একটি সিমেন্টের বিজ্ঞাপন আছে। বাংলাদেশী শ্রমিকরা বিদেশে কাজ করে। একটি তারা খুব উল্লাস করছিল। বিদেশী মালিক জানতে চাইলো কী হয়েছে। বাংলাদেশী শ্রমিক ভাঙ্গা ইংরেজীতে জবাব দিলো, ইউর বিল্ডিং, মাই কান্ট্রিজ সিমেন্ট। উই আর ভেরি প্রাউড স্যার।
Advertisement
বিজ্ঞাপনটি খুব সরল এবং সেই শ্রমিকের গর্বটা অনুভব করতে আমাদের কারোই কোনো সমস্যা হয়নি। বাংলাদেশে মানুষ বেশি। তাই এদেশে শ্রম খুব সস্তা। এই সস্তা শ্রমিকরা বিদেশে যায় এবং মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে টাকা পাঠায়। তাদের পাঠানো রেমিটেন্সে ফুলে ফেঁপে ওঠে আমাদের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ। বিদেশে যাওয়া এই শ্রমিকরা যখন কোথাও একটু বাংলাদেশ খুঁজে পায়, তখন সত্যি গর্বে তাদের বুক ভরে যায়।
শুধু শ্রমিকরা নয়, দেশের বাইরে গেলেই দেশের প্রতি সবার টানটা যেন একটু বেড়ে যায়। বিদেশের কোনো দামী স্টোরে শার্টের কলারের নিচে ‘made in bangladesh’ লেখাটি দেখলে আমাদের নিজেদের কলারটা একটু উঁচু হয়ে যায়। গার্মেন্টস শিল্প এখন আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ড। তবে শুধু তৈরি পোশাক নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশে বাংলাদেশের কোনো না কোনো পণ্য আপনি পাবেন। আমাদের গর্ব করার পরিধি আস্তে আস্তে বাড়ছে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনীর সুনাম আমাদের গর্বিত করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের শ্রমিকরাও সততায়, শ্রমে দেশের জন্য অর্থের পাশাপাশি সুনামও বয়ে আনে। বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পের সুনাম আরো অনেক আগের। এখন বাংলাদেশ নানা রকমের গৃহস্থালী পণ্য, টিভি, ফ্রিজ, সাইকেল, মোটর সাইকেলসহ নানান পণ্য ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশের পণ্যের মান নিয়েও বড় কোনো প্রশ্ন নেই।
Advertisement
ব্র্যান্ড হিসেবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এখন এই ব্র্যান্ডকে টেকসই করতে চাই সরকারের নীতি সহায়তা। সুখের কথা হলো সরকার বাংলাদেশ ব্র্যান্ডকে আরো দৃঢ় করতে অঙ্গীকারাদ্ধ। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রীর কণ্ঠেও ছিল বাংলাদেশের জয়গান, ‘মেগা শিল্পের বিকাশ এবং আমদানি বিকল্প শিল্পোৎপাদনকে ত্বরান্বিত করার স্বার্থে “মেড ইন বাংলাদেশ” ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় সরকার বদ্ধপরিকর।’ শুধু মুখে বলেই ক্ষান্ত থাকেননি অর্থমন্ত্রী। দেশী শিল্পোদ্যাক্তাদের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে রয়েছে নানারকম কর ছাড়।
এটা সবাই জানেন, টেকসই উন্নয়ন এবং অগ্রগতির জন্য শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের যেহেতু সস্তা শ্রম আছে। তাই আমরা সহজেই অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে পারবো। সস্তা শ্রম আর সুষ্ঠু পরিকল্পনায় চীন আজ বিশ্ব অর্থনীতিকে শাসন করছে। অথচ চীনের এই বিস্ময়কর অর্থনীতির গল্প কিন্তু সাড়ে তিন দশকের। মনে আছে আশির দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের চীনা পণ্য বলতে আমরা জানতাম মোরগ মার্কা মশার কয়েল আর এক ধরনের সুই। তখন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া আর জার্মান পণ্যের বাজার ভালো ছিল। চীন মাত্র সাড়ে তিন দশকে সবাইকে ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। বন্ধু ভাবুন আর শত্রু, চীন ছাড়া এখন কারোই চলে না। মনে আছে একসময় ধোলাইখাল আর জিঞ্জিরা নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম।
হাসাহাসি না করে যদি সেই সব সৃষ্টিশীল মানুষগুলোর পাশে দাড়াতাম, চীনের মত না হলেও আমরা অনেকদূর এগুতে পারতাম। জিঞ্জিরায় নাকি যে কোনো জিনিস নকল করা যায়। নকল করার এই গুনটাকে যদি আমরা একটু ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো গেলে অনেকদূর এগোনো সম্ভব ছিল। এই যে এখন গ্রামে-গঞ্জে নসিমন-করিমন চলছে, ব্যাটারিচালিত নানান যানবাহন চলছে; এগুলোর কিন্তু কোনো বৈধতা নেই। কিন্তু মানুষের চাহিদার কারণেই এগুলো বানানো হয়েছে, চাহিদা আছে বলেই চলছে। সরকার যতই চেষ্টা করুক, যতদিন চাহিদা আছে, ততদিন চলবেই। তাই সরকার যদি এগুলোকে বৈধতা দিয়ে, ডিজাইনে পরিবর্তন এনে, ঝুঁকি কমিয়ে রাস্তায় চলার অনুমতি দেয় গাড়ি আমদানি খাতে আমাদের খরচ অনেক কমে যাবে। এভাবেই চাইলে আমরা দেশী শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে আমদানিনির্ভরতা কমাতে পারি। দরকার শুধু সরকারের নীতিসহায়তা।
আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা অনেক উদ্যমী এবং সৃষ্টিশীল। সাধারণ মানুষের উদ্যোগের সাথে একটু আধুনিক প্রযুক্তির মিশেল দরকার। একসময় আমরা রপ্তানী বলতে শুধু পাট, চা, চামড়া বুঝতাম। এখন সেখানে তৈরি পোশাক তো যুক্ত হয়েছেই, এসেছে অনেক বৈচিত্র। তৈরি পোশাকে আমরা শুধু সেলাই করি। অনেকে ঠাট্টা করে আমাদের দর্জিও বলে। তাতে যেহেতু পয়সা আসছে, আমার সেখানে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা যদি সত্যি সত্যি দেশী শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে শিল্প পণ্য রপ্তানি করতে পারি, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরো টেকসই এবং মর্যাদাসম্পন্ন হবে। সরকারের সহায়তা পেলে উদ্যোক্তারা নিজেদের পথ নিজেরাই খুঁজে নেবে। প্রাণ-আরএফএল নিজেদের মত করে তাদের বাজার খুঁজে নিয়েছে। ওয়ালটন, রানারও বাজার বানিয়ে নিয়েছে। শুধু কর কমালে হবে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে, ব্যবসা করার পথে বাধাগুলো দূর করতে হবে।
Advertisement
আমরা মুখে দেশকে ভালোবাসার কথা বলি। ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে চোখ ভেজাই। কিন্তু দেশ নিয়ে আমাদের অনেক হীনমন্যতাও আছে। সবচেয়ে খারাপ সাবানের নাম বাংলা সাবান, সবচেয়ে খারাপ মদের নাম বাংলা মদ। এই হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলতে হবে। ‘দেশী পণ্য কিনে হও ধন্য’ এটা যেন নিছক স্লোগান না হয়, আমরা যেন সেই প্রবাসী শ্রমিকের মত দেশী পণ্য কিনে ‘প্রাউড ফিল’ করতে পারি। টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, এসি, সাইকেল, মোটর সাইকেল, গৃহস্থালী পণ্য যেসব দেশে রপ্তানি হয়; তাদের কাছে কিন্তু এগুলো বিদেশী পণ্যই। তাই বিদেশী মানেই ভালো, আর বাংলাদেশী মানেই খারাপ; এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশী ব্র্যান্ড আমাদের গর্বিত করবে, বিশ্বে মর্যাদা দেবে।৬ জুন, ২০২১
এইচআর/জিকেএস