে প্ল্যান দিয়েছিলো, তাতেও ভারত ও পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথাই উল্লেখ ছিলো এবং উভয় দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তা মেনে নিয়েছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা দাবীর অন্যতম দফা স্বায়ত্তশাসন সংযোজন করলেন তখন পাকিস্তান আর তা মানতে তো পারেইনি উল্টো ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিলো! ছয় দফা কর্মসূচিকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনষ্ট করার পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার শুরু করে। এ মামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং ১৯৬৯ সালে গণ-অভুত্থানের রূপ নেয়।গণ-দাবির মুখে বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তিদানে বাধ্য হয়। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছয় দফা কর্মসূচির সপক্ষে গণরায়ে নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ করেন।

৬ দফার সমথর্ন ও তার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে বঙ্গবন্ধু ৭০ এর নির্বাচনের পূর্বে একটি লিফলেট প্রকাশ করেছিলেন। পাকিস্তানীরা কিভাবে শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্য করেছে এবং কি কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এই লিফলেটই তার জ্বলন্ত দলিল! এই লিফলেট যদি পাঠ্যপুস্তকে বাধ্যতামূলক করা হয় তবে নতুন প্রজন্ম শুধু জানবেই না ইতিহাস বিকৃতি রুখে দিতে পারবে। বঙ্গবন্ধুর লেখা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', 'কারাগারের রোজনামচা' ও 'আমার দেখা নয়াচীন' বইগুলোয় বর্ণিত তার মহান আত্মত্যাগ ও অর্জন আমরা তুলে ধরতে পারি নাই, এমনকি তার আদর্শ ধারণ তো করিই নাই বরং তার নাম ব্যবহার করে হীনস্বার্থ হাসিল করছি। স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে ঘোষণা করেন 'রূপকল্প-২০২১'। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার অর্ধশত বর্ষ পূরণ যাকে অর্থবহ করতে বাংলাদেশ আজ সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে ২২টি লক্ষ্যের মধ্যে পাঁচটি বিষয়কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেগুলো হলো- দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ, বৈষম্য রুখে দারিদ্র বিমোচন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা। ডিজিটাল যন্ত্রপাতি এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, অর্থাৎ আইসিটির বহুল ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ২০২১ সালে সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করা। বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, সুশিক্ষিত, সুদক্ষ এবং সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ।

Advertisement

বঙ্গবন্ধুর ছয় দফায় আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ, আর শেখ হাসিনার ভিশন ২০২১ দেবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ইতিমধ্যেই ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত ও মধ্যম আয়ের আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশে উন্নীত করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণে কাজ করে চলেছে। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ উন্নতির শিখরে! বাংলাদেশ আজ একটি সম্ভাবনার নাম। বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরেই আসবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তব রূপায়ণ।

লেখক : ডেপুটি এটর্নি জেনারেল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/এমকেএইচ

Advertisement